নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার

  ৩০ জুন, ২০২২

মুক্তমত

বাজেট বাস্তবায়নে জোর দেওয়া হোক

বাজেট শব্দটি আমাদের সবার কাছে পরিচিত। বিশেষ করে যখনই জুন মাস আসে, তখনই এ নিয়ে চলে আলোচনা। বাজেট বিষয়টি নিয়ে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের তেমন একটা আগ্রহ লক্ষ করা যায় না। তবে এর ফলাফল থেকে কোনো শ্রেণিই বাদ যায় না। আমাদের দেশে বাজেট এলেই প্রান্তিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের মনে একটা আতঙ্ক বিরাজ করে কোন পণ্যের দাম বাড়ছে। গ্রামের মানুষের মধ্যে এটা একটা ধারণা হয়েছে বাজেট মানেই দাম বাড়ানো। বেশ কয়েক বছরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শক্তিশালী হওয়ায় এর প্রচারণাও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে মানুষের আলোচনা-সমালোচনা করার জায়গা। এ বছরের বাজেটকে টানাটানির বাজেট, মূল্যস্ফীতি, ধনিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষার বাজেট, লুপাটের দলিল, কর চাপানোর বাজেট, বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং, ব্যবসাবান্ধব, উচ্চাভিলাষী, নতুন প্রতিশ্রুতিহীন, ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো, অনেক অসংগতি কিংবা সময়োপযোগী ও কল্যাণমুখী বাজেট হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বিভিন্ন দিক খেকে বিভিন্ন ব্যক্তি। সমস্যা অন্যত্র।

বাজেটে যে প্রভাবটুকু সাধারণ জনগণের ওপর আসার কথা তার চেয়ে বেশি আসে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে, যার নিয়ন্ত্রণ সরকারের পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে বাজেট একটি আতঙ্কের নাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে সাধারণ জনতার কাছে। গত ৯ জুন মহান জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন। করোনাকালীন ও সম্প্রতি চলমান যুদ্ধকে সামনে রেখে ৬,৭৮,০৬৪ কোটি টাকার একটা বিশাল অঙ্কের বাজেট উপস্থাপন করেছেন। যার মধ্যে আয় ৪,৩৬,২৭১ কোটি টাকা ও ঘাটতি ২,৪৫,০৭৬ কোটি টাকা। ঘাটতি বাজেট সমন্বয় করার কথা বলা হয়েছে অনুদান, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে।

প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দের মধ্যে ১৪.৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রযুক্তি, ১১.৯ সুদ, পরিবহন ও যোগাযোগ ১১.৮, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ৬.৬, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ৩.৯, স্বাস্থ্য ৫.৪, কৃষি ৩,৮, প্রতিরক্ষা ৫.০, জনপ্রশাসন ৭.৩, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ ৪.৯, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ৪.৪, গৃহায়ন ১.০, বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম ০.৮, শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিস ০.৬, পেনশন ৪.৬, ভর্তুকি ও প্রণোদনা ৮.৪ ও বিবিধ ব্যয় ৪.৯ শতাংশ।

প্রতি বছরই বাজেটে নতুন কিছু চমক থাকে। এবারের বাজেট বিশ্লেষণে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়টি হলো পাচারের টাকা ফেরত আনলে দায়মুক্তি। প্রস্তাবিত বিধান অনুযায়ী বিদেশে অবস্থিত যেকোনো সম্পদের ওপর কর পরিশোধ করা হলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ যেকোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করবে না। বিদেশে অর্জিত স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে এর ওপর ১৫ শতাংশ, বিদেশে থাকা অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে ১০ শতাংশ ও বাংলাদেশে পাঠানো নগদ অর্থের ওপর ৭ শতাংশ হারে করারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ সুবিধা ২০২২-এর ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। মূল কথা হলো- এটি এক বছরের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এ প্রস্তাবটি দিয়ে দেশে কী পরিমাণ টাকা ফেরত আসবে তা ভাবনার বিষয় ? সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশে পাচার করা ফেরত আনার একটি কৌশল হতে পারে এটা। কিন্তু এ প্রস্তাবের ফলে পাচারকারীরা আরো উৎসাহী হতেও পারে।

সত্যিকার অর্থে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বাজেট বাস্তবায়ন করা চ্যালেঞ্জ তার পরও দুর্নীতি একটা বড় সমস্যা। বর্তমান পৃথিবী এগিয়ে চলছে খাদ্য সংকটের দিকে সে ক্ষেত্রে কৃষি আমাদের মূল ভরসার জায়গা। সরকার সে ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। চলতি বছরে বরাদ্দ ছিল ১৮ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা, যা প্রস্তাবিত বাজেটে বৃদ্ধি করে প্রস্তাব করা হয়েছে ২৪ হাজার ২২৪ কেটি টাকা। এ বাজেট সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হলে কৃষির অবস্থান আরো সুসংহত হবে, এটা নিশ্চিত। আমাদের মনে রাখতে হবে কৃষিপ্রধান এ দেশের জিডিপির মূল জায়গা হচ্ছে কৃষি এবং বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলে বাজেটের পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করে কৃষিকাজকে আরো জোরদার করতে হবে। আমাদের মতো নিম্ন আয়ের দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা মানুষগুলোর সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন।

প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ৫ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা অত্যন্ত ইতিবাচক। সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা গেলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করা নিম্ন আয়ের মানুষগুলো বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখবে এবং সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বিষয়গুলো এগিয়ে যাবে একধাপ। স্বাস্থ্য খাতের বাজেটে যে পরিমাণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন ছিল সে পরিমাণে বৃদ্ধি করা হয়নি। ৪ হাজার ১৩২ টাকা বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশেষ করে করোনাকালীন সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ওপর প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নির্ভর হয়ে পড়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা এই যে এ খাতে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব দেখেছে এ দেশের জনগণ। তাই এবারের বাজেটের বরাদ্দ করা টাকা সঠিকভাবে ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি।

২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচনে ওয়ার্ল্ড এডুকেশন ফোরাম এডুকেশন ২০৩০-এর এজেন্ডা ঘোষণা করে যেখানে সদস্য দেশগুলোকে বাজেটের ১৫-২০ শতাংশ বা জিডিপির ৪-৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এসডিজির চতুর্থ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শিক্ষার প্রতি বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ বাজেটে শিক্ষা খাতে সে পরিমাণ বরাদ্দ রাখা হয়নি। বিশেষ করে শিক্ষার নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন ও করোনা-পরবর্তী শিক্ষার ভেঙে পড়া অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। প্রতিবার বাজেট এলেই যে জিনিসটা নিয়ে কথা বলা হয় কিন্তু সে পরিমাণ কাজে আসে না তা হলো কর্মসংস্থান বৃদ্ধি। আমরা যত কথাই বলি না কেন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা না গেলে অর্থনৈতিক উন্নতি যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সামাজিক বিশৃঙ্খলা রোধ করাও সম্ভব নয়। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হবে। বেসরকারি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হলে সরকারকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে দেশের যুবসমাজের বিপথে যাওয়া রোধ হবে।

আরেকটি বিষয় সবার অন্তরালেই থেকে যায় তা হলো বিনোদন ও সংস্কৃতি খাত। খুর একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি কোনো সময়ই। কিন্তু এ খাতে বিনিয়োগ করে সংস্কৃতিপ্রেমী জাতি হিসেবে আমাদের গড়ে তোলা জরুরি। বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে আরো বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন ছিল। এবারের বাজেটে এ খাতে চলতি বছর থেকে মাত্র ২৭৪ কোটি টাকা বৃদ্ধি করে প্রস্তাব করা হয়েছে। এ খাতকে আরো অগ্রসর করার ক্ষেত্রে বাজেট বাড়িয়ে সুনজর দেওয়া প্রয়োজন। কারণ এ খাত থেকে বাংলাদেশের যথেষ্ট পরিমাণে আয় করা সম্ভব। বর্তমান সময়ে বাজেটের মূল সমস্যাটা হলো মূল্যস্ফীতি ও আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিতিশীলতা এবং করোনার কারণে ভঙ্গুর অর্থনীতি। এসব বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সত্যিকার অর্থে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন যেকোনো সরকারের পক্ষেই কঠিন। এ ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ সরকারের দূরদর্শিতা প্রমাণ করে। এটুকু বলা যায়, যা হয়েছে তা ভালোই হয়েছে কেবল বাজেটে উত্থাপিত খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে

অতিক্রম করে সরকার বাজেট বাস্তবায়নে জোর দেবে- এটাই সবার প্রত্যাশা।

লেখক : প্রভাষক, আলীনগর কারিগরি ও বাণিজ্যিক কলেজ, ঈশ্বরগঞ্জ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close