দিলীপ কুমার আগরওয়ালা
মুক্তমত
দেশের স্বার্থেই বাড়াতে হবে রপ্তানি আয়
একের পর এক চমক দেখাচ্ছে দেশের রপ্তানি খাত। চলতি বছরের রপ্তানি আয়ে বেশ কটি মাইলফলক অর্জন করেছে বাংলাদেশ। করোনাভাইরাসের পর রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ঘোরতর করে তুলছে। ঠিক এমন সময় বন্যার ছোবল মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। এ দুঃসময়ে সুখবর হয়ে আবির্ভূত হয়েছে দেশের রপ্তানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছোঁয়ার ঘটনা। কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ যে হারবে না সে বিষয়টি স্পষ্ট করেছে রপ্তানি আয়ের টার্গেট অতিক্রমের ঘটনা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের মতে, করোনা মহামারির পর ইউক্রেন যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে রপ্তানি আয় যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছুঁয়েছে তা একটি বড় অর্জন। সরকার রপ্তানি বাড়াতে বিভিন্ন নীতিমালা গ্রহণ ও আর্থিক প্রণোদনা অব্যাহত রেখেছে। দেশের উদ্যোক্তারাও সে সুযোগ গ্রহণ করে রপ্তানি আয় বাড়াতে সহায়তা করছেন। এ ছাড়া নতুন পণ্য নতুন বাজারে পৌঁছানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক মিশনকে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫১ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার এবং সেবা খাত থেকে ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের টার্গেট ছিল। এর মধ্যে অর্থবছরের ১১ মাসে দেশ থেকে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৪৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের। চলতি মাসের আয় যুক্ত হলে এটি ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। সেবা খাতসহ চলতি বছরের রপ্তানি আয় ৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে পৌঁছাতে পারে। টাকার হিসাবে এ অর্থের পরিমাণ ৫ লাখ ৪২ হাজার ৩০০ কোটি।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরেকটি প্রধান উৎস রেমিট্যান্স আয়। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক না হলেও বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও তা যে কমেনি এটি একটি সান্ত¡না। দেশের রপ্তানি আয় বিপুলভাবে বাড়লেও একই সঙ্গে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। বিশেষত মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি খাতে ব্যয় বাড়ছে দ্রুত হারে। ফলে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স দুই খাতকে আরো সক্রিয় রাখতে হবে জাতীয় স্বার্থেই।
২০৪১ সাল নাগাদ একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার রূপকল্প বাস্তবায়নের জন্য আরো শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার ২০ শতাংশ ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে সম্পৃক্ত হতে হবে। এটি অসম্ভব নয়, যদি আমরা অর্থনীতির চালিকাশক্তি পোশাকশিল্পের অগ্রযাত্রার পথ সুগম করতে পারি। অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের অন্যতম প্রধান খাত পোশাক ও বস্ত্রশিল্প। সামষ্টিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ শিল্পের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
অর্থমূল্য বিবেচনায় বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া শীর্ষ তিন পণ্য পোশাক, পাট ও পাটজাত এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানির ৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ জুড়েই ছিল পণ্য তিনটি। এ আধিপত্য বজায় রয়েছে চলতি অর্থবছরেও। তবে মোট রপ্তানিতে বড় অবদান রাখা পণ্যের তালিকায় যুক্ত হয়েছে হোম টেক্সটাইল। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাস শেষে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ, হোম টেক্সটাইল ৪১ দশমিক ৩ এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিও বেড়েছে ৩১ দশমিক ৮৪ শতাংশ। পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে পোশাক রপ্তানির অর্থমূল্য ছিল ৩ হাজার ৮৫২ কোটি ১১ লাখ ৬০ হাজার ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ২ হাজার ৮৫৬ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার ডলারের। এ হিসাবে রপ্তানি বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ। মোট রপ্তানির ৮১ দশমিক ৬৫ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক। হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে হয়েছে ১৪৬ কোটি ৭১ লাখ ৯০ হাজার ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ১০৩ কোটি ৮৩ লাখ ৬০ হাজার ডলারের। এ হিসাবে হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের বছরেই দেশের রপ্তানি প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ানোর বিষয়টি একটি প্রতীকী ঘটনা, যা উদীয়মান রপ্তানি কেন্দ্র হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে বিশেষ বার্তা বহন করছে। জাতীয় উন্নয়নে রপ্তানি খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে গত এক দশকে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি অনেক আশাব্যঞ্জক। মাঝে কোভিডের কারণে দুই বছরের সংকট না হলে এত দিনে রপ্তানি ৮০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি চলে যেত। সে হিসেবে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত এ পর্যন্ত যথেষ্ট ভালো করেছে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি যেসব খাতে রপ্তানি বেড়েছে, সেগুলোর দিকে যেমন নজর দিতে হবে; তেমনি এর পাশাপাশি সম্ভাবনাময় খাতগুলোর দিকেও সার্বিক পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : পরিচালক, এফবিসিসিআই
ঢাকা, বাংলাদেশ
"