রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৬ আগস্ট, ২০২২

ফিরে দেখা

ইতিহাসের কালো অধ্যায়

আজ মানব ইতিহাসের একটি কালো দিন। ৭৫ বছর আগে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমায় এই দিনে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়। পারমাণবিক বিস্ফোরণে হিরোশিমায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ভয়াবহ এ হামলার সাত দশক পেরিয়ে গেলেও ভয়াল সেই দিনের কথা স্মরণে রেখেছে জাপানবাসী। স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে নিহতদের স্মরণ করা হয়। হিরোশিমা ও নাগাসাকি ট্র্যাজেডিতে বাংলাদেশের জনগণের সহমর্মিতাকে জাপান মূল্যায়ন করে বলে জানিয়েছেন দেশটির রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৫ সালের আজকের দিনে জাপানের হিরোশিমা নগরীর ওপর যুক্তরাষ্ট্র মানব ইতিহাসে প্রথম পারমাণবিক বোমাবর্ষণ করে। এর তিন দিন পর ৯ আগস্ট জাপানের অপর শহর নাগাসাকির ওপর দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমাবর্ষণ করা হয়। এতে প্রায় সোয়া দুই লাখ জাপানি নিহত হয়। এ ছাড়া আরো অনেকে তেজস্ক্রিয়তায় দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতার সম্মুখীন হয়। বিস্ফোরণটির কেন্দ্রস্থল অঞ্চলে সব কিছু তাৎক্ষণিকভাবে ছাই হয়ে যায় এবং মানুষের সিলুয়েটগুলো বেঁচে থাকা বাড়ির দেয়ালের ওপর থেকে যায়। অবিলম্বে বিভিন্ন অনুমান অনুসারে, সত্তর থেকে একশ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। এই বিস্ফোরণের পরিণতিতে আরো কয়েক হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল এবং ২০১৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত মোট হতাহতের সংখ্যা ২৯২,৩২৫ জন। বোমা হামলার অব্যাহিত পরে শহরটিতে কেবল আগুন জ্বালানোর জন্য নয়, তৃষ্ণায় মরে যাওয়া লোকদেরও পানির অভাব ছিল প্রচন্ড।

সম্ভবত সে কারণেই এখন পর্যন্ত হিরোশিমার বাসিন্দারা পানির বিষয়ে খুব যত্নশীল এবং স্মরণীয় অনুষ্ঠানের সময়, একটি বিশেষ অনুষ্ঠান কেনসুই (জাপানিদের থেকে জল উপস্থাপন করা) করা হয়, এটি শহরটিকে ঘিরে থাকা আগুনের কথা এবং ভুক্তভোগীদের যারা জল চেয়েছিল তার স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি বিশ্বাস করা হয় যে, মৃত্যুর পরও মৃতদের আত্মার দুর্দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পানির প্রয়োজন হয়। আজ থেকে ৭৬ বছরের বেশি সময় আগে এ রকম একটা দিনে পরমাণু বোমায় কেঁপে উঠেছিল জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি।

স্থানীয় সময় তখন সকাল ৮টা ১৫ মিনিট। আগেই নির্দেশনা দিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান। মার্কিন বি-টুয়েন্টি নাইন বোমারুবিমান থেকে হিরোশিমায় ফেলা হয় আণবিক বোমা ‘লিটল বয়’। বোমাটি প্রায় ৫০০ মিটার উঁচুতে বিস্ফোরিত হয়। এতে তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় দেড় লাখ মানুষ নিহত হয়। তখনও ঘুমের মধ্যেই ছিল বেশির ভাগ মানুষ। মাটির সঙ্গে মিশে যায় বেশির ভাগ স্থাপনা। ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় একটি নগরী। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বছর শেষে আরো ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আসল হামলার আগে ৪৯টি প্র্যাকটিস বোমা ফেলেছিল আমেরিকা। যাতে মৃত্যু হয়েছিল ৪০০ জনের। আহত হয় ১২০০।

জাপানের আসাহি শিমবুনের হিসাব অনুযায়ী, বোমার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগগুলোর ওপর হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য গণনায় ধরে হিরোশিমায় ২ লাখ ৩৭ হাজার এবং নাগাসাকিতে ১ লাখ ৩৫ হাজার লোকের মৃত্যু ঘটে। দুই শহরেই মৃত্যুবরণকারীদের অধিকাংশই ছিল বেসামরিক ব্যক্তি। জাপানের আত্মসমর্পণের পেছনে এ বোমার ভূমিকা এবং এর প্রতিক্রিয়া ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে অধিকাংশের ধারণা, এ বোমাবর্ষণের ফলে যুদ্ধ অনেক মাস আগেই সমাপ্ত হয়। যার ফলে পূর্বপরিকল্পিত জাপান আক্রমণ সংঘটিত হলে উভয়পক্ষের যে বিপুল প্রাণহানি হতো, তা আর বাস্তবে ঘটেনি।

অন্যদিকে জাপানের সাধারণ জনগণ মনে করে, এ বোমাবর্ষণ অপ্রয়োজনীয় ছিল, কেননা জাপানের বেসামরিক নেতৃত্ব যুদ্ধ থামানোর জন্য গোপনে কাজ করে যাচ্ছিল। বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তারের নেশায় কথিত পরাশক্তিগুলো প্রতিপক্ষ তথা মানুষ মারার নেশায় বুঁদ হয়ে তৈরি করে চলেছে শত শত কোটি ডলারের মারণাস্ত্র। কিন্তু বর্তমান করোনাভাইরাস মহামারির কাছে এসব যে কত তুচ্ছ তা টের পাচ্ছে মৃত্যু ও সংক্রমণের সংখ্যায় শীর্ষে থাকা আমেরিকা, কথিত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতসহ পরাশক্তির দাবিদার দেশগুলো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৯ সালে হিরোশিমাকে ঘোষণা করা হয় শান্তির শহর। নির্মিত হয় শান্তি স্মৃতি পার্ক। প্রতি বছরই শোক আর বেদনায় দিনটিকে স্মরণ করে বিশ্ব। সঙ্গে চলে যুদ্ধবিরোধী প্রচার। তার পরও থেমে নেই পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, অন্তত ৯ দেশের কাছে রয়েছে ৯ হাজার পরমাণু বোমা। কঠোর গোপনীয়তায় পরমাণু অস্ত্রের ভান্ডার-সমৃদ্ধ করা হচ্ছে। চলছে আরো বিধ্বংসী বোমা তৈরির পরিকল্পনা। যদিও যুদ্ধ নয় শান্তির বার্তা প্রচারেই অগ্রগামী বিশ্বের এসব ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনায়করা। হিরোশিমা ট্র্যাজেডির ৭৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে জাপানের রাষ্ট্রদূত আইটিও নাওকি বাংলাদেশের জনগণকে শান্তির বার্তা দিয়েছেন।

হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলে দেওয়ার ৭৫ বছর হয়ে গেছে। যেহেতু প্রতি বছর বেঁচে যাওয়া লোকের সংখ্যা কম হচ্ছে, তাই আমাদের সবার পক্ষে ট্র্যাজেডির কথা স্মরণ করা এবং আমরা যে শিক্ষাটি শিখেছি তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া আরো গুরুত্বপূর্ণ। হিরোশিমায় যে কারণ দেখিয়ে আণবিক বোমা হামলা হয়েছিল, আজকের দুনিয়ায় সন্দেহভাজন জঙ্গিদের মারতে একই যুক্তিতে ড্রোন হামলা চালানো হচ্ছে।

জাপানি ও আমেরিকানদের বাঁচাতে যেমন আণবিক বোমা ব্যবহার করা হয়েছিল, তেমনভাবেই জঙ্গি দমন করতে ড্রোন হামলা করা হয়। ড্রোন হামলায় কোনো মানুষ প্রয়োজন হয় না। মার্কিন সেনা কর্মকর্তাদের পাঠানো যায় না, এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিগুলোতেই ড্রোন ব্যবহৃত হয়। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে অন্তত ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। এর কারণ মানুষ ও সভ্যতাকে ধ্বংস করার লক্ষ্যেই এই হামলা চালানো হয়েছিল। ড্রোন নির্দিষ্টভাবে জঙ্গিদের লক্ষ্য করেই নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু এতে নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারায় না- এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। ড্রোনের আঘাতে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা আণবিক বোমা হামলায় মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করার কোনো সুযোগ নেই।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close