হীরেন পণ্ডিত

  ৩০ জুন, ২০২২

পর্যবেক্ষণ

অর্থনীতিতে নতুন ভূমিকায় পদ্মা সেতু

বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি বহুল কাঙ্ক্ষিত বা প্রতীক্ষিত একটি দিন ২৫ জুন ২০২২। গৌরবের দিন! কারণ নতুন সম্ভাবনা ও নতুন দিগন্ত নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে পদ্মা সেতু। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো বিশ্বের জন্যই এক বিস্ময়।

পদ্মা সেতুর ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ধরা হলেও, ব্যয় হয়েছে ২৭ হাজার ৭৩২ কোটি ৮ লাখ টাকা বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন টাওয়ার ও গ্যাসলাইনের ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়সহ মূল সেতু নির্মাণে ব্যয় ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ধরা হলেও ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৯৩৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া নদীশাসনে ৮ হাজার ৭০৬ কোটি ৯১ লাখ, অ্যাপ্রোচ সড়কে ১ হাজার ৮৯৫ কোটি ৫৫ লাখ, পুনর্বাসনে ১ হাজার ১১৬ কোটি ৭৬ লাখ এবং ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৬৯৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।

পদ্মা সেতু হওয়ায় ৬ খাতে বিপ্লব ঘটবে। এগুলো হলো- সংযোগ স্থাপন, ব্যবসা-আঞ্চলিক বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প, পর্যটন এবং সামাজিক খাত। তবে এসব সফলতা এমনি এমনিই আসবে না। যেমনটি আসেনি যমুনা সেতুর ক্ষেত্রে। পদ্মা সেতু থেকে সুফল পেতে পদ্মা প্লাস পলিসি তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং ব্যবসার খরচ কমাতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা প্রয়োজন।

পদ্মা সেতুর কারণে আগামী ৫ বছরে ১০ লাখ এবং ১০ বছরে ওইসব জেলায় ৩০-৪০ লাখ নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে। শুধু বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলায় আগামী ১০ বছরে ৫০০-১০০০ নতুন কারখানা স্থাপন হবে। ফলে ১০ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা যোগ হবে দেশের অর্থনীতিতে। এই সেতু চালু হওয়ার পর ভারত ও নেপাল থেকে পর্যটক সংখ্যা বাড়বে। পর্যটনশিল্পে বিপ্লব ঘটবে। সেতুর কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্য কমবে ১.০১ শতাংশ। জাতীয়ভাবে দারিদ্র্য কমবে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সহজলভ্য হওয়ায় ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরের ওপর চাপ কমবে। বিশ্বব্যাংকের বরাত দিয়ে প্রবন্ধে বলা হয়, ৩ কোটি মানুষ পদ্মা সেতুর কারণে সরাসরি উপকৃত হবে। কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত হবে। কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ কমবে। কৃষিভিত্তিক শিল্পের বিকাশ ঘটবে। এ সেতু হওয়ায় ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মনিপুর, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ এবং নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে পশ্চিম বাংলার যোগাযোগ অনেক সহজ হবে। ফলে তারা এ সেতুকে অর্থনৈতিক করিডর হিসেবে ব্যবহার করায় বৈদেশিক মুদ্রায় আয় হবে। সেতুটির ফলে সরাসরি সড়ক ও রেলসংযোগ স্থাপিত হবে। ফলে মোংলা, পায়রা, এশিয়ান হাইওয়ে, ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কসহ ভারতের ৭টি প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যাতায়াতের সময় ও দূরত্ব কমে আসবে।

এডিবির মতে, আগামী ৩১ বছরে যোগাযোগ খাতে পদ্মা সেতু থেকে আয় হবে ১৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, যা নির্মাণ খরচের ৫ দশমিক ৫ গুণ। এ ছাড়া সামাজিক অগ্রগতি অর্থনীতিতে যোগ করবে ২৫ বিলিয়ন ডলার। দুই পাড়ে নদীশাসনের মাধ্যমে যে জমি রক্ষা হয়েছে তার মূল্য প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সেতুর মাধ্যমে বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং ইন্টারনেট লাইন গিয়ে সাশ্রয় করবে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ফেরি চলাচল না হওয়ায় খরচ সাশ্রয় হবে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

পদ্মা সেতু দেশের বর্তমান দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সঙ্গে আরো অতিরিক্ত যোগ হবে ৪৮ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছর গড়ে প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১ দশমিক ২ থেকে ২ শতাংশ হারে। জিডিপির আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি বছর সেতুর কারণে যোগ হওয়া অর্থও বাড়বে। পদ্মা সেতুর প্রভাবে অর্থনীতিতে এই পরিবর্তন হবে। ফলে অর্থনীতির আকার আরো বড় হবে।

এদিকে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, পদ্মা সেতুর কারণে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১ দশমিক ৪ থেকে ১ দশমিক ৬ শতাংশ হারে। তবে এই সুবিধা পেতে হলে সেতুর দুই পাড়েই যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। সড়কগুলো আরো প্রশস্ত করতে হবে। অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়াতে হবে।

পদ্মা সেতুর কারণে প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়লে আগামী অর্থবছরে এতে যোগ হবে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৩ শতাংশ হলে যোগ হবে ৫২ হাজার কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ শতাংশ হলে যোগ হবে ৬৪ হাজার কোটি টাকা এবং প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ হলে যোগ হবে ৮০ হাজার কোটি টাকা।

২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৪৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপিতে অর্থ যোগ আরো বাড়বে। ১ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে জিডিপিতে যোগ হবে ৫৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ শতাংশ হলে যোগ হবে ৬৬ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ শতাংশ হলে জিডিপিতে যোগ হবে ৭১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে জিডিপিতে যোগ হবে ৮৯ হাজার কোটি টাকা। মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর আওতায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৫৬ লাখ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরেও জিডিপিতে আনুপাতিক হারে অর্থ যোগ হবে। এ ছাড়া সেতুটি ভবিষ্যতে ট্রান্স-এশীয় রেলপথের অংশ হবে। তখন যাত্রীবাহী ট্রেন যত চলবে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি চলবে মালবোঝাই ট্রেন। ডাবল কনটেইনার নিয়ে ছুটে চলবে ট্রেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হবে মোংলা ও পায়রা বন্দর। অর্থনীতিতে যুক্ত হবে নতুন সোনালি স্বপ্ন এবং দেশের প্রবৃদ্ধিতে এ সেতু ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সড়ক ও রেল- দুই পথেই দক্ষিণ বাংলার মানুষ অল্প সময়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবে। সেতুটির কারণেই প্রথমবারের মতো পুরো দেশ একটি সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোতে চলে আসবে। দক্ষিণ বাংলার গ্রামেও পরিবর্তনের হাওয়া লাগবে। এ অঞ্চলের কৃষক, মৎস্যজীবী, তাঁতি, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভোক্তার সমাবেশ যে রাজধানী ঢাকা, তার সঙ্গে অনায়াসে সংযুক্ত হতে পারবেন। অন্যদিকে তারা রাজধানী থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে পারবেন তাদের গ্রামের ও আশপাশের এসএমই উদ্যোগগুলোর জন্য। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু হবে শুনেই ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত হতে শুরু করেছে। পদ্মা সেতুর দুই পাড়েই এক্সপ্রেসওয়ের পাশের জমির দাম তিন-চার গুণ বেড়ে গেছে।

নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, আবাসন প্রকল্প, রিসোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক, মানবসম্পদ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রেস্টুরেন্ট ও নানা ধরনের এসএমই উদ্যোগ স্থাপনের হিড়িক পড়ে গেছে। খুলনা ও বরিশালে জাহাজ নির্মাণশিল্পের প্রসার ঘটতে শুরু করেছে। কুয়াকাটায় পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটছে দ্রুতগতিতে। আগামী দিনে বিকাশের এ ধারা আরো বেগবান হবে। কৃষিসহ দক্ষিণাঞ্চলের সামগ্রিক উৎপাদন, সেবা, পর্যটন, শিল্প-বাণিজ্যেও বিনিয়োগ বাড়বে। বাড়বে কর্মসংস্থান। আর সেটা হলে এখন যে জলবায়ু চ্যালেঞ্জের শিকার অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসে ঝুঁকিপূর্ণ অনানুষ্ঠানিক কাজকর্ম করতে বাধ্য হচ্ছে, তাদের সংখ্যা কমে আসবে। দক্ষিণ বাংলায় নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। নতুন নতুন শহরও গড়ে উঠবে।

পদ্মা সেতুকে ঘিরে পদ্মার দুই পাড়ে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে শহর গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা রয়েছে। নদীর দুই তীরে আসলেই আধুনিক নগর গড়ে তোলা সম্ভব। তবে সেজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে যাবে। আর প্রতি বছর দারিদ্র্য নিরসন হবে শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ। এর মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়নে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় ৬ কোটি মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন আনবে পদ্মা সেতু। একসময় দেশের উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা দেখা দিত। এখন মঙ্গার কথা আর তেমন একটা শোনা যায় না। বঙ্গবন্ধু সেতু উত্তরাঞ্চলের এই মঙ্গা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ঠিক একইভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো এখনো শিল্পের দিক দিয়ে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। এ এলাকার বেশ কটি জেলার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ শেষ হলে সবার আগে উপকার হবে এই পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর। কারণ পদ্মা সেতুর কল্যাণে ওইসব এলাকায় ব্যাপক আকারে শিল্পায়ন হবে, লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। মানুষের আয় বাড়বে এবং জীবন-জীবিকায় পরিবর্তন আসবে।

২০৩৫-৪০ সালে বাংলাদেশ যে উন্নত দেশ হবে, সে ক্ষেত্রে এই সেতু নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, স্বপ্নের এ সেতুকে কেন্দ্র করেই সেতু অর্থনীতির সেতুবন্ধ ও নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করবে।

বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের পথে। তা ছাড়া পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতুই নয়, এটি আমাদের উন্নয়ন, অহংকার, অহংকারের প্রতীক। আত্মমর্যাদা, আত্মপরিচয়, যোগ্যতা সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রত্যয়ের ফসল। বিশ্বের অন্যতম সুখী দেশের পথে বাংলাদেশও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে নির্মিত হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close