লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান

  ০৩ জুলাই, ২০২২

দৃষ্টিপাত

জীবন ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে পদ্মা সেতু

গত ২৫ জুন উদ্বোধন হলো বাংলাদেশের সাহস ও সংকল্পের প্রতীক পদ্মা সেতু। আর্থিক সংশ্লেষ, কারিগরি উপযোগিতা, দুর্নীতির সন্দেহের তীর, দেশি ও আন্তর্জাতিক চাপ এবং সর্বোপরি কোভিড-১৯ অতিমারির আড়াই বছরসহ নানামুখী সংকট ছিন্ন করে এ স্বপ্নের বাস্তবতা।

নিজস্ব অর্থে প্রমত্তা পদ্মার ওপর দিয়ে এ স্বপ্নের বাস্তবায়নে যেমন ইস্পাতদৃঢ় সংকল্পের ওপর দাঁড়াতে হয়েছে; তেমনি পদ্মার তলদেশের ১২০ মিটার গভীরে কাদা ও বালির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছে। একটি পিলারকে বসাতে ব্যবহার করতে হয়েছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ হাতুড়ির ২০ থেকে ৩০ হাজার আঘাত; একসময় ভেঙেও পড়েছে সে আধুনিক যন্ত্রটি। প্রায় ৩০ হাজার প্রকৌশলী ও শ্রমিকের আট বছরের শ্রমের ফসল ৬.১৫ কিলোমিটারের এ মহাকর্মযজ্ঞ।

পদ্মা সেতু সংযোজন করেছে দেশের উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে, যা এতদঞ্চলের পণ্য পরিবহন, শ্রমবাজার সম্প্রসারণ, কলকারখানা বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১.৫%। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের প্রায় ৮ কোটি মানুষ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে লাভবান হবে। উপরন্তু ট্রান্স এশিয়ান ও এশিয়ান হাইওয়ে বাস্তবায়ন এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্কের ভিত আরো জোরদার করবে।

যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন মানুষের জীবনযাত্রা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নের ভূমিকা রাখে। পদ্মা সেতু একদিকে যেমন দেশের আর্থসামাজিক, জীববৈচিত্র্য, টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে; তেমনি  স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছাপ রাখবে। এ সেতু দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার প্রায় ৩ কোটি মানুষকে পদ্মার ভয়ংকর রূপের কাছে একসময়ের অসহায় আত্মসমর্পণের বিপরীতে আত্মবিশ্বাসের প্রতিভূ হিসেবে আবির্ভূত হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অনেকটা পিছিয়ে থাকা সে জেলাগুলোয় এ খাতে নব রেনেসাঁর আবির্ভাব ঘটবে।

স্বাস্থ্যের উন্নয়নের অন্যতম উপাদান মানুষের কর্মসংস্থান। কারণ কর্মসংস্থান প্রত্যক্ষভাবে একজন ব্যক্তি বা তার পরিবারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় জড়িত। পদ্মা সেতুর ফলে এতদঞ্চলে লাখ লাখ কর্মসংস্থান গড়ে উঠবে। শত শত কলকারখানা, মোংলা ও পায়রা বন্দর, সুন্দরবন, কুয়াকাটা, ষাট গম্বুজ মসজিদ, পদ্মার সেতুর দুপাড় যথা : মাওয়া ও জাজিরাতে পর্যটনকেন্দ্র ইত্যাদির কর্মযজ্ঞ ও পরিধি বৃদ্ধির কারণে মানুষের কর্মসংস্থান ও আয় বাড়বে। দেশের অন্যান্য অঞ্চল, বিশেষ করে রাজধানীর সঙ্গে পণ্য সরবরাহ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে; কৃষকের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবে। অর্থাৎ সর্বস্তরে কর্মসংস্থানের প্রসার লাভ করবে। মানুষের আয় ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। ফলে পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ, ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। মানুষের জীবনযাত্রার মানোয়ন্নন, স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং মানুষের গড় আয়ুও বৃদ্ধি পাবে। এক কথায় বলা যায়, মানুষের আর্থিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে, স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটবে এবং সুস্থভাবে উন্নত ও দীর্ঘ  জীবন লাভে সক্ষম হবে।

দেশের বার্ষিক শতকরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে স্বাস্থ্যের উন্নয়ন সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ফলে দেশের বার্ষিক জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঘটবে ১.৫ শতাংশ। বিশ্বের সব দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সমানুপাতিক হারে স্বাস্থ্যসূচকের উন্নয়ন ঘটে। সুতরাং পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ৩ কোটি মানুষের প্রত্যক্ষভাবে এবং অন্যান্য অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক মানুষের পরোক্ষভাবে স্বাস্থ্যসেবা, ব্যবস্থাপনা এবং সর্বোপরি স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটাবে।

পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে রাজধানীতে যাতায়াতের সময়ে প্রায় ২ থেকে ৬ ঘণ্টা হ্রাস করবে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, বিশেষ করে জরুরি শল্যচিকিৎসার  ক্ষেত্রে ‘৬ ঐড়ঁৎ ৎঁষব’ বা ‘৬ ঘণ্টা নীতি’ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যত কম সময়ে রোগীর শল্যচিকিৎসা বা ব্যবস্থাপনা প্রদান করা যায়, রোগীর জীবন বা অঙ্গহানি ঘটার সম্ভাবনা ততটা কম থাকে। রোগীর দেহে সাধারণত প্রতি ঘণ্টায় ১ মিমি গভীরে সুস্থ কোষ/কলাগুলোয় সংক্রমিত হয়। এজন্য ৬ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা বা শল্যচিকিৎসা করা সম্ভব হলে রোগীর আরোগ্য লাভ ঘটে দ্রুত এবং জটিলতা হ্রাস পায়। দক্ষিণাঞ্চল থেকে অনেক মুমূর্ষু রোগীকে বহন করতে সময়ক্ষেপণের কারণে এতদাঞ্চলে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। পদ্মা সেতু নিঃসন্দেহে মানুষের দুঃসহ স্মৃতিগুলো ভুলিয়ে দিতে সক্ষম হবে।

একসময় প্রতিদিন দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে দৈনিক ৫০ থেকে ১০০টি রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স রাজধানীমুখী হতো। কিন্তু রাতের অন্ধকার, দুর্যোগপূর্ণ আবওহাওয়া, কুয়াশা কিংবা ফেরির অভাবে ফেরিঘাটেই অনেক রোগীকে শেষ চিকিৎসাটি না নিয়েই পৃথিবী ত্যাগ করতে হয়েছে। এমনকি ১০০ কিমি ঘুরে আরিচা রুটে এসেও দীর্ঘসময় অপেক্ষার কারণে অকালে মৃত্যুর মুখে পতিত হতে হয়েছে বহু মানুষকে। পদ্মা সেতু সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, গভীর রাত, ঘন কুয়াশা বা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া; সবকিছুকে দূরে ঠেলে মাত্র ১০ মিনিটে প্রমত্তা পদ্মা পাড়ি দিতে সহায়তা করবে। বিপন্ন মানুষ পাবে পুনর্জীবন।

যোগাযোগব্যবস্থার কারণেই দক্ষিণাঞ্চলে ৫টি সরকারি মেডিকেল কলেজ এবং অন্যান্য জেলা ও উপজেলা হাসপাতাল থাকার পরও অভিজ্ঞ ও দক্ষ চিকিৎসকের অভাব রয়েছে এসব অঞ্চলে। নিঃসন্দেহে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ফলে চিকিৎসকরা দক্ষিণাঞ্চলের কর্মস্থলে যেতে এবং সেবা দিতে এখন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। একুশ জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা পাবেন হাতের কাছেই। এমনকি অনেক চিকিৎসক রাজধানী থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে স্বল্পকালীন অস্থায়ী সেবা দিতে সক্ষম হবেন। পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের হাসপাতাল ও ফার্মেসিগুলোর মেডিসিন ও স্বাস্থ্য সরঞ্জাম পাওয়া এখন আরো দ্রুত ও সহজলভ্য হবে।

পদ্মা সেতু আমাদের গর্ব, আত্মবিশ্বাস ও স্বপ্নের সেতু। এ সেতু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সিংহভাগ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে।

লেখক : সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা

জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা, ঢাকা

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close