সাধন সরকার

  ০২ জুলাই, ২০২২

দৃষ্টিপাত

বন্যা-বজ্রপাত-পাহাড়ধস ডেঙ্গু ও জলাবদ্ধতা

মৌসুম এখন বর্ষাকাল। এই মৌসুম সুবিধার পাশাপাশি আবার অনেকগুলো সমস্যার কারণ। বাংলা সাহিত্যে বর্ষা বিশেষ স্থান দখল করলেও বাংলাদেশের বাস্তবতায় বর্ষা মৌসুম কেন জানি ভোগান্তির আরেক নাম! বন্যা-বজ্রপাত-পাহাড়ধস-ডেঙ্গু-জলাবদ্ধতা মূলত বর্ষা মৌসুমজনিত হলেও এই পাঁচ সমস্যার ক্ষেত্রে মনুষ্যসৃষ্ট ব্যাপারটাই বেশি দায়ী। বর্ষা প্রকৃতির আশীর্বাদ। বর্ষা সমস্যার কারণ নয়, সমস্যার জন্য দায়ী মানুষের প্রকৃতিবিরুদ্ধ নেতিবাচক কর্মকান্ড। করোনার চতুর্থ ঢেউয়ের মধ্যেও বর্ষাকালীন দুর্যোগ থেকে রেহাই নেই!

বন্যা : সিলেট-সুনামগঞ্জসহ পুরো সিলেট বিভাগে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সীমাহীন কষ্টের মধ্যে দিন কাটছে উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবন। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেখলে মনে হবে পুরো সিলেট পানিতে ভাসছে। একথা ঠিক যে, বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিম্ন আয়ের মানুষ। তবে সিলেট বিভাগের এই ভয়াবহ বন্যা ধনী-গরিব সবস্তরের মানুষকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। ত্রাণ ও বিশুদ্ধ পানির জন্য চারদিকে হাহাকার চলছে।

বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। এখন সবচেয়ে জরুরি হলো বিধ্বস্ত জনপদে বন্যাদুর্গতের পাশে দাঁড়ানো। উত্তরাঞ্চলের বন্যা দেশের মধ্যাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দেশে খাদ্য সংকট ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এটা একটা চরম বাস্তবতা যে, শুষ্ক মৌসুমে ভারত থেকে পানি আসে না, আবার বর্ষা মৌসুমে যখন পানি লাগবে না ঠিক তখনই পানি ছেড়ে দিয়ে বন্যার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ার সম্পর্ক বিদ্যমান। ধারণা করা হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা বন্যা, নদীভাঙন, খরা, ঘূর্ণিঝড় বাড়বে ছাড়া কমবে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা সামান্যই। বৃষ্টি-বন্যা আগেও ছিল, বর্তমানে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আমাদের অনেক কিছু করার আছে। নদনদীগুলো যদি ভরাট না হয়ে যেত, জলাভূমি ও খাল-বিল দখল না হয়ে যেত, তাহলে বন্যা মাত্রা ছাড়িয়ে যেত না। সুরমা-কুশিয়ারা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার মাশুল দিচ্ছে সিলেট। শুধু সিলেটের নদনদী নয়, বাংলাদেশের অধিকাংশ নদনদী দখল ও ভরাট হয়ে গেলেও তা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

বজ্রপাত : বছর ঘুরে আবারও আলোচনায় বজ্রপাত। এ বছর এপ্রিল মাস থেকেই বজ্রপাতের তাণ্ডবলীলা শুরু হয়েছে। পুরো বর্ষা মৌসুম তো এখনো বাকি। প্রাক বর্ষা মৌসুম শুরুর এ সময় থেকে কৃষক ও জেলেদের কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখা যাচ্ছে। বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণের কথা বললেই প্রথমেই আসবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা। তাছাড়া পরিবেশ দূষণ, বৃক্ষ সম্পদ ধ্বংস, নদনদী শুকিয়ে যাওয়া, জলাভূমি ভরাট হওয়াসহ বিভিন্ন কারণ তো রয়েছেই।

গবেষকদের মতে, বিশে^র গড় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে বজ্রপাত অন্তত ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। শহরের চেয়ে গ্রামে বজ্রপাতের পরিমাণ বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে! ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত নতুন আতঙ্কের নাম হয়ে দেখা দিয়েছে। বজ্রপাতের পরিসংখ্যান বলছে, বিশে^ বজ্রপাতের কারণে যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার চার ভাগের একভাগ মানুষের মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে ২ হাজার ৮০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২২ সালে এ পর্যন্ত বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ৫৫ ছাড়িয়ে গেছে। বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মারা যায় কৃষক ও জেলে পেশায় নিয়োজিত খেটে খাওয়া গরিব মানুষ। এই দুই জনগোষ্ঠীকে বজ্রপাতের মৌসুম শুরুর আগে থেকেই যদি সচেতন করা যায়, তাহলে বজ্রপাতে প্রাণহানি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে তালগাছ লাগানো একটা ভালো সমাধান। তবে এটা বেশ সময়সাপেক্ষ ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। প্রযুক্তিগত সহায়তার কথা এক্ষেত্রে ভাবা যেতে পারে। আশার কথা, সরকার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রনিরোধক দন্ড বসানোর কাজ চলছে।

পাহাড়ধস : চলছে বর্ষা-দুর্যোগের মৌসুম। পুরো বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোর পাহাড়ে বা পাহাড়ের কোলঘেঁষে বসবাসকারী পরিবারগুলোর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে। বর্ষা মৌসুম আসে আর পাহাড়ধস নিয়ে আলোচনা হয়, সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরও প্রতি বছর পাহাড়ধসে জানমালের ক্ষতি হয়। আর এর অন্যতম কারণ, পাহাড়কে পাহাড়ের মতো করে থাকতে না দেওয়া। পাহাড় কেটে পাহাড়ের পাদদেশে গরিব গৃহহীন মানুষের বসতি স্থাপনের মাধ্যমে বেশ কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠী পাহাড়ের স্থায়ী ক্ষতি করে চলেছে। পাহাড় কেটে সমতল ভূমিতে রূপান্তরিত করে পাহাড়ের পাদদেশে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। প্রভাবশালী গোষ্ঠী পাহাড় কেটে একদিকে অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে পাহাড়ধসকে ত্বরান্বিত করছে। পাহাড়খেকো প্রভাবশালীদের সম্পর্কে নিশ্চয় প্রশাসন অবগত! তার পরও এসব গোষ্ঠী পাহাড় কেটে প্রকৃতি ও পাহাড়ের সৌন্দর্য নষ্ট করার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। এ বছর এখন পর্যন্ত পাহাড়ধসে চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে ২৮টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসতি বয়েছে। এ ছাড়া রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন ও

ময়মনসিংহেও ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাস করছে বহু পরিবার। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করা জনগোষ্ঠীকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তা অনেক সময় কাজে আসে না! কেননা পাহাড় থেকে তাদের তাড়িয়ে দিলেও কোনো না কোনোভাবে তারা আবার পাহাড়ে ফিরে আসে। বিভিন্ন বছর পাহাড় কাটা ও বন উজাড়ের ফলে বর্ষা মৌসুমে একের পর এক পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটছে। প্রশাসনের তৎপরতাই পাহাড়ধসে মৃত্যুর ঘটনা কমে আসতে শুরু করেছে। পাহাড়ধসের স্থায়ী সমাধানের দিকে নজর দিতে হবে।

ডেঙ্গু : চলতি বছর ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত একজন মারা গেছে। বছর বছর বেড়েই চলেছে মশাবাহিত রোগ ও রোগীর সংখ্যা। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঋতুবৈচিত্র্য ও বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বিভিন্ন রোগের যেমন সম্পর্ক আছে, ফলে একই রোগ ভিন্ন ভিন্ন ধরন ও লক্ষণ নিয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রভাব পড়ছে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার ওপর। আগে যেসব জায়গায় মশা টিকতে পারত না, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সেসব জায়গায় মশা অবস্থান করছে! আবার বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় এডিস মশার বংশবিস্তার বেশি হচ্ছে। বিশেষ করে বৃষ্টির সময় পানি জমে থাকার কারণে এডিস মশার প্রজনন বেড়ে যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশে^র বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ডেঙ্গু ব্যাপকতা লাভ করছে!

প্রকৃতপক্ষে মশা নতুনভাবে নতুন নতুন ঝুঁকি নিয়ে জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মশা ছোট্ট কীট হলেও এর আতঙ্কে প্রতি বছরই নগরবাসীকে ভুগতে হয়। মশা নির্মূলে শুধু ওষুধ প্রয়োগে কাজ হবে এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই! তিনটি বিষয় এখানে বিবেচনায় আনতে হবে। বিষয়গুলো হলো- ১. সার্বিক পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা (সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাজ) ২. ওষুধ ছিটানো (কর্তৃপক্ষের কাজ) ৩. জনগণের দায়বদ্ধতা ও সচেতনতা (জনসাধারণের কাজ)। সার্বিক পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা হিসেবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নগরের খাল, নালা, সব ধরনের জলাশয়, রাস্তাঘাট, পার্ক-উদ্যান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। মশার বংশবিস্থার প্রতিরোধে ওষুধ ছিটানোর কাজ কর্তৃপক্ষকে পরিকল্পিতভাবে এবং যথাযথভাবে করতে হবে। আরো যে কাজটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো জনসচেতনতা।

জলাবদ্ধতা : বর্ষা মৌসুম পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। রাজধানীতে বর্ষা মানেই যেন ফের জলাবদ্ধতায় ডুবে যাওয়া! এ যেন এক অমোঘ নিয়তি! প্রতিার বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতায় নাকাল হতে হয় রাজধানীবাসীকে। সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ থেকে প্রতিবার বর্ষা মৌসুমে আশ্বাস দেওয়া হয় যে, জলাবদ্ধতা আর থাকবে না। কিন্তু ঠিক পরের বছর ফের জলাবদ্ধতায় পড়তে হয় নগরবাসীকে! বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এবারও বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলবে না! একসময় এই ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতা হতো না। বৃষ্টির পানি বিভিন্ন খাল-নালা দিয়ে আশপাশের নদীতে চলে যেত। ৫০টিরও বেশি খাল বৃষ্টির পানি ধরে রাখত। কিন্তু খাল-নালাগুলো দখল-ভরাট হয়ে পানি নিষ্কাশনে ভাটা পড়েছে। যেকোনো শহরের মোট ভূমির কমপক্ষে ১২ ভাগ জলাধার থাকা দরকার। কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র ২ ভাগ। ফলে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জায়গা নেই। আবার শহরের ৮০-৯০ ভাগ জায়গা কংক্রিটে ঢাকা। এতে মাটির নিচে পানি যেতে পারে না। ঢাকার নিম্নাঞ্চল ভরাট হয়ে যাওয়ায় এই সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রাকৃতিক জলাধার ও নিম্নাঞ্চলগুলো ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই।

বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার ভোগান্তিসহ বিভিন্ন উন্নয়নকাজের ঝামেলায় নগরবাসীকে বেগ পেতে হয়। এই ঢাকা শহরে এক সময় পুকুর, ঝিল-বিল, খাল-নালা, লেকের সঙ্গে আশপাশের নদীর সংযোগ ছিল। ময়লা-আবর্জনা আর দখলের কারণে অধিকাংশ প্রাকৃতিক জলাশয় এখন ভরাট হয়ে গেছে। আশপাশের নদনদীর সঙ্গে সংযোগ অনেকটাই কাটা পড়েছে। ড্রেনেজ লাইনে বর্জ্য পড়ে নালা ভরাট হয়ে গেছে। অথচ বৃষ্টির পানি সরাতে শহরের খাল-জলাশয়ের সঙ্গে আশপাশে নদনদীর সংযোগ থাকা সবচেয়ে বেশি জরুরি। বর্ষা মৌসুমে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতাও ভয়াবহ রূপ নেয়। মূলত জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ব্যাপক কাজ হলেও সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতার কারণে নগরবাসী এর সুফল পাচ্ছে না। খাল ও সব ধরনের প্রাকৃতিক জলাধারগুলো রক্ষণাবেক্ষণে উদ্যোগী হতে হবে, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বিভিন্ন সংস্থা ও কর্তৃপক্ষের কাজের সমন্বয় ও আন্তরিকতা থাকলে জলাবদ্ধতা দূর করা কঠিন ব্যাপার নয়।

লেখক : শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close