মো. জিল্লুর রহমান

  ০২ জুলাই, ২০২২

বিশ্লেষণ

অর্থ পাচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি

দেশ থেকে দেশের বাইরে অবৈধভাবে অর্থ-সম্পদ চলে যাওয়াকে অর্থনীতির ভাষায় পুঁজি বা অর্থ পাচার বলা হয়। যতই দিন যাচ্ছে, ততই বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক কারণেই অর্থ পাচার হয়, তার মধ্যে হতাশাজনক হলেও সত্যি বিনিয়োগ না হওয়ায় অর্থ পাচার হচ্ছে। অর্থ পাচার করে বিদেশে ছেলেমেয়েদের স্থান করে দেওয়ার প্রবণতা সত্তরের দশক থেকেই চলে আসছে। তখন থেকেই বড় বড় আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারাই বিভিন্নভাবে অর্থ পাচারের এই সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন।

সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ বিনা প্রশ্নে আয়কর বিবরণীতে প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, কোনো করদাতা বাংলাদেশের বাইরে কোনো সম্পদের মালিক হলে এবং সেই সম্পদ আয়কর বিবরণীতে প্রদর্শিত না হলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে নির্দিষ্ট কর দেওয়ার মাধ্যমে তা প্রদর্শনের সুযোগ পাবেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাইরে থাকা স্থাবর সম্পদ দেশে ফেরত না আনা হলে তার জন্য সম্পদের ন্যায্য বাজার মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর, নগদ অর্থ, ব্যাংক জমা, সিকিউরিটিজ এবং আর্থিক উপকরণসহ সব অস্থাবর সম্পদ বাংলাদেশে না আনা হলে ১০ শতাংশ হারে কর এবং নগদ অর্থ, ব্যাংক জমা, সিকিউরিটিজ এবং আর্থিক উপকরণসহ সব অস্থাবর সম্পদ দেশে ফেরত আনা হলে তার জন্য ৭ শতাংশ হারে কর দেওয়ার প্রস্তাব করেন। এক বছরের জন্য এই সুযোগ দেওয়া হবে। যা শেষ হবে ২০২৩ সালের ৩০ জুন।

অর্থমন্ত্রীর এই ঘোষণা ব্যবসায়ী মহল থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ এবং সুধীসমাজে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে আনা হলে ভালো ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হবেন। এটা ব্যবসায়ীরা চান না। বাজেটে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ও সুশাসনের কথা বলা হলেও পাচার করা কালোটাকা সাদা করার যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা সমর্থনযোগ্য নয়। এতে বৈধ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন এবং বিদেশে অর্থ পাচার বৈধতা পাবে।

সম্প্রতি সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে এই অর্থের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। সুইস ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে কয়েক বছরে যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে, তাতে এই বৃদ্ধি এক বছরের ব্যবধানে সর্বোচ্চ। এই হিসাব অনুযায়ী, এক বছরেই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বেড়েছে। পূর্ববর্তী বছরগুলোতে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ২০১৪ সালে ছিল ৪,০৫৮ কোটি টাকা, ২০১৫ সালে ৪,৪১৭ কোটি, ২০১৬ সালে ৫,৫৬৬ কোটি, ২০১৭ সালে ৪,০৬৯ কোটি, ২০১৮ সালে ৫,৫৫৩ কোটি এবং ২০১৯ সালে ৫,৪২৭ কোটি টাকা।

তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)-এর এক তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। প্রতি ডলার ৮৫ টাকা বাজারদরে এর পরিমাণ ৬৩ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। প্রতিবেদনটিতে ১৩৫টি উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশের গত ১০ বছরের (২০০৮-২০১৭) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মূল্য ঘোষণার গরমিল দেখিয়ে কীভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়, সেই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতি বছরের গড় অর্থ পাচারের হিসাবে ওই ১৩৫টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৩৩তম। এ দেশে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে মূল্য ঘোষণার গরমিল দেখিয়ে টাকা পাচার হয় বলে অভিযোগ আছে। ইদানীং এমন কিছু ঘটনাও উদঘাটন করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য সব দেশের যত আমদানি-রপ্তানি হয়, তাতে গড়ে ১৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ বা প্রায় ১৮ শতাংশের মূল্য ঘোষণায় গরমিল থাকে।

দেশের ব্যবসায়ী, বিভিন্ন পেশাজীবী ও রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন উপায়ে কোটি কোটি টাকা পাচার করেন। আবার বিদেশিরাও বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। বিদেশিরা যে পরিমাণ অর্থ পাচার করছেন, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ পাচার করছেন বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশে বিদেশিদের নিয়োগ-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে অধিকাংশ বিদেশি টাকা পাচার করলেও বাংলাদেশিরা পরিকল্পনা করে অর্থ পাচার করছেন। বাংলাদেশের নাগরিকরা দুটি কারণে অর্থ পাচার করছেন। প্রথমত, যারা অপ্রদর্শিত আয় বা কালোটাকা দেশে ভোগ করতে পারছেন না। তারা বিভিন্ন দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোমও গড়ে তুলছেন। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণেও বাংলাদেশিরা টাকা পাচার করছেন। আর এই দুটো সেক্টরেই ব্যাপকভাবে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কালোটাকার পাচার হচ্ছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মালয়েশিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশের অট্টালিকায় বসবাস করছেন। ব্যাংকের গ্রাহকদের আমানতের অর্থ নানা কৌশলে তারা বিদেশে পাচার করে সেখানে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলছেন।

ব্যাংক ঋণখেলাপিদের ওপর ২০১০ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের ১২৫টি ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত জরিপের সংগৃহীত তথ্যে প্রমাণিত হয়েছে, ওইসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকরা তাদের ব্যাংকঋণের একটা বড়-সড় অংশ বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন। দুই বছর আগে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পিকে হালদার নামে পরিচিত) গত ১৪ মে ২০২২ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়। বাংলাদেশে ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং পিপলস লিজিংসহ চারটি প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং পাচারের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুদকের ৩৬টি মামলা রয়েছে।

ঢাকার একটি ব্যাংক ও অপর একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগ ওঠার পর দীর্ঘদিন ধরেই তিনি পলাতক ছিলেন। ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) তদন্তে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকায় পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের ৮৮টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩০০ কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পেয়েছে। এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় পি কে হালদারের সাতটি ফ্ল্যাটেরও খোঁজ পায় সংস্থাটি। শুধু পি কে হালদার একা নয়, তার মতো অনেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কানাডা, মালয়েশিয়ার বেগমপাড়ায় নামিদামি ফ্ল্যাট-বাড়ি কিনে আরামণ্ডআয়েশে জৌলুস জীবনযাপন করছেন।

জিএফআইয়ের প্রতিবেদন বলছে, ২০০৮ সালের পর বাংলাদেশে এভাবে মূল্য ঘোষণায় গরমিল দেখিয়ে অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ১,১৫১.৩০ কোটি ডলার বিদেশে চলে গেছে। ২০০৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫২৮ কোটি ডলার। এ ছাড়া ২০০৯ সালে ৪৯০ কোটি ডলার, ২০১০ সালে ৭০৯ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৮০০ কোটি ডলার, ২০১২ সালে ৭১২ কোটি ডলার ও ২০১৩ সালে ৮৮২ কোটি ডলার বিদেশে গেছে। ২০১৩ সালে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে সেই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের ৭টি গুরুত্বপূর্ণ খাতের উন্নয়নের জন্য যে ব্যয় ২০১৫-১৬ সালে ধার্য করা হয়েছে, তার সমান। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা জিএফআই-এর তথ্যমতে, ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, তা দেশের মোট জাতীয় বাজেটের দেড়গুণ। প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে ৬৩ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা।

দেশে এখন যে প্রশংসনীয় উন্নতি-উন্নয়ন হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ৮-৯ শতাংশ ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। বড় একটা গোষ্ঠী মধ্যবিত্ত হয়েছে। সাধ-স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব নেই। গাড়ি ছাড়া মধ্যবিত্ত নেই বললেই চলে। মাথাপিছু আয় যথেষ্ট বেড়েছে। দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যারাই টাকার মালিক হচ্ছে, যারাই প্রভাবশালী, যারাই একটু লেখাপড়া করছেন, যারা জ্ঞানী, তারা কেউ বাংলাদেশে থাকতে চান না। অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার না হলে দেশের অর্থনীতিতে কোনো না কোনোভাবে ভূমিকা রাখেন কিন্তু যখনই এ অর্থ বিদেশে পাচার হয়, তখন এটি দেশের অর্থনীতিতে কোনো ভূমিকা না রেখে বরং অশনিসংকেত হিসেবে কাজ করে। দেশের অর্থনীতির চাকাকে ক্রমান্বয়ে স্থবির করে দেয় এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতির ভিত্তির জন্য অশনিসংকেত। যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে অর্থ পাচার রোধ করা সরকারের দায়িত্ব এবং সে দায়িত্ব পালনে সরকার এগিয়ে আসবে- এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট

[email protected],

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close