শাহনাজ বেগম
মুক্তমত
মেডিটেশন থাকুক ভ্যাটমুক্ত
মানুষ প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ আর প্রকৃতির ছন্দকে অনুভব করতে পারা এবং সেই ছন্দে নিজের চলাফেরা, কাজকর্ম, খাওয়া-দাওয়া তথা জীবনাচারকে পরিচালিত করতে পারলে পৃথিবীটাই তখন মানুষের কাছে স্বর্গসম বোধ হতে পারে। তবে এর জন্য চাই প্রশান্ত মন। বর্তমান বিশ্বে মানুষের তথাকথিত যান্ত্রিক জীবনে বড়ই অভাব পড়ে যাচ্ছে এই প্রশান্ত মনের। বহুবিধ দুশ্চিন্তা আর নিরন্তর লেটেস্টটা পাওয়ার আকাক্সক্ষা মানুষকে অস্থির করে রেখেছে। এসবের মধ্য থেকে ধ্যানচর্চার মধ্য দিয়ে মানুষ জীবনে কিছুটা স্বস্তি খুঁজে পায়, মন প্রশান্ত হয়। আর প্রশান্ত মনের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় সে জীবনে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয় সুস্বাস্থ্য ও সাফল্যের সূত্রগুলোকে।
আমি একসময় এ বিষয়ে কিছুই জানতাম না। কিন্তু যখন ধ্যান করার প্রক্রিয়া শিখে এর অনুশীলন করতে থাকলাম দিনের পর দিন, ধীরে ধীরে অনুভব করতে থাকলাম নিজের পরিবর্তন। এরপর সত্যি সত্যি অন্যদের কাছেও আমার এসব পরিবর্তন সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকল ক্রমাগত, যা রয়েছে চলমান। একটা উদাহরণ না উল্লেখ করলেই নয়, যেমন স্কুলজীবনকে মাইগ্রেনের ব্যথায় দুর্বিসহ লাগত, ডাক্তারের বক্তব্য ছিল কখনো ভালো হওয়ার নয়। ব্যথা শুরুর দিকে ওষুধ খেয়ে নেবেন, চলবে আমৃত্যু। যত বয়স বাড়ছিল, ততই বাড়ছিল এ ব্যথার ভয়াবহতা আর স্থায়িত্বকাল। পড়াশোনা শেষ হলো, বিয়ে হলো, সন্তান হলো আর ক্রমাগত ব্যথা এবং ব্যথার সময়কাল বাড়তে থাকল। এ ব্যথার জন্য আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করত, কিন্তু সন্তানদের ভাবনায় তা পারতাম না। মেডিটেশন শেখার পর ২-৩ বছরে কমতে কমতে কখন যেন এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে গেলাম। এখন বয়স প্রায় ৫৩ বছর, সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম যে কখনো আমার মাইগ্রেন ছিল। গত ৮-১০ বছরের মধ্যে এই ব্যথা আর হয়নি।
আজ মেডিটেশনের ওপর ভ্যাট আরোপের প্রস্তাবের খবরে মনে পড়ে গেল যে, স্বাস্থ্যসেবায় সম্পৃক্ত কত শত ডাক্তার আমাকে মাইগ্রেন পেইন থেকে মুক্তির উপায় বলতে না পারলেও মেডিটেশন আমাকে মুক্তি দিয়েছে। তাহলে কেন স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে মেডিটেশন সেবা ভ্যাটমুক্ত থাকবে না? আমার বেশ কয়েকটি শারীরিক সমস্যা ছিল, আল্লাহর রহমতে সবই ভালো হয়েছে। ধৈর্য বেড়েছে, মানুষকে ক্ষমা করতে পারার মতো মন সৃষ্টি হয়েছে, আল্লাহ ও রাসুলের (সা.) প্রতি অনুরক্ত হতে পেরেছি- এতসব সম্ভব হয়েছে এ ধ্যানের অনুশীলনের মধ্য দিয়ে। আমিই আমার জীবনের পরিবর্তনের বড় প্রমাণ ধ্যানের কারণে। শুধু আমি কেন আমার চেনা-জানা অসংখ্য মানুষ এখন মেডিটেশনের অনুশীলন করে মাইগ্রেনমুক্ত প্রাণোচ্ছল জীবনের সন্ধান পেয়েছে। আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা সবাই এখন নিয়মিত ধ্যান করি। যে কাউকে আমি আমার সঙ্গে ও আমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে আমন্ত্রণ জানাতে পারি। আমার জীবনের প্রশান্তি, সুস্থতা আর সাফল্যের একমাত্র টুলস হচ্ছে নিয়মিত মেডিটেশন, যার পথ ধরে আল্লাহর রহমতকে অনুভব করতে পারছি। শোকর আলহামদুলিল্লাহ।
বিশ্বজুড়ে নাইকি, গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যাপলের মতো খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করছে মেডিটেশন চর্চায়। এর পাশাপাশি কর্মীদের কিছু সময়ের জন্য মৌনতাচর্চায়ও উৎসাহিত করছে তারা। তাদের মতে, এতে কর্মীদের উৎপাদনশীলতা ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কমেছে অসুস্থতাজনিত ছুটি ও চিকিৎসাব্যয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিয়মিত মেডিটেশন চর্চা করে কর্মীরা অন্তর থেকে সুখী হয়ে ওঠে। ফলে কর্মস্থলের পরিবেশ থাকে সুন্দর। প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনে কর্মীরা থাকে আন্তরিক। বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের যোগ-ধ্যানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছেন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা। ফলে প্রতিষ্ঠানে সুন্দর কর্মছন্দ এসেছে। মৌসুমী ইন্ডাস্ট্রিজ, রিভ সিস্টেম, লা-রিভ ফ্যাশন হাউস, পিপলস্ পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড ইত্যাদি দেশের নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রতিদিনের কর্মপ্রবাহ শুরু করে মেডিটেশনের মাধ্যমে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের আলেকজান্দ্রিয়ায় সুপরিচিত একটি বিদ্যালয় জর্জ ওয়াশিংটন মিডল স্কুল। এই বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক ডেজিরি ম্যাকনাট এবং এলকিন রড্রিগেজ। ২০১৯ সালে সিক্সথ গ্রেডের (১১-১২ বছর বয়সি) ১৭৫ শিক্ষার্থীকে তারা প্রতিদিন শ্রেণিকক্ষে মেডিটেশন করালেন। বছর শেষে দেখা গেল- এই ক্লাসের শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষার্থীদের চেয়ে অনেক বেশি প্রাণবন্ত, দুশ্চিন্তামুক্ত এবং নতুন কিছু শেখার ব্যাপারে অধিক মনোযোগী। তারা পরস্পরের প্রতি সমমর্মী ও শ্রদ্ধাশীল। দুরন্ত শিক্ষার্থীরাও অন্যদের আগের চেয়ে বুলিং কম করছে। টিমওয়ার্ক ও পড়াশোনায় একে অন্যকে আগের চেয়ে বেশি সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া দীর্ঘ গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, মেডিটেশন চর্চার ফলে শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট ভালো হয়। দৃষ্টিভঙ্গি হয় ইতিবাচক। মনোযোগ ও পড়া মনে রাখার সামর্থ্য বৃদ্ধি পায়। গণিত ও বিজ্ঞানের জটিল বিষয় সহজে বোঝার দক্ষতা সৃষ্টি হয় এবং নৈতিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে।
একডজনেরও বেশি গবেষণা করে গবেষকরা বলছেন, নিয়মিত মেডিটেশন করা শিক্ষার্থীদের চেয়ে শিক্ষকদের করা আরো বেশি প্রয়োজন। কারণ, এতে শিক্ষকদের স্ট্রেস কমে, আচরণ নিয়ন্ত্রণে আসে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে। আত্মবিশ্বাস, সমমর্মিতা ও ধৈর্য বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। শারীরিক সুস্থতা বৃদ্ধির ফলে ধ্যানী শিক্ষকদের অনুপস্থিতির হার কম। শ্রেণিকক্ষের পাঠদানের সময় শিক্ষার্থীদের প্রতি তারা থাকেন তুলনামূলক বেশি মনোযোগী ও মমতাময়।
অধ্যাপক ডা. এম ইউ কবীর চৌধুরী, যিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত, তিনি বলেন, ‘দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত রোগীরা মেডিটেশনের মাধ্যমে স্ট্রেসমুক্ত ও সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন। তাদের আমি বলি- মেডিটেশন করুন, ভালো থাকবেন।’
অধ্যাপক ডা. নিজামউদ্দিন আহমেদ যিনি প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, তিনি বলেন, ‘মেডিটেশন করলে শরীর শিথিল হয়, মনে প্রশান্তি আসে, টেনশন দূর হয়, হার্টবিট ও রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে। তাই মেডিটেশন করুন সুস্থ থাকুন।’ এখন কথা হচ্ছে, যেকোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ যখন এত এত উপকার পাচ্ছে একটু ধ্যান করে তখন কেন এই সর্বজনীন বিষয়টির ওপর ভ্যাট আরোপ হবে? বরং স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে ধ্যানকে কী উপায়ে আরো আরো বেশি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যায় সেই ব্যবস্থা নিয়েই ভাবা উচিত সরকারের। জোর দাবি জানাচ্ছি এনবিআরের চেয়ারম্যানের কাছে এবং অর্থমন্ত্রীর কাছে যেন তাদের সুবিবেচনায় মেডিটেশন স্থায়ীভাবে ভ্যাটমুক্ত থাকে। আপামর জনতা সবাই এই সহজ টুলসকে জীবনে প্রয়োগ করে জীবনকে সহজ, সুন্দর ও সুস্থ করে তুলুক- সেই প্রার্থনাই থাক পরম করুণাময় কাছে।
লেখক : ভাইস পিন্সিপাল
সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মালিবাগ শাখা, ঢাকা
"