আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

  ০১ জুলাই, ২০২২

দৃষ্টিপাত

জিলহজের প্রথম ১০ দিন যেভাবে কাটাবেন

আল্লাহতায়ালা এমনই দয়ালু রব যে, তিনি চান না তার একটা বান্দাও জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হোক। বরং তিনি চান, তার বান্দারা পরকালীন অনন্ত জীবনে পরম শান্তিতে বসবাস করুক। সেজন্যই তিনি সৃষ্টি করেছেন চিরস্থায়ী সুখনিবাস তথা জান্নাত। কিন্তু মানুষ যে গুনাহের পুতুল! বুঝে না বোঝে, জেনে না জেনে, শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে অসংখ্য গুনাহে জড়িয়ে যায়। ফলে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলগুলো সুখময় জান্নাতের সম্মুখে বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। তবে আল্লাহ অতি দয়ালু, ক্ষমাশীল। তিনি ক্ষমা করতেই ভালোবাসেন। তাই ক্ষমার আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, ‘হে আমার ইমানদার বান্দারা! যারা নিজেদের ওপর সীমালঙ্ঘন করেছো, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করেন। তিনি তো অতি ক্ষমাশীল, বড় মেহেরবান।’ (সুরা জুমার, আয়াত : ৩৯)

যারা ভুল পথে পা বাড়িয়েছিল, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের ভুল শুধরানোর জন্য এমন কিছু বিশেষ সময় নির্ধারিত করে রেখেছেন, যে সময়গুলোয় বান্দা বেশি বেশি ইবাদত করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে নিজেদের গুনাহসমূহ মাফ করিয়ে নিতে পারেন। তেমনই কিছু বিশেষ সময় জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন। এ দিনগুলোকে রাসুল (সা.) আখ্যায়িত করেছেন শ্রেষ্ঠ দিন হিসেবে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন নবীজি ইরশাদ করেছেন, ‘এমন কোনো দিন নেই, যার আমল জিলহজ থেকে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! (সা.) আল্লাহর পথে জিহাদও নয়? জবাবে নবীজি বললেন, ‘আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে যে ব্যক্তি তার জান-মাল নিয়ে আল্লাহর পথে যুদ্ধে বের হলো এবং এর কোনো কিছু নিয়েই ফিরে না এলো (অর্থাৎ যে শাহাদাত বরণ করেছেন) তার কথা ভিন্ন।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস : ৯৬৯)

অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘পৃথিবীর দিনগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিনগুলো হলো দশকের দিনসমূহ। অর্থাৎ জিলহজের প্রথম দশ দিন। জিজ্ঞেস করা হলো, আল্লাহর পথে জিহাদেও কি এর চেয়ে উত্তম দিন নেই? রাসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহর পথে জিহাদেও এর চেয়ে উত্তম দিন নেই। তবে হ্যাঁ, শুধু সে-ই যে (জিহাদে) তার চেহারাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে।’ (মুসনাদে আবি ই’য়াালা, হাদিস : ২০৯০)

উল্লেখ্য, আল্লাহতায়ালার কাছে প্রত্যেকটা দিনই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তিনিই এই দিন-রাত্রির স্রষ্টা। দিন-রজনি প্রত্যেকটিকেই তিনি অনন্য গুণে গুণান্বিত করেছেন। তবে এ দিনগুলোতে যেহেতু সবগুলো মৌলিক ইবাদতের সমাবেশ ঘটে, সেহেতু এ দিনগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব অন্যান্য দিনের চেয়ে অধিক হওয়াই যুক্তিসংগত। এই গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো আমাদের জন্য অতীব জরুরি। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জিল হজের দশ দিনের ইবাদত আল্লাহর কাছে অন্যান্য দিনের ইবাদতের তুলনায় বেশি প্রিয়। এ মাসের প্রত্যেক দিনের রোজা এক বছরের রোজার মতো, আর প্রত্যেক রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের মতো।’ (তিরমিজি শরিফ, হাদিস : ৭৫৮)

এবার আসুন! তাৎপর্যময় এ দিনগুলোয় কী কী নেক আমল করা প্রয়োজন তা জেনে নিই। জিলহজ মাসের চাঁদ উদিত হওয়ার পর থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত যত দিন সম্ভব নফল রোজা রাখা এবং রাতের বেলা বেশি বেশি নফল সালাত, কোরআন তিলাওয়াত, তাসবিহ-তাহলিল, তাওবা-ইস্তেগফার ও রোনাজারির মাধ্যমে রাত কাটানো কিংবা যতটুকু সম্ভব ইবাদত করা উচিত। এই সুবর্ণ সুযোগগুলোকে কাজে লাগানোই একজন সত্যিকার মুমিনের বৈশিষ্ট্য। পুরো ৯ দিন রোজা না রাখতে পারলেও আরাফার দিনে রোজা রাখা খুবই জরুরি। হজরত আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আরাফার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, এ রোজা তার আগের ও পরের বছরের গুনাহ মুছে ফেলবে।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস : ৭৪০)

আরাফার দিনের আরেকটি আমল হলো বেশি বেশি এই কালিমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু বিয়াদিহিল খাইরু, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়্যিন কাদির পড়া।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৬৯২২)। জিলহজ মাসের ৯ তারিখের ফজর থেকে ১৩ তারিখের আসর পর্যন্ত প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক বুদ্ধিমান মুসলিম নারী-পুরুষের জন্য একবার তাকবিরে তাশরিক বলা ওয়াজিব। উল্লেখ্য, পুরুষের জন্য শব্দ করে আর নারীদের জন্য নীরবে। তাকবিরে তাশরিকটি হচ্ছে- ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ (সুনানে বায়হাকি, হাদিস : ৬০৭১)

জিলহজের প্রথম দশকের অন্যতম আরেকটি দিবস হলো কোরবানির দিবস। হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ দিন হলো কোরবানির দিন, অতঃপর স্থিরতার দিন।’ কোরবানি হচ্ছে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের এক অনন্য মাধ্যম। কেন না কোরবান শব্দটির অর্থই হচ্ছে নিকটবর্তী হওয়া, সান্নিধ্য লাভ করা। মহিমান্বিত এ কোরবানি একদিকে যেমন প্রভুর সন্তুষ্টির মাধ্যমে, অন্যদিকে তা সামাজিক স্থিতিশীলতা ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের অনুপম সহযোগী। শুধু তাই-ই নয়, কোরবানির মাধ্যমে বান্দা যেমন আল্লাহর নিকটবর্তী বা প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন, তেমনি পরিত্রাণ পায় তার অভ্যন্তরীণ পশুত্বসুলভ আচরণ থেকে। তবে কখনো কখনো কিছু ভুল আর প্রস্তুতির অভাবে কোরবানির মতো পুণ্যময় এই ইবাদতে যেমন বিঘœœ ঘটে, তেমনি আবার কিছু অসাবধানতার জন্য তা হয়ে উঠে আমাদের পরকালের শাস্তির কারণ। যেমন : কোরবানিকে কেন্দ্র করে যত্রতত্র পশুর হাট বসিয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা। কোরবানি উপলক্ষে স্থানীয় জনগণ ও প্রশাসনের সহায়তায় নির্দিষ্ট জায়গায় পশুর হাটের আয়োজন করা হলেও কোথাও কোথাও প্রশাসনের নির্দেশকে অমান্য করে সড়ক-মহাসড়কে কোরবানির পশুর হাট বসানো হয়ে থাকে। এতে করে ঈদে ঘরমুখো মানুষজন পড়েন ভীষণ যানজটের কবলে। শহরে তো এর চিত্র আরো ভয়ংকর।

আবার অনেকেই কোরবানির পশুর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না। দূরদূরান্ত থেকে কোরবানির পশুকে হাঁটিয়ে আনা হয় অথবা নিয়ে যাওয়া হয়। এমন করা মোটেও উচিত নয়। ইসলাম তো সেই পশুটিকেই কোরবানি করতে বলে, যে পশুটি আপনার সবচেয়ে আদরের। যে পশুর প্রতি আপনার কোনো মমত্ববোধ নেই, নেই কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভালোবাসা, তাহলে সেই পশুর রক্ত প্রবাহিত করে আপনি কীভাবে দয়াময় আল্লাহর সন্তুষ্টির আশা করতে পারেন? যেখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ‘আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ, আয়াত : ৩৭) যারা কোরবানি দেবেন তাদের জন্য আরেকটি আমল হলো, জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর থেকে হাত-পায়ের নখ, মাথার চুল ও অবাঞ্ছিত পশম ইত্যাদি কাটা বা ছাঁটা থেকে বিরত থাকা। কেন না এ কাজটি সুন্নত। হজরত উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন- ‘যখন (জিলহজের প্রথম) ১০ দিনের সূচনা হয়, আর তোমাদের কেউ কোরবানি করার ইচ্ছে করে, সে যেন চুল-নখ ইত্যাদি না কাটে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১৪৯)

তবে খেয়াল রাখতে হবে হাত-পায়ের নখ, মাথার চুল ও অবাঞ্ছিত পশমের বয়স যেন চল্লিশ দিনের বেশি না হয়ে যায়। আর এজন্য উত্তম হলো জিলহজের চাঁদ উদিত হওয়ার কিছুদিন আগেই তা পরিষ্কার করে ফেলা। আল্লাহতায়ালার অশেষ মেহেরবানি যে, তিনি আমাদের মতো পাপী-তাপী বান্দাদের জন্য স্বীয় অনুগ্রহে এমন সব নেক আমল করার সুযোগ দিয়েছেন। তাই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে না পারলে আমাদের মতো হতভাগা আর কেউ হবে না।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

খতিব, কসবা মসজিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close