এ এফ এম ফৌজি চৌধুরী

  ২৬ জুন, ২০২২

মুক্তমত

বন্যার সার্বিক চিত্র এবং...

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের দাপটে দেশ যখন দিশাহারা, তখন আবার বন্যার ভয়াল থাবায় বিপর্যস্ত জীবন। বিরামহীন বৃষ্টি, অন্যদিকে উজান থেকে নেমে আসা ঢল- এ দুইয়ে মিলে বন্যাকবলিত এখন সিলেট-সুনামগঞ্জসহ অনেক জেলা। সুরমা, কুশিয়ারাসহ অন্য নদীগুলোর পানি দ্রুত বাড়তে থাকায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ফলে আকস্মিক বন্যায় বিপাকে পড়েছে হাওর পাড়ের ভুক্তভোগী মানুষ। প্রায় প্রতি বছর আষাঢ় মাসেই দেশে বন্যার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়ে যায়। প্রথমেই বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ডুবে যেতে দেখা যায়। সেই পানি যেখান দিয়েই নেমে যায় সেখানেই তীব্র ভাঙন আর প্লাবন দেখা যায়। এরপর দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বন্যা দেখা যায়। সেই পানি যতই দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়, সেসব এলাকা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। শুধু বর্ষাকালেই নয়, আশি^ন-কার্তিকেও বন্যা হয় এ দেশে।

চলমান বন্যায় সুনামগঞ্জের প্রায় ৯০ শতাংশ আর সিলেটের ৮০ শতাংশ তলিয়ে গেছে। বাজার, দোকান, হাসপাতাল, শিক্ষালয়- সব বন্ধ। মার্চ, এপ্রিল, মে মাসের দু-দফায় বন্যায় বোরো ও আউশের পর এবার আমন মৌসুমের জমি তলিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ ও কার্যত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে দেশের অন্যতম এ প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক শস্যভা-ার।

শুধু সিলেট অঞ্চল নয়, একই সঙ্গে তলিয়ে গেছে উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্যের বহু অঞ্চল। এ অঞ্চলে অবস্থিত পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল মেঘালয় পাহাড়ের চেরাপুঞ্জির ভাটিতেই বাংলাদেশের সর্বাধিক বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল শ্রীমঙ্গল। আবহাওয়া পরিসংখ্যান বলছে, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে একই সঙ্গে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে এই জুনে। আর একক সময় এই অঞ্চলে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানিই তৈরি করেছে এই আচমকা নিদারুণ বন্যা পরিস্থিতি।

বিশুদ্ধ পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই। চলছে খাবারের মহাসংকট। রেলপথ, সড়কপথ, আকাশপথ, সব পথেই পানির রাজত্ব। বিদ্যুৎ না থাকায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মোবাইল ফোন, দুর্বল হচ্ছে নেটওয়ার্ক। সব স্থান ডুবে থাকায় প্রকৃত খবর জানার মাধ্যমগুলো স্মিমিত হয়ে আসছে। মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষ তাদের দুর্ভোগের কথা জানাতে পারছেন না কাউকে। রাস্তাঘাট, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাড়ির উঠোন, বসতবাড়ি, দোকানপাঠ, গোয়ালঘর, ধানের গোলাঘরসহ দৃষ্টির সীমাজুড়ে শুধু পানি আর পানি।

বিদ্যুৎ টেলিযোগাযোগ, সড়ক ও রেল যোগাযোগে খুব খারাপ অবস্থা। একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই। যারা আগে ছুটেছেন তাদের অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠতে সক্ষম হয়েছেন, কিন্তু সেখানেও স্থান সংকুলান হচ্ছে না। যে যেখানে একটু জায়গা পাচ্ছেন, সেখানে আশ্রয় খুঁজছেন। সিলেট থেকে সাধারণ মানুষের সুনামগঞ্জ যাওয়ার কোনো উপায় নেই। শুধু উদ্ধারকর্মী ও ত্রাণকর্মীরা নৌকাযোগে যেতে পারছেন সেখানে। উপদ্রুত অঞ্চলে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে সশস্ত্রবাহিনী। তবে বিপন্ন মানুষের জন্য সরকারের ত্রাণ তৎপরতা অপ্রতুল। সহায়-সম্বল হারিয়ে বহু মানুষের দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে। চিকিৎসাসেবায় ঘটেছে বিঘœ।

২০১৯ সালে ৬০ বছরের রেকর্ড ভেঙে অক্টোবরেও বন্যা হয়েছিল। পানিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষায় ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশে বন্যা হয়। কারণ নদীবাহিত পলি জমেই এই ব-দ্বীপের জন্ম। বন্যায় এই পলি সমতলে ছড়িয়ে মাটির উর্বরতা বাড়ায়। তাই বাংলাদেশের জন্য বন্যা একই সঙ্গে অভিশাপ ও আশীর্বাদ। তবে এটা ঠিক, মানুষের পরিবেশবিধ্বংসী নানামুখী কার্যক্রমের কারণে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও ক্রমেই বাড়ছে।

মূলত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বন্যার পানির উৎপত্তিস্থল হচ্ছে ভারত, নেপাল ও চীন। এসব দেশ থেকে প্রবাহিত পানি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে বেেঙ্গাপাসাগরে পড়ে। উজানের দেশগুলো থেকে বয়ে আসা পানির প্রধান নির্গমন পথ হচ্ছে জিএমবি বেসিনস। অর্থাৎ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকা। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর বার্ষিক সম্মিলিত বন্যার প্রবাহ একটিই নির্গমন পথ অর্থাৎ লোয়ার মেঘনা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। এ কারণে লোয়ার মেঘনার ঢাল ও নিষ্ক্রমণ ক্ষমতা কমতে থাকে। নদীর পানির স্তরের এই উচ্চতার প্রতিকূল প্রভাব সারা দেশেই পড়ে। কারণ বন্যার পানি নিষ্ক্রমণের অবস্থা ও ক্ষমতা দুটোই এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এতে ছোট ছোট নদীর প্রবাহ কমে যায়। একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার অঞ্চল অর্থাৎ ১৮ শতাংশ ভূখণ্ড বন্যাকবলিত হয়। ব্যাপকভাবে বন্যা হলে সারা দেশের ৫৫ শতাংশের বেশি ভূখণ্ড বন্যার প্রকোপে পড়ে। প্রতি বছর গড়ে বাংলাদেশে তিনটি প্রধান নদীপথে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আর্দ্র মৌসুমে ৮ লাখ ৪৪ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হয়। বার্ষিক প্রবাহের এটি ৯৫ শতাংশ। একই সময় দেশের অভ্যন্তরে ১ লাখ ৮৭ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার নদীপ্রবাহ সৃষ্টি হয় বৃষ্টির কারণে।

প্রতি বছর ছোট-বড় বন্যার ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে এর প্রকোপ কমিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য নদণ্ডনদীগুলোর নাব্যতা বাড়াতে হবে সর্বাগ্রে। আমাদের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ড ও অদূরদর্শিতায় একসময়ের খরস্রোতা নদীগুলো আজ জীর্ণশীর্ণ অথবা মরণাপন্ন অবস্থায় উপনীত হয়েছে। নদণ্ডনদীগুলোকে অবশ্যই মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। যেকোনো দুর্যোগে সবার আগে মানবিক বিপর্যয়ের দিকগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। এজন্য বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর অসহায় মানুষ যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য ও পানীয় পায় এ ব্যাপারে বিশেষ যত্নবান হতে হবে। এরই মধ্যে সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যার্তদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী কাজ শুরু করেছে। এতে করে মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছে। এখন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন্যার্তদের উদ্ধারের পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার দিকেই মনোযোগ দিতে হবে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তবেই হবে স্বস্তি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close