রেজাউল করিম খোকন

  ২৭ জুন, ২০২২

মুক্তমত

নাগরিক পেনশন নিয়ে কিছু কথা

সরকার সর্বজনীন নাগরিক পেনশন চালুর একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বাস্তবায়নের নীতিকৌশল প্রণয়ন করে আগামী বছরের জুলাই থেকে পাইলট স্কিম চালু করবে। ২০২২-২৩ সালের বাজেট তৈরির প্রাক্কালে সর্বজনীন নাগরিক পেনশনের বিষয়টি নিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে কিংবা ছয় মাসের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব সব নাগরিকের জন্য অবসরকালীন সুবিধা বা সর্বজনীন পেনশন চালু করতে যাচ্ছে সরকার। এ সময়ের মধ্যে আইন ও বিধি তৈরি করা হবে। একটি আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠন করে তার অধীনে চলবে এ পেনশন সুবিধা। শুরুর দিকে ব্যবস্থাটি ঐচ্ছিক রাখা হলেও পরবর্তী সময় এটি বাধ্যতামূলক করা হবে। তবে নিবন্ধিতরা ১০ বছর পর থেকে এর প্রত্যক্ষ সুফল পাওয়া শুরু করবেন। জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে দেশের ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি সব নাগরিকের জন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে সরকার। প্রবাসীরাও এ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। নিবন্ধিতরা ৬০ বছরের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পেনশন ভোগ করতে পারবেন।

দেশের শ্রমবাজারের ৮৫ শতাংশ জনবল অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত, প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাঠামো না থাকায় বৃদ্ধকালে তাদের জীবনযাপনে অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা আছে। তার দেওয়া ২০২০ সালে দেশে ষাটোর্ধ্ব জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ। এ সংখ্যা ২০৪১ সালে ৩ কোটি ১০ লাখ হবে বলে অনুমান। গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে ধীরে ধীরে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। নিরাপত্তাও ক্রমান্বয়ে হুমকির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এসব কারণেই সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা। সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু করার আগে এ-সংক্রান্ত আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে, যা চলতি বছরই বিল আকারে সংসদে তোলা হবে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি চালুর সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেয় হয়। সেই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীদের আপাতত নতুন জাতীয় পেনশন ব্যবস্থার বাইরে রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে সরকার যথাযথ সিদ্ধান্ত নেবে। প্রাথমিক এ পদ্ধতি প্রথমে স্বেচ্ছাধীন থাকবে, যা পরবর্তী সময়ে বাধ্যতামূলক করা হবে। সাধারণ মানুষ কীভাবে এবং কেমন সুবিধা পাবে, এমন একটি ধারণা দিয়ে এ ব্যবস্থার একটি অনুমানভিত্তিক হিসাব দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কোনো ব্যক্তি মাসিক চাঁদা ১ হাজার টাকা দিলে মুনাফা যদি ১০ শতাংশ ও আনুতোষিক ৮ শতাংশ ধরা হয়, তাহলে ১৮ বছর বয়সে যদি কেউ চাঁদা দেওয়া শুরু করে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত তা চালু রাখেন, তাহলে ওই ব্যক্তি অবসরের পর ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি মাসে ৬৪ হাজার ৭৭৬ টাকা পেনশন পাবেন। যদি ৩০ বছর বয়সে চাঁদা দেওয়া শুরু করে ৬০ বছর পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখেন, তাহলে অবসরের পর প্রতি মাসে তিনি ১৮ হাজার ৯০৮ টাকা পেনশন পাবেন। তবে চাঁদার পরিমাণ কমবেশি হলে আনুপাতিক হারে পেনশনের পরিমাণও কমবেশি হবে।

এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, একটি পেনশন আইনপ্রণয়ন ও আইনের আওতায় একটি পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন। এ পর্যন্ত এ আইনের খসড়ার বিষয়ে যা জানা যায়, তা হচ্ছে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট একটি চাঁদা দিয়ে পেনশনের জন্য নিবন্ধিত হবেন। ন্যূনপক্ষে ১০ বছর এ চাঁদার ধারাবাহিকতা থাকলে তারা নির্দিষ্ট বয়সসীমা অতিক্রম করার পর রাষ্ট্রীয় পেনশন পাওয়ার উপযুক্ততা অর্জন করবেন। তা ছাড়া বেসরকারি খাতকে পেনশনব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তিরও একটি পথরেখা করা হচ্ছে। পেনশন আইন ও এ-বিষয়ক নীতিমালা চূড়ান্ত করার আগে জনমত গ্রহণ ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে জনমিতির সুবিধা ভোগ করছে। আমাদের বর্তমান গড় আয়ু ৭৩ বছর, যা ২০৫০ সালে ৮০ ও ২০৭৫ সালে ৮৫ বছর হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, আগামী তিন দশকে একজন কর্মজীবী ব্যক্তির অবসর গ্রহণের পরও গড়ে ২০ বছর আয়ু থাকবে। বর্তমানে বাংলাদেশে নির্ভরতার অনুপাত ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০৫০ সালে ২৪ ও ২০৭৫ সালে ৪৮ শতাংশে উন্নীত হবে। গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার অনুপাত বিবেচনায় আমাদের বার্ধক্যের নিরাপত্তা হিসেবে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা খুবই জরুরি। এর আওতায় ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি সব কর্মক্ষম নাগরিক সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্যও থাকছে একই সুযোগ।

সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা সাধারণত চাকরিতে অবসর গ্রহণের পর এবং তার মৃত্যুর পর তাদের স্ত্রী ও পরিবারদের ভরণপোষণে বড় একটি সহায় হিসেবে বিবেচিত হয় পেনশন। বাংলাদেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের জন্য আলাদাভাবে পেনশন দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। এর বাইরে চাকরিজীবী নন যারা, ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা স্বাধীন কোনো পেশাজীবী তাদেরও বৃদ্ধ বয়সে পেনশন পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে যেখানে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা বাস্তবায়িত হয়েছে, সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে দেশের সব নাগরিকের জন্য পেনশন দেওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। যা নাগরিকদের জন্য বৃদ্ধ বয়সে এক ধরনের আর্থিক নিশ্চয়তা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতায় অসচ্ছল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বৃদ্ধভাতা, বিধবা-ভাতা, প্রতিবন্ধী-ভাতা প্রভৃতি কর্মসূচি চালু করেছে। যার আওতায় দেশের শহর ও গ্রামের বিশাল জনসংখ্যার একটি অংশ সামান্য হলেও মোটামুটি এক ধরনের আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন সরকারের কাছ থেকে। শুধু সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর পেনশন সুবিধা লাভ করলেও দেশের অবশিষ্ট চাকরিজীবী, পেশাজীবীরা সর্বজনীন পেনশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছেন। এবার প্রথমবারের মতো দেশে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে সরকার।

অতীতে এ রকম বৃহৎ কল্যাণমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। তবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সরকারের সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির আওতাভুক্ত হতে হলে ব্যক্তিপর্যায়ে প্রতিজনকে সর্বনিম্ন কত টাকা চাঁদা দিতে হবে তা নির্ধারণে সরকারকে অবশ্যই দেশের প্রান্তিকপর্যায়ে মানুষের আর্থিক সংগতি, সক্ষমতা বিবেচনায় রাখতে হবে। বাংলাদেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট হচ্ছেন নিত্যদিন, তাদের পক্ষে সংসারের যাবতীয় প্রয়োজনীয় খরচ মিটিয়ে পেনশন তহবিলে ন্যূনতম কত টাকা মাসিক কিস্তি হিসেবে জমা দিতে পারবেন সেটা বিবেচনায় না রাখলে এ কর্মসূচি সাধারণ প্রান্তিকপর্যায়ে নাগরিকদের মধ্যে তেমন সাড়া জাগাবে না। সমাজের সব শ্রেণিপেশার মানুষের সামর্থ্য বিবেচনায় পেনশন তহবিলের মাসিক কিস্তি নির্ধারণ করতে হবে। সমাজের কারা কারা পেনশন সুবিধাভোগী হবেন, এর বৈশিষ্ট্য ঠিক করার ক্ষেত্রে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা ভাবতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় কিংবা স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে বাছাই করে নির্দিষ্ট কিছু নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করে যেন এই তালিকা তৈরি করা না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে বেকারদের জন্য পেনশন সুবিধা রয়েছে। সেখানে একজন কর্মী যখন চাকরি করেন, তখন তিনি কিছু অর্থ জমা রাখেন। যদি কোনোভাবে তিনি বেকার হয়ে যান তখন সরকার কিছু অর্থ যোগ করে ওই ব্যক্তিকে পেনশন-ভাতা প্রদান করে। এটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। সেখানে প্রতারণা কিংবা জমানো অর্থ পেনশন হিসেবে পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো রকম হয়রানির সুযোগ নেই। পেনশন তহবিলে যারা টাকা জমা রাখবেন তারা যেন সঠিক জায়গায় ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তার জন্য টাকাটা রাখতে পারেন- তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। সর্বজনীন পেনশন তহবিলে জমানো টাকা যেন বেহাত, আত্মসাৎ বা লুটপাট হয়ে না যায় সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারি, নিরীক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকারকে যেন বিশাল ক্ষতি ও ঘাটতির মুখে পড়তে না হয়- তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা প্রবর্তন জাতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি অনন্য উপহার সন্দেহ নেই। জনকল্যাণমুখী সামাজিক সুরক্ষা কর্সসূচি হিসেবে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা সর্বাত্মকভাবে সফল হোক- এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close