সাহাদাৎ রানা

  ২৮ জুন, ২০২২

মতামত

বাসযোগ্য হোক প্রিয় নগরী ঢাকা

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) একটি জরিপ প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে বাসযোগ্যতার বিচারে বিশ্বের ১৭২টি শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান ১৬৬তম স্থানে। ২০২১ সালে প্রকাশিত ১৪০টি দেশের মধ্যে ১৩৭তম স্থানে ছিল বাংলাদেশ। তালিকায় শেষের দিক থেকে সপ্তম স্থানে রাজধানী ঢাকার এক বছরে স্কোরের সামান্য উন্নতি হলেও এখানে জরিপে দেশের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। জরিপের ক্ষেত্রে কোন শহর কতটা বাসযোগ্য তা বোঝার জন্য স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং শহরের অবকাঠামো এই পাঁচ মানদণ্ডকে সামনে রেখে বিচার করে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। ১০০-ভিত্তিক সূচকে এবার ঢাকার স্কোর ছিল ৩৯ দশমিক ২। সর্বোচ্চ ৯৯ দশমিক ১ স্কোর নিয়ে সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা।

এ তথ্য প্রমাণ করে দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে প্রিয় ঢাকা। এখানে আরো একটি তথ্য আমাদের জন্য হতাশার। যে পাঁচটি সূচককে সামনে রেখে বিচার করা হয়েছে সেখানে অবকাঠামো ছিল অন্যতম। যেখানে ঢাকা সবচেয়ে কম ২৬ দশমিক ৮ স্কোর পেয়েছে অবকাঠামোতে, যা ১৭২টি শহরের মধ্যে সবচেয়ে কম। এমন তথ্যের পরও নগরবাসীর প্রত্যাশা তাদের প্রিয় ঢাকা হবে সবার প্রিয় শহর। অবশ্য ঢাকাকে বদলে দিতে হলে নিতে হবে অনেক ইতিবাচক উদ্যোগ। কারণ ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে নানা সমস্যা। ঢাকার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে হলে সবার আগে ঢাকা শহর সম্পর্কে কিছু বিষয় জানা প্রয়োজন। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। কারো কাছে প্রিয় শহরের নাম ঢাকা। আবার কারো কাছে অপ্রিয় শহরের নামও ঢাকা! প্রিয়-অপ্রিয় হলেও ঢাকার গুরুত্ব নাগরিক জীবনে কোনো অংশে কম নয়, বরং ব্যাপক। চার শ বছরের ঢাকার ইতিহাস অন্তত তাই বলে। এই দীর্ঘ সময়ের পথচলায় শুরু থেকে ঢাকার গুরুত্ব যেমন ছিল, দিন দিন সময়ের সঙ্গে সেই গুরুত্ব আরো বেড়েছে। এখনো বাড়ছে। তবে বাস্তবতা হলো গুরুত্ব বাড়লেও বর্তমানে ঢাকাকে ঘিরে মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক ধরনের অস্বস্তি। সেই অস্বস্তির পরিমাণও বাড়ছে। দু-তিন দশক ধরে ঢাকা এখন আর সবার কাছে প্রিয় শহর নয়। অনেকের কাছে বসবাসের অযোগ্য শহরের নাম ঢাকা!

যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য সে কথাই বলছে। এক পরিসংখ্যান বলছে- দেশের জনসংখ্যার প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের বাস ঢাকায়। একটা সময় ঢাকা শহর ফাঁকা থাকলেও এখন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। তার পরও দিন দিন হাজার হাজার মানুষ ঢাকা শহরে প্রবেশ করছে, যা নতুন নতুন সমস্যা তৈরিতে রাখছে ভূমিকা। তবে মানুষদের ঢাকায় প্রবেশের ক্ষেত্রে নিরোৎসাহিত করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে ঢাকার ওপর যেন আর চাপ না পড়ে। কারণ জনসংখ্যার চাপ ঢাকার অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করছে প্রতিনিয়ত। আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার চাপ সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। আয়তনের তুলনায় বেশি বসতির কারণে মানুষের মধ্যে স্বস্তি নেই। এত অল্প জায়গায় বিপুলসংখ্যক মানুষের বসবাসের সঙ্গে রয়েছে অযোগ্য হয়ে ওঠার মতো আরো অনেক উপসর্গ। বিশেষ করে যানজট, ধুলাবালি, ধোঁয়া, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ ও মশার যন্ত্রণা নগরবাসীর জন্য নিত্যদিনের সমস্যা।

বাস্তবতা হলো তার পরও মানুষ তার নাগরিক প্রয়োজনে ঢাকা শহরে বসবাস করে। স্বপ্ন দেখে ঢাকাকে ঘিরে। ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তুলতে হলে সবার আগে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে নির্দিষ্ট সমস্যা চিহ্নিত করে। বিশেষ করে মশা, পরিবেশ দূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, জলাবদ্ধতা ও যানজট। এগুলো হলো ঢাকায় বসবাসের জন্য প্রধান অন্তরায়। মশা এই মহানগরীর প্রধান সমস্যা। সব সময়, সব মেয়র মশা নিধনে রাখেন তাদের প্রধান টার্গেট। কিন্তু তার পরও মশা থেকে নগরবাসীর মুক্তি নেই। এরপর যে বিষয়টি সবার সামনে উঠে আসে সেটি হলো ফুটপাত দখল। বারবার কথা দিয়ে ফুটপাত দখলমুক্ত করতে পারেননি। এ ছাড়া বছর ধরে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির যন্ত্রণা তো রয়েছেই, সঙ্গে যানজটের সমস্যা। যানজটের কারণে বছরে ৮০ লাখের বেশি কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। কারণ, যানজটে মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। টাকার অঙ্কে বছরে যা প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কেউ সেভাবে ভেবে দেখে না।

সাম্প্রতিক সময়ে বায়ুদূষণ একটি বড় সমস্যা। নাগরিক জীবনে নতুন সমস্যা হলেও এর ইতিহাস অনেক দিনের। দিন দিন ঢাকার বায়ু এতটাই বিষাক্ত হয়েছে যে, ঢাকায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখে শত শত মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সেই ভয় আমাদের আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ একটু সচেতন হলে মনুষ্যসৃষ্ট এই দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব। বায়ুদূষণ বর্তমান নাগরিক সমাজে একটি অন্যতম প্রধান সমস্যাও। বিশেষত রাজধানী ঢাকাতে। সম্প্রতি একটি তথ্য আমাদের সেই ভাবনায় বাড়তি ভয় যোগ করেছে। বর্তমানে পৃথিবীর দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান শীর্ষে। কয়েক দিন আগে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও সম্প্রতি ঢাকার অবস্থান উঠে এসেছে শীর্ষে। এটাও বাসযোগ্য ঢাকা হওয়ার ক্ষেত্রে বড় একটি বাধা।

নাগরিক জীবনে আরো একটি সমস্যার নাম জলাবদ্ধতা। নাগরিক সমাজে যা একটি অসহনীয় যন্ত্রণার নাম। অথচ এ যন্ত্রণায় বৃষ্টির সময় আমরা ভুগে থাকি। কিন্তু কার্যকর কোনো সমাধান হয় না এ ক্ষেত্রে। যদিও সব সময়ই আমরা আশ্বাস পেয়েছি। আমাদের প্রিয় ঢাকা বাসযোগ্য না হওয়ার ক্ষেত্রে আরো কয়েকটি কারণ দায়ী, যা অনেক সময় আড়ালে থেকে যায়। বিশেষ করে ঢাকা শহর থেকে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি সরিয়ে আশপাশের জেলাগুলোতে সরিয়ে নেওয়া এখন সময়ের দাবি। এতে জেলায় জেলায় নতুন কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া যত্রতত্র গড়ে ওঠা স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভাগীয় শহরে ছড়িয়ে দিতে পারলে ঢাকার ওপর অনেকটা চাপ কমবে। এ ছাড়া অপরিকল্পিত দালানকোঠা পরিকল্পনার আওতায় এনে নির্মাণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। সবচেয়ে বড় যে সমস্যা তা হলো সঠিক নগর-পরিকল্পনার অনুপস্থিতি। ঢাকাকে বসবাসের উপযোগী করে তুলতে হলে আমাদের এসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হবে। পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হলো ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। অবশ্য এসব সমস্যা রাতারাতি সমাধান করাও সম্ভব নয়। তবে এ বিষয়ে সরকারকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনকে এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা- তাদের প্রিয় শহর ঢাকা হয়ে উঠবে পরিকল্পিত নগরী। হয়ে উঠবে বাসযোগ্য।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close