অলোক আচার্য

  ০৬ আগস্ট, ২০২২

বিশ্লেষণ

ওয়াশিংটন-বেইজিং সম্পর্কের টানাপড়েন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর কেন্দ্র করে শুরু থেকেই ব্যাপক উত্তেজনা তৈরি হয় উভয় দেশের মধ্যে। গত কয়েক বছরের মধ্যে দুই পরাশক্তির উত্তেজনা চরমে পৌঁছে যায়। বাণিজ্যযুদ্ধের সময় এবং করোনার উৎসস্থল নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয়েছে। কিন্তু এখন অবস্থা যুদ্ধাবস্থায় পৌঁছে যাওয়ার মতো। পেলোসির বিতর্কিত সফরের ঠিক আগে তাইওয়ান থেকে চীনা মূল ভূখন্ডে বিভক্তকারী সীমারেখায় চীন যুদ্ধবিমানও পাঠায়। চীনা বাহিনী ওই এলাকায় তাজা গোলাবারুদ ব্যবহার করে সামরিক মহড়াও চালিয়েছে। এই সফর যে চীনের একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না, তা জানান দিতেই এতকিছু। তাইওয়ান ইস্যুতে চীন বরাবরই এই অবস্থানে।

২৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দের চীনা একটি নথিতে প্রথমবারের মতো দ্বীপটির নাম দেখা যায়। সেই সময় একজন সম্রাট এই অঞ্চলটি আবিষ্কারের জন্য একটি অভিযাত্রী বাহিনী পাঠিয়েছিলেন। আর এই নথিকে বেইজিং তার আঞ্চলিক দাবির সমর্থনে ব্যবহার করে। ১৬২৪ সাল থেকে ১৬৬১ সাল পর্যন্ত উপনিবেশ হিসেবে সংক্ষিপ্ত ডাচ শাসনের অধীনে ছিল তাইওয়ান। এরপর ১৬৮৩ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত চীনের কিং রাজবংশ শাসন করে ওই অঞ্চল। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তার প্রশাসনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়তে থাকে। গত এপ্রিলে আমেরিকান পার্লামেন্টের ছয় সদস্য তাইওয়ান সফরে যান। চীন পেলোসির সফরের জন্য ওয়াশিংটনকে পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে হুশিয়ারিও দিয়েছে। চীনের হুমকি উপেক্ষা করেই গত মঙ্গলবার তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেইতে পৌঁছেন তিনি। ২৫ বছরের মধ্যে প্রথম কোনো মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তার তাইওয়ান সফর এটি।

চীনের এ সফর ঘিরে উত্তেজনার কারণ হলো চীনের কাছে তাইওয়ান কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র নয়, বরং একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল বলেই দাবি তাদের। অপরদিকে তাইওয়ানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই দেখে দেশটির জনগণ। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই তাইওয়ানকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে। সুতরাং দুই দেশের সম্পর্ক ভবিষ্যতে কতটা নমনীয় হবে, তা ভাবার বিষয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর নানা কারণে বিশ্বের উত্তেজনা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি এমন এক সময় যখন উন্নত দেশ থেকে শুরু করে প্রায় সব দেশই অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থা পার করছে। এক ইউক্রেন সমস্যা সামাল দিতেই বিশ্ব নেতৃত্ব হিমশিম খাচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত কার্যত কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না; সেখানে আরেকটি নতুন উত্তেজনা বিশ্বকে সত্যিই দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ‘এক চীন নীতি’ মেনে ওয়াশিংটন এতকাল তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক দূরত্ব বজায় রেখে এসেছে। কিন্তু এ সফর দুই দেশের উত্তেজনা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়েছে বলা যায়, যা ভবিষ্যৎ সমীকরণের জন্য বেশ কঠিনই হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে দুই দেশের বৈপরীত্য অবস্থান নতুন কিছু নয়।

করোনার উৎপত্তিস্থল থেকে শুরু করে এবং তার আগে থেকে চলা বাণিজ্যযুদ্ধ ও সেই সঙ্গে বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের কৌশল সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে চীন। সুতরাং উভয় দেশের মধ্যে রয়েছে প্রতিযোগিতা। বিশ্ব কোনোভাবেই এই প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। সেই সদিচ্ছাও আছে বলে মনে হয় না। আগ্রাসী মনোভাবের কারণে বিশ্বকে বহুবার পুড়তে হয়েছে। অথচ করোনা মহামারির সময় সারা বিশ্বের একত্রিত হওয়া খুবই প্রয়োজন ছিল। যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, আধিপত্য বিস্তারের কৌশল, জোট পরিকল্পনা প্রভৃতি সবকিছুই সমানতালে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। শুরু হয়ে যায় দুদেশের বাণিজ্যযুদ্ধ। বাণিজ্যযুদ্ধ, সামরিক প্রতিযোগিতা প্রভৃতি মিলিয়ে তৈরি হয় উত্তেজনা। সেই উত্তেজনা আজও চলছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেই উত্তেজনা আরো তীব্র হচ্ছে। এই চলমান দ্বন্দ্বকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দ্ইু পরাশক্তি। রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার কঠিন সম্পর্ক পৃথিবীতে দুটি বলয়ে ভাগ করেছে। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে সবসময় একটি উত্তেজনার অবস্থা বিরাজ করে। দুই দেশই পরাশক্তি এবং কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। ক্ষমতার প্রশ্নে বা প্রভাব বিস্তারের প্রশ্নে আপস করা প্রায় সময়ই কঠিন হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার এই টানাপড়েন শীতলযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে বলেও অনেকে মত দিয়েছেন। শীতলযুদ্ধ বা ¯œায়ুযুদ্ধ সম্পর্কে পৃথিবী জ্ঞাত। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার ¯œায়ুযুদ্ধের কথা আজও স্মরণে আছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন দুই দেশই ছিল সেসময় বিশ্বে দুই পরাশক্তি।

গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র মতবাদে বিভক্ত দুই পরাশক্তির এই ¯œায়যুদ্ধের ব্যাপ্তিকাল ছিল চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে আশির দশক পর্যন্ত। আজ যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে যে বিভেদ সেখানেও দুই পরাশক্তির মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে বলা যায়। বাণিজ্যবিরোধ ছিল বিরোধের শুরু। এরপর মতভেদ বাড়তে থাকে। বিশ্ব নেতৃত্বে কে থাকবে বা আগামী শতাব্দীর নেতৃত্ব কে দেবে, তার জন্য যেন প্রস্তুতি নিচ্ছে বিশ্ব! যদিও বিশ্ব এখন একক কর্তৃত্ব করার সুযোগ হারিয়েছে। এখন বিশ্ব জোটের অন্তর্গত থাকতে পছন্দ করে। সমমতবাদে বিশ্বাসী দেশগুলো জোট গড়ে তোলে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউক্রেনকে অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে নিয়মিতভাবে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণমাত্র নেই। বিভিন্ন দেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভুগছে। বেকারত্ব, খাদ্য সংকট বেড়েই চলেছে। অনেক দিন অবরুদ্ধ থাকার পর সম্প্রতি ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য নিয়ে জাহাজ ছাড়তে শুরু করেছে। পৃথিবীজুড়ে বহু বছর ধরে আধিপত্য বিস্তার করে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটাই এত দিনের দৃশ্যত চিত্র। বলাই বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে মার্কিন প্রযুক্তি, শক্তিশালী আর্থিক ভিত্তি এবং দক্ষ রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে প্রভাব বিস্তারের প্রধান নিয়ামক যে ক্ষমতাই, তা আজ না বোঝালেও চলবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন- এসব দেশ নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে মরিয়া। এই আধিপত্য ধরে রাখার প্রতিযোগিতা আজ থেকে শুরু হয়নি।

প্রথম শিল্পবিপ্লবের পর থেকে বিভিন্ন দেশ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলে। সেই সঙ্গে প্রযুক্তির বিকাশ সাধনের ফলে নতুন নতুন মারণাস্ত্র আবিষ্কার করে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে তারা। সেই সময়ে এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলো তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে ছিল। প্রথম দিকে এসব খুব বেশি প্রভাব বিস্তার না করলেও ধীরে ধীরে শক্তিমত্তার বিস্তার ঘটতে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি নিত্যনতুন অস্ত্র আবিষ্কারের শুরু সেই তখন থেকেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের। এখন রাশিয়া ও চীন এ ক্ষেত্রে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। গত কয়েক বছরে চীন তাই বিশ্বের পরাশক্তির কাতারে। যার ফলে কৌশল হিসেবে মিত্রদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে নিজ বলয়ের প্রভাব অক্ষুণœ রাখার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন এসব ছাড়িয়ে চীনের আধিপত্য বেশি লক্ষণীয়। চীনের পৃথিবীব্যপী পণ্যের বিশাল বাজার, যা চীনের অর্থনীতিকে ক্রমেই শক্তিশালী করছে, বাড়িয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। এই চলমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেই পেলোসির এই বিতর্কিত সফর দুই দেশের সম্পর্ককে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়, তাই দেখার বিষয়। তবে একথা বলা যায় যে, লক্ষণ কোনোভাবেই শুভ নয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close