মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান

  ২৯ জুন, ২০২২

বিশ্লেষণ

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পই অর্থনীতির মেরুদণ্ড

শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, দারিদ্র্যমোচন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে এসএমই তথা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ভূমিকা ও অবদান আজ বিশ্বব্যাপী একটি স্বীকৃত বিষয়। পৃথিবীর উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত নির্বিশেষে সব দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিতে এসএমই খাতের গড় অবদান শতকরা ৫০ ভাগের বেশি হলেও বাংলাদেশের জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান শতকরা ২৫ ভাগ। তবে বাংলাদেশে শিল্প খাতের মধ্যে এসএমই খাতে কর্মসংস্থানের পরিমাণ প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ। কাজেই এসএমই খাত অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের গুরুত্ব অনুধাবন করে সেই ১৯৫৭ সালে প্রাদেশিক সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম ও ভিলেজ এইড মন্ত্রী থাকাকালে ইস্ট পাকিস্তান কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন বা ইপসিক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা বাংলাদেশে পরবর্তী সময়ে বিসিক নামে পরিচিতি পায়। বিসিক থেকে উদ্যোক্তাদের জন্য শিল্প স্থাপনের জন্য প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের আরো বিকাশ ত্বরান্বিত করার জন্য ২০০৭ সালে এসএমই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়।

কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতকে আরো এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ২০১৭ সালে জাতিসংঘ ২৭ জুনকে ‘আন্তর্জাতিক এমএসএমই দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার পর থেকে প্রতি বছর সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ‘আন্তর্জাতিক এমএসএমই দিবস’ উদযাপন করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে এ বছর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে ‘আন্তর্জাতিক এমএসএমই দিবস ২০২২’ উদযাপন করা হচ্ছে। এটি শিল্প খাত বিশেষ করে এসএমই খাতের বিকাশে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার প্রতিফলন। ‘আন্তর্জাতিক এমএসএমই দিবস ২০২২’ উদযাপন বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে দেশের এসএমই উদ্যোক্তাদের অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করছে। এ ঘটনা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে এমএসএমই উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণকে আরো বেশি উৎসাহিত করবে।

এসএমই ফাউন্ডেশন দেশের এসএমই খাতের সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার প্রণীত শিল্পনীতি, এসএমই নীতিমালা-২০১৯, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, এসডিজি-২০৩০, রূপকল্প-২০৪১ এবং নির্বাচনী ইশতেহার, অন্যান্য নীতিমালা, কৌশলপত্র ও সরকারের নির্দেশনার আলোকে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ফাউন্ডেশন এসএমইবান্ধব ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টি ও উদ্যোক্তা উন্নয়নের লক্ষ্যে গবেষণা ও পলিসি অ্যাডভোকেসি, এসএমই ক্লাস্টার উন্নয়ন, প্রযুক্তি উন্নয়ন, আইসিটি, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন, অ্যাকসেস টু ফাইন্যান্স ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এ ছাড়া উন্নয়নের মূলস্রোতধারায় নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে আসা ও তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এসএমই ফাউন্ডেশন নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পৃথক কর্মসূচি পরিচালনা করছে। সরকারের উন্নয়ন রূপকল্পগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০২৪-এর মধ্যে জাতীয় আয়ে (জিডিপি) এসএমই খাতের অবদান বিদ্যমান শতকরা ২৫ থেকে ৩২ শতাংশে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে এসএমই নীতিমালা ২০১৯ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সমতাভিত্তিক অর্থনীতি’ তৈরি করার উদ্দেশ্যে নারী উন্নয়ন, যুবসমাজের উন্নয়ন ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উন্নয়নসহ গ্রাম উন্নয়নের মাধ্যমে এ দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য নানামুখী কর্মসূচি প্রদান করেন। ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ ও ‘সমতার অর্থনীতির’ দর্শন নিয়ে স্বাধীনতার পর এ দেশকে আত্মনির্ভরশীল করার জন্য সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে জাতীয় উন্নয়নের জন্যই প্রাইভেট সেক্টরকে উৎসাহিত করা হয়। আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য সরকার ধীরে ধীরে অর্থনীতিকে বিরাষ্ট্রীয়করণ করে এবং সবস্তরের জনসাধারণের অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করে। এ কাজের শুরুতে সরকার প্রথমে গ্রাম উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প তৈরি ও তার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষুদ্রঋণ সুবিধা পাওয়ার ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রশিল্পের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ খাত ব্যক্তি-মালিকানাকে উৎসাহিত করে, মানুষের সৃষ্টিশীল শক্তিকে প্রকাশ করে এবং গতিশীল অর্থনীতির মেশিন হিসেবে কাজ করে। এজন্যই ক্ষুদ্রশিল্প খাতকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে বিবেচনা করে সরকার শিল্পনীতি প্রণয়ন করেছে এবং সামগ্রিকভাবে শিল্প খাতের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

টেকসই শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এসএমই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে। সরকার গৃহীত এসএমই নীতিকৌশল বাস্তবায়নে সহায়তা, শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এই ফাউন্ডেশন কাজ করছে। নারী ও সব শ্রেণির এসএমই উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত, উদ্বুদ্ধ এবং জাতীয়পর্যায়ে সুসংগঠিতকরণসহ এসএমইদের উন্নয়নে ফাউন্ডেশন অবদান রাখছে। এই ফাউন্ডেশনের ভিশন হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে অধিক কর্মসংস্থান, জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং সর্বোপরি দারিদ্র্যমোচন এবং মিশন হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং বিশ্বায়নের বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার লক্ষ্যে জাতীয় অর্থনীতিতে বিদ্যমান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশে বহুমুখী কর্মসূচি পরিচালনার মাধ্যমে নিয়মিতভাবে সহায়তা প্রদান।

গত এক দশকে দেশে অভূতপূর্ব অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, যার সুফল দেশবাসী পাচ্ছেন। মেট্রোরেল, পদ্মা বহুমুখী সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী নদীতে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো স্থাপনার সুফল অচিরেই মানুষ ভোগ করবে। রপ্তানি বাণিজ্যে গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে আমাদের সরকার পায়রা বন্দর ও মাতারবাড়ী সংলগ্ন এলাকায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজ দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলে বাংলাদেশের জিডিপি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে।

নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেছেন। এত কম সময়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের মতো বড় প্রকল্প সম্পন্ন করতে পারা আমাদের সক্ষমতার পরিচায়ক। পদ্মা সেতু চালুর ফলে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যুক্ত হবে। দেশের যোগাযোগব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। পদ্মা সেতুর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। সেতুর দুপাশে গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা। ফলে দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানও দিন দিন বেড়ে যাবে।

টেকসই ও গুণগত শিল্পায়ন বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত রূপকল্প ২০২১ ও রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন ও শিল্প খাতের গুণগত পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে যাচ্ছে। ফলে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ক্রমেই বাড়ছে। এরই মধ্যে জিডিপিতে সার্বিক শিল্প খাতের অবদান শতকরা ৩২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। দেশে বর্তমানে প্রায় ৭৮ লাখ এসএমই শিল্প গড়ে উঠেছে। এসব এসএমই শিল্প জিডিপিতে শতকরা ২৫ ভাগ এবং শিল্প কর্মসংস্থানে শতকরা ৮০ ভাগ অবদান রাখছে। এসএমই খাতের ক্রমবিকাশমান ধারা অব্যাহত রেখে আমরা এরই মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ তথা এলডিসির তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছি।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পায়নের নতুন ধারা সূচনা হয়েছে। এ ধারার সঙ্গে খাপ খাইয়ে জ্ঞানভিত্তিক শিল্পায়নের যাত্রা জোরদার করতে শিল্প মন্ত্রণালয় তথা সরকার কাজ করছে। শিল্প খাতের যথোপযুক্ত বিকাশের লক্ষ্যে শিল্প মন্ত্রণালয় ও সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভব সব ধরনের নীতি সহায়তা প্রদান অব্যাহত রয়েছে। এলাকাভিত্তিক কাঁচামাল ও শিল্প সম্ভাবনা বিবেচনা করে তৃণমূলপর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্প গড়ে তোলার প্রতি অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব সবুজ শিল্পায়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে বাস্তবে রূপায়ণের লক্ষ্যে কার্যক্রম চলছে। এ ক্ষেত্রে এসএমই খাতকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে প্রণয়নকৃত ‘এসএমই নীতিমালা ২০১৯’ সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ওই নীতিমালায় সরকারের উন্নয়ন রূপকল্পগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০২৪ সালের মধ্যে জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান বিদ্যমান শতকরা ২৫ থেকে ৩২ শতাংশে উন্নীতকরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

এসএমই নীতিমালায় উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে অর্থপ্রাপ্তির সুবিধা, প্রযুক্তি সহায়তা, বাজারে প্রবেশের সুবিধা, বিজনেস সাপোর্ট, তথ্যপ্রযুক্তি প্রভৃতি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। এসএমই খাতের উন্নয়নে ও এসএমই নীতিমালা বাস্তবায়নে এসএমই ফাউন্ডেশন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ফাউন্ডেশন এ পর্যন্ত সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে ওঠা ১৭৭টি শিল্প ক্লাস্টার চিহ্নিত করেছে। এসব ক্লাস্টারের চাহিদার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট শিল্প উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান, স্বল্প সুদে জামানতবিহীন অর্থায়ন, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। উদ্যোক্তাদের স্বার্থে ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মসূচি আরো সম্প্রসারণ করা হবে। আমাদের দেশের মোট এসএমই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রায় ৭১ শতাংশই গ্রামে অবস্থিত। তাই গ্রামীণ অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করার মধ্য দিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

লেখক : সিনিয়র তথ্য অফিসার, শিল্প মন্ত্রণালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close