তরুণ কান্তি বড়ুয়া

  ০৭ আগস্ট, ২০২২

অভিমত

চাটুকারিতার প্রভাব ও প্রতিকার

তোষামোদ বা চাটুকারিতা এক মারাত্মক ব্যাধির মতো মানুষের জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। চাটুকার বা তোষামোদকারী সব যুগেই ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। ক্ষমতা চর্চা মানুষের কাছে যত দিন থাকবে মোসাহেবি বা তোষামোদও তত দিন অব্যাহত থাকবে। তোষামোদ মাঝে মধ্যে মানুষের বিবেক বুদ্ধি, মনুষ্যত্ব বোধ ও সৌজন্য বোধকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করে। রাষ্ট্রনায়ক থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরের জনগণ তোষামোদের শিকারে পরিণত হয়। তোষামোদে আপ্লুত ব্যক্তি তোষামোদকারীর হীন অভিপ্রায় বুঝেও না বুঝার ভান করে। তোষামোদকারী দ্বারা পরিবেষ্টিত থেকে অনেকেকে আপাত সম্মান, যশ, খ্যাতি ও আত্মপ্রতিষ্ঠা, আত্মতুষ্টিতে মদমত্ত থাকতে দেখা যায়। আসলে কারো অহেতুক অতিরিক্ত, কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো বা অনুপস্থিতিতে অপরের ভূয়সী প্রশংসা করে তার মাধ্যমে অতীতে লাভবান কিংবা ভবিষ্যতে লাভবান হওয়ার নির্লজ্জ প্রয়াসটাই হচ্ছে চাটুকারিতা বা তোষামোদ। আরো স্বচ্ছ করে প্রকাশ করতে হলে সত্য-মিথ্যা, ভালো মন্দের অন্ধ ভাবাদর্শে কপটতার গ্লানিময় স্বভাবে অন্যকে পরিতুষ্ট করার অনৈতিক উদ্যোগ ও প্রয়াসকে চাটুকারিতা হিসেবে অভিহিত করা হয়। সমার্থক শব্দগুলো হলো তোষামোদ, মোসাহেবি বা তৈলমর্দন, খয়ের খাঁ, পদলেহী, আজ্ঞাবহ, হীনস্থাবক, তোয়াজকারী, জোহুজুর, পরাশ্রয়ী, পরগাছা ইত্যাদি। হর প্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, তৈলের অপর নাম স্নেহ। আপনি আমাকে স্নেহ করেন, আমি আপনাকে স্নেহ করি বা শ্রদ্ধা করি অর্থাৎ আমরা একে অপরকে নিরন্তর তৈল দিয়ে থাকি। তৈলের দ্বারা যা ঠাণ্ডা করা যায় তা আর অন্য কিছু দ্বারা করা যায় না। হর প্রসাদ শাস্ত্রী আরো বলেছেন, বাস্তবিকভাবে তৈল সর্বশক্তিমান; যা বলের অসাধ্য, বিদ্যার অসাধ্য, যা ধনের অসাধ্য, যা কৌশলের অসাধ্য তা কেবলমাত্র তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে। কাজেই ঠিকমতো তৈল মারিতে পারিলে ব্যবসায় সুবিধা করা যায়, চাকরিতে সুবিধা করা যায়, যোগ্যতা না থাকলেও উচ্চতর পদে পদোন্নতি লাভ করা যায়। এমনকি মেধা না থাকলেও ভালো ছাত্র হওয়া যায় কিংবা ভালো ক্লাস পাওয়া যায়। অনেক ছাত্রকে শিক্ষকদের তৈলমর্দনে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। কাজেই বহিঃদৃষ্টিতে অনেকে শিক্ষকের কাছে ভালো ছাত্র হয়ে যায়। বাস্তবে দেখা যায় তৈল না মারা বা চাটুকারিতায় অভ্যস্ত নয় এমন ভালো ছাত্ররাও খুব ভালো ফল লাভ করতে পারে। অবশ্য তৈলমর্দন বা চাটুকারিতায় পারদর্শী ছাত্ররা তৈলের জোরে প্রত্যাশার বাইরে অপেক্ষাকৃত ভালো ফল লাভ করে থাকে।

আসলে চাটুকারিতা, তোষামোদ বা তৈলমর্দনের মহিমা অপরূপ ও অপ্রতিরোধ্য। হাজার গুনের দ্বারা যা অর্জন করা যায় না তা তোষামোদ বা চাটুকারিতায় অনায়াসে অর্জন করা যায়। তোষামোদ বা চাটুকারিতায় গুরুজনেরও স্নেহ কিংবা অনুগ্রহ লাভ করা যায়। গৃহিণীকে সন্তুষ্ট করতে, তার প্রণয় লাভ করতেও অনেক সময় চাটুকারিতার প্রয়োজন হয়। কারণ কারো জীবন সংগীনির মুখের ওপর বলা যাবে না অমুকের স্ত্রী সুন্দরী, তার চালচলন, কথাবার্তা বেশ সুন্দর, তখনই কিন্তু সংসারে আগুন জ্বলে উঠবে। গৃহ ভৃত্যদের সময়ে অসময়ে তৈলমর্দন করতে হয় একমাত্র তাদের কাছ থেকে ভাল সেবাযত্ন পাওয়ার প্রত্যাশায়। যে তৈলমর্দন করতে পারে তিনি অবশ্যই খুব পারদর্শী। তৈলমর্দনকারী পাত্র জ্ঞান, সময় ও সুকৌশলে তাদের ঈপ্সিত কাজটা করে থাকে। তৈলমর্দন, তোষামোদ বা চাটুকারিতা এমন একটা জিনিস যা মুহূর্তেই নষ্ট হয়ে যাবে না। কারণ এসব অভ্যাসের ফল সুদূরপ্রসারী। এ অভ্যাসটার একবার সদ্ব্যবহার হলে তার সুফল একদিন না অন্যদিন সুনিশ্চিতভাবে ভোগ করা যায়। তৈলমর্দন বা চাটুকারিতায় যিনি পারদর্শী তিনি সজ্ঞানেই এটি করে থাকেন। আর যাকে উদ্দেশ্য করে এ কাজটি করা হয় তিনি বিষয়টি বুঝতে পেরেও বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে তা উপভোগ করেন কারণ এতে তিনি আত্মতুষ্টি লাভ করেন। প্রতিদান স্বরূপ তিনি তাকে নৈতিকভাবে না হলেও অনৈতিকভাবে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন।

উচ্চাকাঙ্ক্ষা মানুষের জীবনের সহজাত প্রবৃত্তি। এ দুর্বার উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে মানুষ মরিয়া হয়ে উঠে। কেউ পরিশ্রম, ধৈর্য, অধ্যাবসায়, আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রচেষ্টায় এটি অর্জন করতে সচেষ্ট থাকেন। এ কাজটি কষ্টলব্ধ বিধায় ধৈর্য ধরার ইচ্ছা বা মনোবৃত্তি আবার অনেকের থাকে না। তাই ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে সহজ পথটি খুঁজেন এবং বেছে নেন চাটুকারিতার মতো মন্দ ও ঘৃণ্য পদ্ধতিটি। সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা কারো উপকার, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার কথা কৃতজ্ঞতার মাধ্যমে স্মরণ করে না। তবে তোষামোদকারী মনোবৃত্তির কিছু কিছু লোকেরা সুযোগ পেলে অযাচিতভাবে নগ্ন ও উন্মুক্ত চাটুকারিতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তোষামোদকৃত ব্যক্তির কোনো ব্যর্থতা সাধারণত তোষামোদকারীকে ভাবায় না। প্রতিষ্ঠানের স্বনামধন্য ব্যক্তি, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, সরকার ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা সাধারণত অধস্তন ব্যক্তির তোষামোদের শিকারে পরিণত হয়ে থাকেন।

ক্ষমতা কিংবা অর্থের দাপট সাধারণত তোষামোদকারীদের আকৃষ্ট করে থাকে। অর্থ ও ক্ষমতা না থাকলে তোষামোদি ব্যক্তিরা তোষামোদকৃত ব্যক্তির ছায়াও মাড়ায় না। বর্তমান সময়ে অফিস আদালতে কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাটুকারিতার প্রতিযোগিতামূলক বিস্তার পরিলক্ষিত হয়। এ শ্রেণির অনৈতিক প্রত্যাশা হলো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে তোষামোদ করে কাঙ্ক্ষিত সুযোগ-সুবিধা আদায় করা। পেশাগত কাজে কারো যতই দক্ষতা থাক, ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিকে তুষ্ট করতে ব্যর্থ হলে সফলতা লাভের প্রতিযোগিতায় তিনি হেরে যাবেন। ব্যক্তিত্ব সম্মানবোধ এহেন গর্হিত কাজে বাধা দিলেও শতভাগ দায়িত্ব সচেতন থাকা সত্ত্বেও তিনি হবেন হয়রানির শিকার। এমনকি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে সে ব্যক্তির আনুগত্যও ম্লান হয়ে দাঁড়াবে। দুর্বিষহ এমন অবস্থায় তিনি প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন শুধুমাত্র ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কৃপাদৃষ্টি না থাকার কারণে।

আসলে দুর্নীতিবাজদের যেমন ধর্ম নেই তেমনি চাটুকারদেরও কোনো ধর্ম নেই। ক্ষমতার পালাবদলেও তারা খোলস বদলিয়ে স্বস্থানেই টিকে থাকতে পারে। হর প্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর তৈল প্রবন্ধে সর্বশেষ বাক্যে লিখেছেন এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর তৈলে মনও ফেরে। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চাটুকারিতার দৌরাত্ম্য হরহামেশাই চোখে পড়ে। সময়ে সময়ে এরা এত প্রভাবশালী যে চাটুকারিতার কারণে প্রতিষ্ঠানের, সমাজের শীর্ষস্থানীয় লোকেরাও বেকায়দায় পড়ে যায়। চাটুকাররা জানেন যে তাদের চাটুকারিতার উদ্দেশ্য সাধারণ জনগণ বুঝতে পারে। তারপরও ব্যক্তি স্বার্থ ও সুবিধা লাভের বিষয়টি মাথায় রেখে নগ্নভাবে তাদের চাটুকারিতায় ডুবে থাকতে দেখা যায়। চাটুকারদের অবস্থা হচ্ছে কানে দিয়েছি তুলো, পিঠে দিয়েছি কুলো। অর্থাৎ কোন সমালোচনাই চাটুকারের টিকিটা পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারে না। মানুষ জন বিরক্তি বা বিব্রত বোধ করলে তারা কিন্তু তেল মারার কাজটি দিব্যি চালিয়ে যায়। চাটুকাররা বসদের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় মাত্রাতিরিক্ত স্যার, স্যার, জি জি বলতে দেখা যায় অথচ যাকে তোষামোদ বা তৈল মর্দন করে কথাগুলো বলেন উনি কিন্তু শুধু স্তবক বাক্য শুনতে পান, চাটুকারকে দেখতে পান না। তারপরও দেখা যায় চাটুকার যখন তৈল মেরে কথা বলে তখন মনে হয় তিনি যেন বসা চেয়ার থেকে এখনই পড়ে যাবেন। এসব চাটুকারদের অনেকাংশে লেখাপড়ার দুর্বলতা এবং কাজের দক্ষতা না থাকায় রাত-দিন বসদের তোষামোদে সময় ব্যয় করে। প্রয়োজনে নিজের গদি রক্ষায় বসদের পা ছুঁয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে।

হর প্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর রম্য গল্প তৈল এ এসব স্বার্থান্বেষী চাটুকারদের চরিত্র সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, যে তৈল ব্যবহার করতে জানে তার জন্য জগতে সব কাজ সহজ, জায়গা মতো তৈল দিতে পারলে হয়। তিন বলেছেন, বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসর হইতে পারে, আহম্মক হইলে ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকিলেও সেনাপতি হইতে পারে। তোষামোদকারী ব্যক্তির যোগ্য্যতা না থাকা সত্ত্বেও যোগ্যতর ক্ষেত্রে স্থান করে নিতে পারে। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের এজেন্ট বা সোর্স হিসেবে নিন্দনীয় কাজটি করা এসব অযোগ্য ও অদক্ষ লোকদের বিবেকে বাঁধে না। তাছাড়া তৈল মর্দনকারী ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্য হলো ক্ষমতা ও অর্থ প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিদের গুণকীর্তন করা। তিনি বা তারা কোনো ভুল করেন না এমন ভ্রান্তিমূলক ধারণা তাদের হৃদয়ের গভীরে প্রোতিত করা।এসব তোষামোদকৃত ব্যক্তি অন্যের বক্তব্য কিংবা মন্তব্যের সমালোচনায় সোচ্চার কিন্তু তারা তোষামোদকারী ব্যক্তির স্তুতিবাক্য বা এ ধরনের প্রশংসা বারবার শুনে তোষামোদমূলক বাক্যের মায়াজালে নিজেদের আ কণ্ঠ নিমজ্জিত করে ফেলেন। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক মূল্যবান বিষয়গুলো ভিন্ন অবয়বে দেখার সুযোগ আছে এ রকম কোনো চিন্তাভাবনা তাদের মনের কোণে ঠাঁই পায় না।

তোষামোদি মিথ্যা স্তুতিগাথা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য মোটেও কল্যাণকর নয় বরং খুবই ক্ষতিকর। সমাজের, রাষ্ট্রেরর সব স্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি গন শেষ পরিণতিতে অনেক সময় মর্মান্তিক বিপদের সম্মুখীন হন এবং তাদের এ সর্বনাশের জন্য তোষামোদকারী বা চাটুকাররাই দায়ী। চাটুকারিতার অন্ধ গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সর্বাগ্রে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। আত্মশুদ্ধি ও আত্মতুষ্টি মানুষকে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে সহায়তা করে। পরিশুদ্ধ ব্যক্তি সহজে চাটুকারিতাকে প্রশ্রয় দেয় না। তাই সংশ্লিষ্ট সবার কাছে অধস্থনদের মূল্যায়ন হওয়া দরকার যোগ্যতার ভিত্তিতে চাটুকারিতার কূট কৌশলে নয়। আর তাই যদি হয় তাহলে সমাজ, দেশ সর্বোপরি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের হাত থেকে নিশ্চিতভাবে রক্ষা পাবে এতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না।

লেখক : প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাঙ্গুনিয়া সরকারি কলেজ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close