আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা

  ০৩ আগস্ট, ২০২২

দৃষ্টিপাত

গ্রেট গ্রিন ছাদ উদ্যান নগরী

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মসজিদের শহর নামে সুপরিচিত হলেও বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা শহর এখন তলানিতে। এ শহরের আয়তন ৩০৬ বর্গকিলোমিটার, কিন্তু বর্তমানে এ শহরের জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি। যান্ত্রিক যানবাহন ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে বায়ু এবং শব্দদূষণে নাকাল নগরবাসী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসহনীয় পর্যায়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি। বেশ কিছুদিন থেকেই রাজধানী ঢাকা ও রাজশাহীতে প্রায় মরুভূমির মতো তাপমাত্রা অনুভূত হচ্ছে। অপ্রতুল গাছপালা ও জীবাশ্ম জ্বালানি অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহার এই তাপমাত্রাকে আরো অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে বলা আছে, একটি ভূখণ্ডের মোট ভূমির ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে মোট বনভূমির পরিমাণ শতকরা ১৬ শতাংশেরও কম। আর ঢাকা শহরকে আলাদা একটি ভূখণ্ড ধরা হলে শতকরা আয়তনের ২ শতাংশ জায়গায় বৃক্ষের অস্তিত্ব আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। ঢাকা শহরে বায়ুদূষণ মাঝে মাঝে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে মনে হয় এখানে অক্সিজেন নেই। বায়ুদূষণের জন্য দায়ী যান্ত্রিক যানবাহনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না নেওয়া।

এ ছাড়া রাজউকের মতো দায়িত্বশীল সংস্থা থাকতে এখনো ঢাকা শহরে বিশাল জনসংখ্যার তুলনায় খোলা জায়গা, মাঠ, পার্ক, জলাধারের মতো গণপরিসর প্রায় নেই বললেই চলে। এ শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলেই দেখা যায় ভবনগুলো গ্লাসে মোড়ানো ও গায়ে গায়ে লেগে রয়েছে। দুই ভবনের মধ্যে যতকুটু ব্যবধান থাকার কথা তা নেই। যার ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে মানুষের অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই অসহনীয় তাপমাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব, কিন্তু তার জন্য দরকার রাষ্ট্রের বাস্তবিক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। জলাধার, উদ্যান ও ছাদে বাগান তৈরি, সংরক্ষণ এবং উন্নয়ন করে অসহনীয় পর্যায়ের তাপমাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব। এজন্য শুধু দরকার রাজনৈতিক সদ্বিচ্ছা।

ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক উদাহরণও রয়েছে। যে কর্মসূচি গ্রহণ করে সফল হয়েছে গণচীন। হাজার বছর আগে চীন তৈরি করেছিল পৃথিবীর প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের একটি, যা চীনের মহাপ্রাচীর নামে সুপরিচিত। আর এখন হাজার বছর পর তৈরি করছে মানবসৃষ্ট এক আশ্চর্য, যা গ্রেট গ্রিন ওয়াল নামে পরিচিত। যা এর আগে কেউ কখনো দেখেনি ও শুনেওনি। সারা বিশ্বেই যখন প্রতিদিনই কমছে অরণ্যের পরিমাণ, তখন গণচীন একটা আস্ত মরুভূমিকে বনভূমিতে পরিণত করার মহাকর্মযজ্ঞ ১৯৭৮ সালে হাতে নিয়েছে এবং বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে বন্ধ্যা ভূমিকে বদলে দিয়েছে সবুজ অরণ্যে। গাছ লাগিয়ে অসাধ্যকে সাধন করেছে, আগে যা ছিল মরুভূমি, এখন তা ঘন সবুজ বন। দেশপ্রেম থাকলে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়, চীনের জনগণ ও সরকার তা দেখিয়ে দিয়েছে।

উত্তর চীনের সঙ্গে মঙ্গোলিয়ার সীমান্তেই মাওয়ুসু ডেসাট ছিল মরুভূমি। কয়েক দশকের কঠোর পরিশ্রমের পর চীনের ম্যাপ থেকে উধাও হয়ে গেছে আস্ত মরুভূমি। এখন সেই মরুভূমির বেশির ভাগ এলাকাই সবুজে ঢেকেছে। অনেক প্রতিকূলতা বিবেচনায় নিয়ে চীন মরুভূমিকে বনভূমিতে রূপান্তরিত করেছে। চীনের উলিন টাউনের পাশে এই মরুভূমি থাকার কারণে বেশ সমস্যা হতো শহরবাসীর। মাঝেমধ্যেই মরুঝড়ে বালিতে ভরে যেত শহর। এর ফলে তিনবার উলিন শহরকে জায়গা ছেড়ে সরে যেতে হয়েছিল। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হয়নি। তাই চীন সরকার মরু বাস্তুতন্ত্র পাল্টাতে পরিকল্পনা হাতে নেয় এবং স্থানীয় মানুষের সহয়তায় মরুভূমিতে গাছপালা লাগানোর কাজ শুরু করে। কয়েক দশক ধরে সেই কাজ চলতে থাকলে একসময় বালির দেশ পরিণত হয় মরূদ্যানে।

জলবায়ু বিপর্যয় রোধ ও কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণ কমিয়ে আনতে Shelter Forest Program Project ৩৫ মিলিয়ন হেক্টর মরুভূমির বুকে এই বনভূমি তৈরি করে। এ রকম আস্ত মরুভূমিকে বনভূমিতে রূপান্তর করার কাণ্ড আগে কেউ চিন্তাও করতে পারেনি। যেখানে আবহাওয়া স্বাভাবিক, সেখানে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে প্রতিবন্ধকতা পোহাতে হয়। আর সেখানে মরুভূমির বুকে বনায়ন কর্মসূচি কতটা চ্যালেঞ্জ হতে পারে তা কল্পনাও করা যায় না। সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকলেও চীন ঝুঁকি নিয়ে ছিল মরুভূমির বুকে সবুজ বনায়ন করার জন্য। চীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় Three Not Shelter Forest Program যাকে বলা যায় বালির বুকে সবুজ বিপ্লব। চীন মরুভূমির বুকে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগতভাবে ৮ মিলিয়ন গাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে এবং কর্মসূচি সফল করতে প্রণোদনা দেওয়া হয়। পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। যে এলাকায় বনভূমির পরিমাণ ১৯৭৮ সালে ছিল মাত্র ৫ শতাংশ, সেখানে ২০২১ সালে বনভূমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ শতাংশ। ২০৫০ সালের মধ্যে মরুভূমিকে সবুজ বনায়নের টার্গেট নিয়েছে গণচীন।

ঢাকা শহরের এই অসহনীয় পর্যায়ের তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে এবং সুন্দর শহর করতে পারে ব্যক্তিগত যান্ত্রিক যানবাহনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং রাজধানী ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। বিশেষ করে ছাদবাগান তৈরির কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যেহেতু রাজধানী ঢাকার লাখ লাখ বাড়ি ও ভবনের ছাদগুলো খালি পড়ে আছে, অসহনীয় তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে আনতে ছাদবাগান ও বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, এজন্য সরকারি প্রণোদনা দরকার। চীন মরুভূমিকে বিরাট প্রতিকূল পরিবেশে সবুজ বনে রূপান্তরিত করার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমরা কেন স্বাভাবিক পরিবেশে বৃক্ষরোপণ ও ছাদবাগান তৈরি করে অসহনীয় পর্যায়ের তাপমাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে আনতে পারব না?

বৃক্ষরোপণ কার্যক্রমের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকা শহরের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমিয়ে আনা সম্ভব হবে, যা বাসযোগ্য নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। রাজধানী ঢাকাও হতে পারে মানবসৃষ্ট এক আশ্চর্য গ্রেট গ্রিন ছাদ উদ্যান নগরী। পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যা বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে। পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন না করা হলে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে। বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণের চিকিৎসাসেবা দিতে রাষ্ট্র হিমশিম খাচ্ছে। তাই জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমাতে পরিবেশ উন্নয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। এজন্য কল্যাণরাষ্ট্রকে পরিবেশ উন্নয়নের স্বার্থে ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানাই।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close