শিক্ষক লাঞ্ছনার দায় বহন করবে কে
শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। একজন শিক্ষার্থী প্রকৃত মানুষ রূপে গড়ে ওঠার পেছনে বাবা-মায়ের চেয়ে শিক্ষকের অবদান কোনো অংশে কম নয়। সঠিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষকরা মানুষের ভেতর সত্যিকারের মানুষ সৃজন করেন। তাই শিক্ষককে বলা হয় সন্তানের দ্বিতীয় জন্মদাতা।
কবি কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতাটি আজকাল শিক্ষকের সম্মানের বিষয়ে এখন রূপকথার গল্প। আগে বলা হতো শিক্ষক সেবিলে উন্নতি হয় আর এখন শিক্ষক পিটালে উন্নতি হয়। সব সময়ই শিক্ষকরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। বাদশাহ আলমগীরের ছেলে শিক্ষকের পা ধুয়ে দিয়েছিলেন, এখন পুরো গা ধুয়ে দিচ্ছে। পাজাকোলা করে পুকুরে ফেলে দিচ্ছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক উন্মেষ রায় এবং সঞ্জয় সরকারকে মৌলবাদী হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, নড়াইলে শিক্ষক স্বপন কুমার তার শিক্ষার্থীকে যৌক্তিকভাবে বাঁচাতে চেয়ে প্রশাসনের দ্বারস্থ হওয়ার কারণে জুতার মালা গলায় পরতে হয়েছে, সাভারে ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ এবং বাধা দেওয়ার কারণে শিক্ষক উৎপল সরকারকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পেটাতে পেটাতে মেরেই ফেলেছে, এর আগে বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার কারণে শিক্ষক হৃদয় কুন্ডুকে অপমান হতে হয়েছে ও জেল-জরিমানা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর অরুণ কুমার বসাক স্যারের জায়গা-জমি দখল করে নেওয়া হচ্ছে।
একাধারে শিক্ষকদের যে অবমাননা-লাঞ্ছনা করা হয়েছে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটা গোষ্ঠী এই কাজগুলো করে যাচ্ছে; যা শিক্ষক লাঞ্ছনা ও অবমাননার চরম মাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে। নড়াইলের শিক্ষককে যে জুতার মালা পরানো হয়েছে, এটা উনাকে জুতা দেওয়া হয়নি, পুরো শিক্ষক সমাজকে জুতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ৫১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজের কেউ প্রতিবাদ জানাননি। আমাদের নৈতিকতায় পচন ধরেছে, পচনটা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে।
শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা কিন্তু আমাদের দেশে প্রথম নয়। প্রায়ই ঘটছে। কোনো শিক্ষকের অনৈতিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা আর তাকে লাঞ্ছিত করা এক কথা নয়। আবার এটা যে কেবল এ সময়েই ঘটছে মানে ছাত্র তার শিক্ষাগুরুর গায়ে হাত তুলছে বা হয়রানি করছে, তা নয়। অনেক আগে থেকেই এই নৈতিক অধঃপতনের শুরু হয়েছে। একটু একটু করে ক্ষয়ে গেছে সেই নৈতিকতার স্থান। যার ফলে আজ একজন শিক্ষককে কোনো অপরাধ ছাড়াই ছাত্রের হাতে প্রাণ দিতে হচ্ছে।
শিক্ষক নির্যাতনের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো শিক্ষক নেতাদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি। রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা। আমলাদের বিমাতাসুলভ আচরণ। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের উদাসীনতা।‘সরকারি’ ও ‘বেসরকারি’ নামক বৈষম্যের নিষ্ঠুর দেয়াল। বেতন ও অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদার দৃশ্যমান বৈষম্য ও তা দূরীকরণে আন্তরিকতার অভাব। আইনের শাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট ঘাটতি। নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়। মিডিয়া বা গণমাধ্যমগুলোর উদাসীনতা এবং শিক্ষকদের পেশাগত দায়িত্বশীলতা, আদর্শ ও নৈতিকতাসহ সহকর্মীদের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ঘাটতি। এ ছাড়াও হামলাকারীরা প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান, স্কুল কমিটির সভাপতির নাতি কিংবা স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সক্রিয় সদস্য।
তাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে বর্তমান পরিস্থিতিতে সব শিক্ষককে যথাযথ মূল্যায়ন এবং তাদের নিরাপত্তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কাজটি সহজ নয়। যত কঠিনই হোক না কেন, কর্মটি সম্পাদনে সবাইকেই সমণ্ডচিন্তায় এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষকদের মর্যাদা সমুন্নত রাখার চূড়ান্ত সময়ে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি। যেখান থেকে এক চুল সরে আসার কোনো সুযোগ নেই। প্রতিহত করা আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
"