আকিজ মাহমুদ

  ০২ জুলাই, ২০২২

মুক্তমত

আত্মমর্যাদা ও বিশ্বাসের প্রতীক

স্বপ্ন আজ সত্যি হয়েছে। স্বপ্ন যে কল্পনার চেয়েও বড় হয়। পদ্মা সেতুই তার জীবন্ত দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসেন। পদ্মা সেতু প্রকৃত অর্থে একজন প্রধানমন্ত্রীকে বাংলার ইতিহাসপটে জীবন্ত করে তুলল। তিনিই শেখ হাসিনা স্বপ্নের রূপকার। পূর্ণিমার তিথিতে সৌন্দর্যের আভা ছড়িয়ে মাথা সমুজ্জ্বল দাঁড়িয়ে গর্বের সেই সেতুটি শেখ হাসিনার দর্প উঁচানো প্রতিকৃতি।

৪২টি পিলার ও ৪১টি স্প্যানে দৃশ্যমান ৬.১৫ কিলোমিটারের সেতুটি তার দেহ অবয়ব পেতে পেরিয়েছে প্রায় ৮ বছর। যে শুরুটা হওয়ার কথা ছিল একরাশ প্রাণোচ্ছল হাসি াখা নেতৃত্বের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায়, তা যেন হয়ে ওঠে তিক্ত কঠিন বিষাদের সুরে। দলীয় দলাদলি, অভিযোগ এবং ষড়যন্ত্রের মধ্যে শুরুতেই ধাক্কা খায় এই প্রকল্প। আন্তর্জাতিক নির্ভর সেই প্রকল্পে বাধা দিয়ে একটি মহল ভেবেছিল, বাইরের কোনো সাহায্য ছাড়া সম্ভব হবে না পদ্মা সেতু নির্মাণ। চুক্তি করেও ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে লেজ গুটিয়ে নেয়। সেতুমন্ত্রী আবুল হাসানকেও পদত্যাগ করতে হয় দুর্নীতির দায়ে ভাঙা কপাল নিয়ে। কিন্তু কথিত যে দুর্নীতির অভিযোগে এত হুলস্থুল কান্ড ঘটে গেল, কানাডার আদালতে দুর্নীতির সেই অভিযোগই কি না ভিত্তিহীন বলে প্রমাণ হলো।

২০১৪ সালে নানা প্রতিবন্ধকতা আর অনিশ্চয়তায় রসিকতার কেন্দ্রবিন্দু যখন এই একটি সেতু, তখন বজ্রকণ্ঠে দৃঢ় এক ঘোষণা এলো, আমাদের টাকায় তৈরি হবে আমাদের সেতু। কত বলিষ্ঠ কথা, কত সাহসী পদক্ষেপ! বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেই হয়তো ভীতিহীন এই মনোভাব। বাংলাদেশের টাকায় যে এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব, অনেকে তা বিশ্বাস করতে চাননি। বিরোধীদের রসিকতা আর নানা কটুবাক্যে জর্জরিত হয়ে উঠেছিল পদ্মার ওপরের স্বপ্নটি।

ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে বাঙালি জাতির গোলামীয় চর্চা এখনো রোথিত হয়নি। কালক্রমে আমাদের মনোভাবের শোচনীয় সেই স্বরূপটি বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়। আমাদের দেশে বিরোধী দল বলতেই যেন হয়ে উঠে সরকারের সব কাজকর্মের সমালোচনাকারী। অনেক ক্ষেত্রে এসব বিরোধী দলের কাছে জনগণের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষার চাইতে ক্ষমতার মসনদে আরোহনই হয়ে ওঠে মুখ্য বিষয়। জনগণের প্রতি দায় ভুলে শাসক যেমন জনবিচ্ছিন্ন কাজ করে, বিরোধীরাও অপ্রাসঙ্গিক সমালোচনা করে শাসকদের বৈধতা দান করে। বাংলাদেশ এই সংস্কৃতি থেকে স্বাধীনতাণ্ডপরবর্তী সময়ে এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি।

পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প এবং জাতির স্বপ্নের বাস্তবায়নেও আমরা তেমনটি লক্ষ করি। অথচ এই পদ্মা সেতু জাতীয় ঐক্যের নিদর্শনস্বরূপ। পদ্মা সেতু রাজনীতির অংশ হওয়া মোটেই সমীচীন নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সর্বজনীন মানুষের ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখেন। কেননা এই একটি সেতু দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে দেবে। এই সেতুর মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সম্ভব হবে। অর্থনীতিতেও যে তা বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

পদ্মা নদীর মাধ্যমে দেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী এবং ফরিদপুর জেলাগুলোর উন্নয়নে তা ভূমিকা রাখবে। দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় মাইলফলক এই সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২.৩ শতাংশ, যা দেশের মোট জিডিপিতে অতিরিক্ত ১.৩ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটাবে। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ মসৃণ হওয়ায় খুলনা, মোংলা, বরিশাল, কুয়াকাটায় গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে। শিল্পক্ষেত্রে বড় ধরনের বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনাও সৃষ্টি হতে পারে এই সেতুর কারণে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে বাজেট বৃদ্ধি নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। অনেকের মতে, এই প্রকল্পে ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ তুলনামূলক অন্যান্য দেশের সেতু নির্মাণের চেয়ে বেশি। অনেকেই ব্যয়িত এই অর্থের জোগানকে সাধারণ মানুষের জীবনমানে প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেছেন। তবে আমরা যদি খরস্রোতা নদী এবং মূল সেতুতে রেলপথ বাস্তবায়নের সার্বিক বিষয়াদিতে নজর দেই; তাহলে অন্যান্য সেতুর তুলনায় এতে যে খরচ বেশি হবে, তা জানা কথা। এর বাইরে যদি বাজেট বৃদ্ধি নিয়ে কোনোরূপ ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে থাকে, তা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচারযোগ্য এবং জনগণ সে সম্পর্কে অবিহিত হওয়ার দাবি রাখে।

অনেক অর্থনীতিবিদ পদ্মা সেতু প্রকল্পে ব্যয়িত অর্থ সংগ্রহ এবং ঋণ পরিষদের বিষয়টিকে সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং মনে করছেন। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সেতু আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত হতে পারে। যমুনা নদীর ওপর নির্মিতি বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে মোট খরচ হয়েছিল ৩ হাজার ৭৪৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরের জুন থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ২১ বছরে সেতুর টোল আদায় বাবদ টাকা এসেছে ৫ হাজার ৩৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, যা পরিকল্পিত ২৫ বছরের সাত বছর আগেই উঠে এসেছে। এ কথা ঠিক যে, প্রায় ৪ হাজার কোটি এবং প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে, তবে পদ্মা সেতু প্রকল্পের যে ইমপ্যাক্ট অর্থনীতিতে পড়বে, তা আমাদের জন্য আশার বাণী। প্রতিদিন প্রায় ৭৬ হাজার যানবাহন চলাচল এবং দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন খাত অবমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা পদ্মা সেতুকে আমাদের অর্থনীতির পরশ পাথরে পরিণত করতে পারে।

পদ্মা সেতু বাঙালি জাতির আত্মমর্যাদার প্রতীক। দেশের উন্নয়ন কাঠামো নির্মাণে আমাদের যে দীর্ঘ বিদেশি নির্ভরতা ছিল, তা থেকে বেরিয়ে নিজেদের আত্মবিশ্বাসের জোগানদার এই সেতু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাইতো বলেছেন, আমি পারি, আমরাও পারি। বাংলাদেশ পেরেছে। এ যেন নতুন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ। একজন রাষ্ট্রনায়কের সফলতার গল্প। দিন বদলের ধারায় উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর অভিপ্রায়। ২০৪০ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গড়ার যে লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে, সে লক্ষ্যের দৃশ্যমান পদক্ষেপ এই সেতু। পদ্মা সেতু হয়ে গেছে। সময় এসেছে পদ্মা পাড়ের মানুষের পশ্চিমাকাশের কালো মেঘের অবসানের। পদ্মা সেতু কেবল একটি অবকাঠামো নয়। জাতির নবজাগরণের পাথেয়। জাতির শিরদাঁড়া উঁচিয়ে চলার গর্ব। এটি এমন একটি মাইলফলক, যা বাঙালি জাতিকে আরো কয়েক যুগ এগিয়ে দিল। এই কৃতিত্বের ভাগিদার দেশের সব জনগণ।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close