রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৩ আগস্ট, ২০২২

বিশ্লেষণ

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রথম বিশ্ব

পৃথিবীর জলবায়ু যেভাবে বদলে যাচ্ছে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অবস্থা ভয়ানক রূপ নেবে। যেসব এলাকা বেশি ঝুঁকির ভেতর থাকবে, সেসব এলাকার মাথাপিছু জিডিপি এখনকার তুলনায় অনেক কমে যাবে। দেশের পাহাড়ি অঞ্চলগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির ভেতর পড়বে। পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই জলবায়ু সম্পর্কে তেমন বেশি সচেতন না। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তন প্রসঙ্গ উপেক্ষা করার উপায় নেই। তবু বিশ্বনেতাদের অনেকে বিষয়টি পাশে ঠেলে রাখতে চান। তাদের কারণে জাতিসংঘ জলবায়ু তহবিলের আকার সন্তোষজনক হচ্ছে না; জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

তথ্য মতে, এমন দাবদাহ শুধু বাংলাদেশেই নয়, প্রায় অর্ধেক পৃথিবীজুড়েই বিরাজ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল যেন কারখানার ব্রয়লার চেম্বারের মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দিনে দিনে। টানা দুই সপ্তাহ ধরে তীব্র দাবদাহ, দাবানল আর খরায় পুড়ছে পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি অঞ্চল। আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে ভারত মহাসাগর অবধি আবহাওয়ার ওই অস্বাভাবিক অসহনীয় উষ্ণ আচরণে বিপন্ন হয়ে পড়েছে প্রাণিজগৎ। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশে গত দুই দিনে স্বাভাবিকের চেয়ে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি ছিল। ১৯৪৮ থেকে ২০২২ সালের আবহাওয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করলে ৭০ থেকে ৭৪ বছরের ইতিহাসে চলতি জুলাই মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

বিশ্বের আবহাওয়া বিষয়ক সংস্থাগুলো বলছে, বিশ্বের অর্ধেকের বেশি এলাকাজুড়ে এখন তীব্র দাবদাহ বইছে। ইউরোপ থেকে শুরু করে চীন, মধ্যপ্রাচ্য, ইরান, ভারত, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়াজুড়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’ ১৫ জুলাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাপপ্রবাহের একটি মানচিত্র প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, স্পেনের সেভেলি শহরের তাপমাত্রা উঠেছে ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস; ইরানের আহভাজ শহরের তাপমাত্রা উঠেছে ৪৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং চীনের সাংহাই শহরের তাপমাত্রা উঠেছে ৩৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ বড় শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ছিল। তীব্র দাবদাহে ব্রিটেনে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে সরকার। তাপ বৃদ্ধির কারণে এবারই প্রথম ব্রিটেনে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি ঘোষণা করা হয়েছে।

অন্যদিকে, ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে প্রবল বাতাস এবং চরম শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে দাবানল ছড়িয়ে যাওয়ার ফলে জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ফ্রান্সের অনেক স্থানীয় বাসিন্দা বিভিন্ন শহর ও গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। গত কয়েক দিনে ১০ হাজারেরও বেশি লোক ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিহাদ অঞ্চল ছেড়ে অন্যত্র আবাস গড়েছে। ফ্রান্স, পর্তুগাল এবং স্পেনের বেশ কয়েক জায়গার দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। সেখানে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠে গেছে। তাপপ্রবাহে পর্তুগাল এবং স্পেনে অন্তত ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। পশ্চিম স্পেনের বেশ কয়েকটি শহরের মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্পেনে অস্বাভাবিকভাবে উচ্চ তাপমাত্রা ৪৫.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছেছে। পর্তুগালের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। উত্তরের পিনহাওতে ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। এটি পর্তুগালের মূল ভূখণ্ডে জুলাই মাসের জন্য সর্বোচ্চ তাপের রেকর্ড।

গত সপ্তাহে বাণিজ্যিক শহর সাংহাইয়ে তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ১৮৭৩ সালের পর শহরটিতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এটি। প্রচণ্ড গরমে কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে ভারতের রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, ওডিশা, ছত্তিশগড় ও অন্ধ্রপ্রদেশের বেশির ভাগ শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, গত কয়েক যুগের মধ্যে ভয়াবহ দাবদাহ ও খরায় পুড়ছে পূর্ব আফ্রিকা। এই খরা গত বছর শুরু হয়ে এখনো চলছে। চার মৌসুম পরও সেখানে বৃষ্টির দেখা নেই। এ অঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষ চরম অনাহারে রয়েছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভারতীয় মহাসাগরের স্রোতের সঙ্গে সম্পর্কিত বসন্তকালীন বৃষ্টি এ অঞ্চলে পৌঁছানোর আগেই সমুদ্রে ঝরে পড়ছে, যার কারণে বৃষ্টি হচ্ছে না ভূমি অঞ্চলে। ইতালিতে খরার কবলে পড়ে দেশের উত্তরে অবস্থিত ‘পো’ নদীর পাশের পাঁচটি অঞ্চলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে ইতালি। বলা হচ্ছে, ৭০ বছরের মধ্যে এটি দেশটির সবচেয়ে ভয়াবহ খরা। এদিকে বিশ্বের অধিকাংশ সমুদ্রসীমায় আবহাওয়ার ওই অস্বাভাবিক আচরণে এর পাশের এলাকাগুলোতে শুরু হয়েছে তীব্র দাবদাহ। বাংলাদেশেও এর প্রভাব বাড়ছে। শ্রাবণে মেঘের দেখা নেই আকাশে। ভরা শ্রাবণে চলছে খরা। বৃষ্টি খরায় বিপর্যস্ত মানুষ। তীব্র রোদে হাঁসফাঁস নগর জীবন। রোদের প্রখরতায় থমকে যাচ্ছে জীবনযাত্রা। বর্ষার আকাশে যেন বৈশাখী অনুষঙ্গ। গুমট হয়ে ওঠে পরিবেশ, রাতেও ভ্যাপসা গরম। এমন অবস্থায় জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। আবহাওয়াবিদরা বলেন, প্রতি বছরই তিন-চারটি তাপপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। তবে এবারের জুলাই মাসের তাপপ্রবাহ দীর্ঘস্থায়ী আর অনেক শক্তিশালী। এর প্রভাব পুরো পৃথিবীজুড়ে। গত ৫ জুলাই থেকে তাপপ্রবাহ চলছে, বৃষ্টির ঘনঘটা কম, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি, আকাশ মেঘমুক্ত একই সঙ্গে প্রখর সূর্যকিরণ।

সব মিলিয়ে অসহনীয় অবস্থা। বৃষ্টির জন্য ২০ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। ভারী বৃষ্টি ছাড়া গরম কমবে না। দুই দিন পরেও ভারী বৃষ্টিপাত হবে কি-না সেটাও নিশ্চিত না। কয়েক বছরের তুলনায় এবারের দাবদাহ অনেক তীব্র, অনেক শক্তিশালী। তীব্র এই দাবদাহ থেকে মুক্তি মিলবে ভারী বর্ষণ হলে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এ ধরনের উত্তপ্ত অবস্থা থেকে আপাতত পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই। শিল্প যুগ শুরু হওয়ার পর থেকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা এর মধ্যেই প্রায় ১ দশমিক ১ সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। বিশ্বে উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ। এটি দ্রুত হ্রাস করতে না পারলে তাপমাত্রা বাড়তেই থাকবে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্বে উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুটি কারণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কারণগুলো বহুল পরিসরে দায়ী।

এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পথ একটিই। আর তা হলো, কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ‘জিরো’ প্রবৃদ্ধিতে নামিয়ে আনতে হবে আজকের মাত্রাকে ভিত্তি ধরে। তাদের অমানবিক আচরণ করা উচিত নয়। বর্তমানে জলবায়ুর যে হাল, তা আর এক শতাব্দী চললে পৃথিবীতে ধনীরাও বাঁচতে পারবে না। সত্যি বলতে কী, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মূলত মানুষ দায়ী। দেশে-বিদেশে নগরায়ণ ও শিল্পায়নের নামে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে গাছপালা, জলাশয়, নদী-নালা, খাল-বিল। বিশ্বজুড়ে প্রতিনিয়ত নগরায়ণে ও শিল্পায়নে ধ্বংস করা হচ্ছে প্রকৃতির বৈচিত্র্যময়তা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নয়, তার আগেই মানুষ বিপর্যয়ে পড়বে। নগরী দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে গাছপালা, কৃষিজমি, জলাশয় আর জীববৈচিত্র্য। এসব কারণেই জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন ঘটে চলছে। জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলার ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে এখনই অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করতে হবে। গাছপালা, জলাশয়, নদী-নালা, খাল-বিল যা কিছু আছে- ঠিক রাখতে হবে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে পারলেই জলবায়ু ঠিক রাখা সম্ভব। অন্যথায় অনাগত দিনগুলো পৃথিবীর মানুষের জন্য যে ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভরসা করে যে শিল্পযুগের সৃষ্টি হয়েছে, তার দ্বারা সৃষ্ট উষ্ণায়ন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কম দায়ী নয়। তাই উষ্ণায়ন মোকাবিলায় বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে উন্নত দেশগুলোকে। গত ২০০ বছরে ওই দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি দূষণ ছড়িয়েছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে। অ্যান্টার্কটিকায় হিমবাহের স্তর গলছে, বাড়ছে সমুদ্রের পানির স্তর। পরিবেশবিদরা জানাচ্ছেন, জলবায়ুর এই খামখেয়ালির পেছনে রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে প্যারিসে ১৯৬টি দেশ সমবেত হয়ে একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছিল। এতে বলা হয়েছিল, পৃথিবীর তাপমাত্রা যেন বর্তমানের চেয়ে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না বাড়ে। সেটা নিশ্চিত করাই হোক বিশ্বের লক্ষ্য। আমাদেরও সে লক্ষ্যেই কাজ করতে হবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close