মো. আরাফাত রহমান
ফিরে দেখা
হজের ইতিহাস গুরুত্ব ও তাৎপর্য
হজ ইসলামের পাঁচটি আরকান বা স্তম্ভের পঞ্চমটি। হজের আভিধানিক অর্থ ‘কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা করা’, ‘সংকল্প করা’ বা ‘চক্রাকারে প্রদক্ষিণ করা’। শরিয়তের পরিভাষায় নির্দিষ্ট মাসের নির্দিষ্ট সময়কালে কাবা ঘর প্রদক্ষিণ, আরাফাত ময়দানে অবস্থান, সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে গমনাগমন, মিনায় অবস্থান প্রভৃতি কার্য হজরত মুহাম্মাদ (সা.) কর্তৃক নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় সম্পাদন করার নামই হজ। পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত হয়েছে যে, পৃথিবীতে আল্লাহতায়ালার ইবাদতের জন্য নির্মিত প্রথম ইমারত হচ্ছে মক্কার পবিত্র কাবা, যা ‘বায়তুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর ঘর’ নামে অভিহিত।
আল্লাহ হজরত ইব্রাহিমকে (আ.) আদেশ দেন : ‘আমার গৃহকে পবিত্র রেখো তাদের জন্য যারা তাওয়াফ করে এবং যারা সালাত-এ দাঁড়ায়, রুকু করে ও সিজদা করে। এবং মানুষের কাছে হজের ঘোষণা করে দাও, ওরা তোমার নিকট আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার দ্রুতগামী উটের পৃষ্ঠে, ওরা আসবে দূর-দূরান্তরের পথ অতিক্রম করে।’ এই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে হজরত ইব্রাহিম (আ.) সর্বপ্রথম কাবাকে কেন্দ্র করে হজের প্রবর্তন করেন।
হজের বর্তমান প্যাটার্নটি মুহাম্মাদ (সা.) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে কোরআন থেকে হজের উপাদানগুলোই ব্রাহিমের (আ.) সময় পাওয়া যায়। ইসলামি ঐতিহ্য অনুসারে, ইব্রাহিম (আ.) তার স্ত্রী হাজেরা ও তার পুত্র ইসমাইলকে প্রাচীন মক্কার মরুভূমিতে একা রেখে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পানির সন্ধানে এক দিন হাজেরা মরিয়া হয়ে সাফা ও মারওয়ার দুটি পাহাড়ের মধ্যে সাতবার দৌড়ে কিছুই পেলেন না। হতাশায় ফিরে ইসমাইলের দিকে এসে দেখতে পেলেন যে, শিশুটি তার পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করছে এবং তার পায়ের নিচে একটি পানির ঝরনা প্রবাহিত হয়েছে।
পরে আল্লাহতায়ালা ইব্রাহিমকে কাবা তৈরি করার এবং লোকদের সেখানে হজ আমন্ত্রণ করার আহ্বান জানান। কোরআনে এ ঘটনাগুলোর উল্লেখ রয়েছে। জিবরাইল কাবার সঙ্গে সংযুক্তির জন্য জান্নাত থেকে হাজরে আসওয়াদ পাথর এনেছিলেন। হযরত ইব্রাহিমের আহ্বানে লোকরা মক্কায় হজ সম্পাদন করার জন্য আসতে থাকে। তিনি ও পুত্র ইসমাইল (আ.) কাবা ঘর পুনর্নির্মাণ করেন। তখন থেকে প্রতি বছর বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন কাবা শরিফে হজের নিমিত্ত সমবেত হতে থাকে। পরে একপর্যায়ে কাবায় ৩৬০টি দেবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আল্লাহর পরিবর্তে তাদের ইবাদত চলতে থাকে। সেই সঙ্গে নানা অন্যায় ও অশালীন অনুষ্ঠানও উদযাপিত হতে থাকে।
এসব কারণে নবম হিজরিতে হজরত মুহাম্মাদ (সা.) হজ পালন করতে যাননি; আবু বকর (রা.)-এর নেতৃত্বে তিন শ সাহাবির একটি দল পাঠানো হয়। দশম হিজরিতে নবী করিম (সা.) স্বয়ং হজের নেতৃত্ব দেন। হজ কীভাবে পালন করা উচিত তা তিনি এই হজে নির্দিষ্ট করে দেন। এ বছর হজ জিলহজ মাসে সম্পন্ন হয়। ইতিহাসে এই হজ ‘বিদায়ি হজ’ নামে অভিহিত। এ বছর থেকেই ‘নাসি’ প্রথার বিলোপ সাধন করে খাঁটি চান্দ্র বছরের প্রচলন হয় এবং জিলহজোর কয়েকটি দিন হজের সময় হিসেবে নির্ধারিত হয়। হজ হলো মুসলিম জনগণের সংহতি এবং আল্লাহর কাছে তাদের আনুগত্যের প্রদর্শনী।
হজ মুসলমানদের জন্য ফরজ। শরিয়ত অনুযায়ী নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জীবনে অন্তত একবার হজ করা অবশ্য কর্তব্য, যদি তার পক্ষে সম্ভম হয়। হজ পালনের শর্ত হলো : প্রাপ্ত বয়স, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, আর্থিক সচ্ছলতা, পথের নিরাপত্তা এবং ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষণের নিশ্চয়তা। মহিলাদের ক্ষেত্রে স্বামী বা অবিবাহযোগ্য কোনো আত্মীয়কে সহযাত্রী করা আবশ্যক।
জীবদ্দশায় হজ করতে পারেনি এমন ব্যক্তি বদলি হজের ওয়াসিয়াত করতে পারেন। তিনি মারা গেলে তার সম্পত্তি থেকে কাফন-দাফনের খরচ ও তার ঋণ থাকলে তা পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে তার এক-তৃতীয়াংশ দ্বারা হজের ব্যয় নির্বাহ সম্ভব হলে ওয়ারিশদের ওপর তার পক্ষে হজ করা ওয়াজিব হয়। হজের ফরজ হলো : ইহরাম; আরাফাতে ওয়াকুফ ও তাওয়াফ আল-ইফাদা, যা ১০, ১১ বা ১২ জিলহজ তারিখে করা হয়, তবে প্রথম দিবসেই এটি সম্পন্ন করা শ্রেয়। উপর্যুক্ত ফরজ কাজগুলো নিয়মানুযায়ী পরপর সমাধা করতে হয়।
হজের ওয়াজিব হলো : মুযদালিফায় উকুফ, সায়ি, মিনায় পাথর নিক্ষেপ, হালক বা কেশ মু-ন অথবা তা কশির বা কেশ ছোট করা এবং কিরান ও তামাত্তু বা কোরবানি করা। ইহরাম, তাওয়াফ ও উকুফ-সংক্রান্ত আরো কিছু কাজ ওয়াজিব বলে বিবেচিত হয়। হজ তিন প্রকারে সম্পন্ন করা যায় : ইফরাদ, অর্থাৎ শুধু হজের ইহরাম করা ও ওমরাহ ছাড়া হজ করা; কিরান, অর্থাৎ ওমরাহ ও হজের ইহরাম একসঙ্গে করা যেখানে ওমরাহ সম্পাদন করে পরে হজ করতে হয়; তামাত্তু, অর্থাৎ প্রথমে শুধু ওমরাহর ইহরাম করা ও ওমরাহ শেষে ইহরাম থেকে মুক্ত হওয়া এবং পরে আবার হজের ইহরাম করা ও হজ সম্পাদন করা। হজের অনুষ্ঠানগুলো পবিত্র পরিবেশ ও অবস্থার মধ্যে সম্পন্ন করতে হয় বিধায় ইহরাম অপরিহার্য।
মক্কা থেকে দূরে যাদের বাড়ি তাদের মক্কা যাওয়ার পথে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে সেখানেই ইহরাম সম্পন্ন করতে হয়। এই নির্দিষ্ট স্থানকে বলা হয় ‘মিকাত’। হজের দিন ছাড়া অন্যদিন গেলে ওমরাহ বা ছোট হজ পালন করতে হয়। ওমরাহর জন্য কোনো দিন-তারিখ নির্দিষ্ট নেই। কাবা ঘরে সাতবার তাওয়াফ এবং সাফা ও মারওয়ায় সাতবার সাঈ সম্পন্ন হলেই ওমরাহ সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি বছর লক্ষাধিক মুসল্লি হজ পালন করার জন্য বিমানযোগে মক্কায় যান।
হজ পালনকারীরা মুসলিম সমাজে বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে বিবেচিত হন। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ করে এবং অশ্লীল ও গোনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকে, সে হজ থেকে এমতাবস্থায় ফিরে আসে যেন আজই মায়ের গর্ভ থেকে বের হয়েছে। অর্থাৎ জন্মের পর শিশু যেমন নিষ্পাপ থাকে, সেও তেমন নিষ্পাপ হয়ে যায়।’ আরেকটি হাদিসে তিনি বলেছেন, ‘শয়তান আরাফার দিন থেকে অধিক লজ্জিত ও অপদস্থ আর কোনো দিন হয় না, কেননা ওই দিন আল্লাহতায়ালা স্বীয় বান্দার প্রতি অগণিত রহমনও বর্ষণ করেন ও অসংখ্য কবিরা গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘একটি বিশুদ্ধ ও মকবুল হজ সমগ্র পৃথিবী ও পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর চেয়ে উত্তম। বেহেস্ত ছাড়া অন্য কোনো বস্তু তার প্রতিদান হতে পারে না।’
ফিকহ শাস্ত্রে হজের আচার-অনুষ্ঠানের বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে এবং হজযাত্রীরা সাধারণত হজের কার্যক্রম সফলভাবে সম্পাদনের জন্য হ্যান্ডবুক এবং বিশেষজ্ঞ গাইড অনুসরণ করেন। হজের নিয়মাবলি সম্পাদন করতে গিয়ে, হজযাত্রীরা শুধু মুহাম্মদের আদর্শ অনুসরণ করেন না, ইব্রাহিমের সঙ্গে সম্পর্কিত ঘটনাগুলোও স্মরণ করেন। হজকালীন সার্বিক অবস্থাকে বলা হয় ইহরাম, যার প্রধান চিহ্ন হলো দুই খণ্ড সেলাইবিহীন সাদা কাপড় পরিধান। এটি পুরুষের জন্য দুটি সাদা সেলাইবিহীন কাপড়, যার একটি কোমরের চার পাশে জড়িয়ে জড়িয়ে হাঁটুর নিচে পৌঁছে অন্যটি বাম কাঁধের ওপর দিয়ে টানা হয় এবং ডানদিকে বাঁধা থাকে। মহিলাদের জন্য সাধারণ পোশাক পরা, যা শুধু হাত ও মুখ উন্মুক্ত করে প্রকাশ্য পোশাকের ইসলামিক শর্ত পূরণ করে।
হজের সময় তালবিয়াহ নামক দোয়া পাঠ করা হয়। এটি হলো- ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা, লাব্বাইকা লা-শারিকা লাকা লাব্বাইকা। ইন্নাল হামদা ওয়ান নেয়ামাতা লাকা ওয়াল মুলকা লা-শারিকা লাকা। এর অর্থ হলো, হে আল্লাহ, আমি হাজির আছি, আমি হাজির আছি। আপনার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির আছি। নিশ্চয় সব প্রশংসা ও নেয়ামু আপনারই এবং সমগ্র বিশ্বজাহান আপনার। আপনার কোনো শরিক নেই। কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্ব থেকে শুরু করে একাদিক্রমে সাতবার কাবা শরিফ প্রদক্ষিণ করাকে ইসলামে তাওয়াফ বলা হয়ে থাকে। আল-মসজিদ আল-হারাম পৌঁছে তীর্থযাত্রীরা ওমরাহর অংশ বা স্বাগত তাওয়াফ হিসেবে আগত তাওয়াফ করেন। মুসলমানদের জন্য এটি হজের একটি অপরিহার্য অঙ্গ।
দশম হিজরিতে অর্থাৎ ৬৩২ সালে হজ পালনকালে আরাফাতের ময়দানে নবী করিম ও শেষ রাসুল হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বিদায় হজের ভাষণ দেন। হজের দ্বিতীয় দিনে আরাফাতের মাঠে অবস্থানকালে অনুচ্চ জাবাল-এ-রাহমাত টিলার শীর্ষে দাঁড়িয়ে উপস্থিত সমবেত মুসলমানদের উদ্দেশে তিনি এ ভাষণ দিয়েছিলেন। মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবিতকালে এটা ছিল শেষ ভাষণ, তাই এটিকে বিদায় খুতবা বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ অনুযায়ী মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে এই ভাষণে চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা ছিল। ইসলাম ধর্ম যে ধাপে-ধাপে ও পর্যায়ক্রমে পূর্ণতা পেয়েছিল, তারই চূড়ান্ত ঘোষণা ছিল মুহাম্মাদ (সা.)-এর এই ভাষণ। এ কারণে সেদিন ভাষণ প্রদানকালে পবিত্র কোরআনের সুরা মায়িদার ৩ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল, ‘আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামত তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকে তোমাদের জন্য একমাত্র জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম।’
লেখক : সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল
ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
"