অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী
দৃষ্টিপাত
মাদকাসক্তি ও বাংলাদেশ পরিস্থিতি
জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৮৯ থেকে ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস পালন করা হয়। দিনটি পালনের উদ্দেশ্য হলো মাদকাসক্তির ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা এবং অবৈধ পাচার বন্ধ করা। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় : ‘স্বাস্থ্য এবং মানবিক সংকটে ওষুধের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা’।
জাতিসংঘ বলছে, অনেক মাদকাসক্ত ব্যক্তি বিকল্প হিসেবে আরো মারাত্মক মাদকদ্রব্য গ্রহণ করছে। এরই মধ্যে অনেক দেশে হেরোইন স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। সেসব দেশে এখন এমন মাদকদ্রব্য ব্যবহার করা হচ্ছে, যেগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং শরীরের ওপর হেরোইনের চেয়েও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। মাদকাসক্তরা অনেকেই ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে বিভিন্ন নেশাদ্রব্য প্রয়োগ করছে এবং একই সিরিঞ্জ একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করছে। ফলে এইচআইভি বা এইডস অথবা হ্যাপাটাইটিস-বি কিংবা সি ইত্যাদি রক্তবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে হেরোইন ও কোকেনের সংকট তৈরি হচ্ছে।
জাতিসংঘের ‘অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম’ (ইউএনওডিসি) বলছে, গত করোনাকালীন দেশে দেশে লকডাউন চলার কারণে মূলত মাদকদ্রব্যের এ সংকট। এসব এলাকায় বিমান ও সড়কপথে বেশির ভাগ মাদক চালান করা হয়। বাংলাদেশে একটি ভয়ংকর চিত্র হচ্ছে, ইয়াবা গ্রহণকারী শতকরা ৮৫ ভাগই তরুণ। যার ফলে এসব ইয়াবা গ্রহণকারী মাদকাসক্তরা নানান ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তার মধ্যে কিডনি, লিভার ছাড়াও মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জীবনীশক্তিধ্বংসকারীইয়াবা সেবনকারীরাঅল্প সময়ের মধ্যেই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন এবং যৌনশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন চিরতরে। বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ইয়াবা আসক্তদের ওপর পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
সূত্র মতে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে প্রায় ১৫ হাজার মাদকাসক্ত নিচ্ছেন। এর মধ্যে প্রায় ৯ হাজার ইয়াবাসেবী। একটানা মাত্র দুই-আড়াই বছর ইয়াবা সেবনের ফলেই তারা মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাদের নার্ভগুলো সম্পূর্ণ বিকল হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে দেশে ইয়াবা আসক্তির সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। বিভিন্ন সূত্র বলছে, দেশের তরুণ প্রজন্মের এক-চতুর্থাংশই কোনো না কোনো ধরনের নেশায় আসক্ত। এমনকি উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবকদের একটা বিপুল অংশ নিয়মিত ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে টেনশন থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছে। মাদক চিকিৎসকদের মতে, এটাও এক ধরনের মাদকাসক্তি। বিত্তবানদের একটা অংশ ছেলে এবং মেয়েরা মদ না খেলেও নিয়মিত সিসা খায়। বস্তি কিংবা রাজপথে দেখা যায়- ছিন্নমূল শিশু-কিশোররা জুতা তৈরির গাম, যা ডান্ডি নামে পরিচিত- সেগুলো দিয়ে নিয়মিত নেশা করে।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭৫ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। দেশে এত বিপুলসংখ্যক রোগীর জন্য নেই প্রয়োজনীয় হাসপাতাল বা নিরাময় কেন্দ্র। এদের চিকিৎসার জন্য দেশের ৪৪ জেলায় অনুমোদনপ্রাপ্ত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র আছে ৩৫১টি। এর মধ্যে শতাধিক ঢাকায়। অনুমোদনপ্রাপ্ত কেন্দ্রগুলোর শয্যাসংখ্যা ৪ হাজার ৭২৮। এখানে মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা হৃদরোগসহ অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত কি না, তা নির্ণয়ের জন্য এক্স-রে, ইসিজিসহ নানা পরীক্ষার দরকার হয়। কিন্তু এসব পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই সেখানে।
বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ মাদকের বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এশিয়ার গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল, গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ওয়েজ নামে পরিচিত মাদক চোরাচালানের তিনটি প্রধান অঞ্চলের কেন্দ্রে বাংলাদেশের অবস্থান। তাই আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিরাও বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে সহজে ব্যবহার করতে পারছে। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের অন্তর্ভুক্ত মিয়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে ছয়টি দেশের বাজার সামনে রেখে আইস উৎপাদন করছে, এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
পরিসংখ্যানে জানা যায়, দেশে গত তিন বছরে নারী ও শিশু মাদকাসক্ত বেড়েছে তিন গুণ। অপরিকল্পিত গর্ভপাতসহ বিভিন্ন কারণে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন নারীরা। উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীদের মধ্যে এ নিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার প্রবণতা বাড়লেও, মধ্য ও নিম্নবিত্তের মধ্যে তা বাড়েনি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপে এখনো অধিকাংশ মাদকাসক্ত নারী চিকিৎসার বাইরে। সূত্র থেকে জানা যায়, ‘আমাদের দেশে মাদকাসক্তদের ৮৪ ভাগ পুরুষ ১৬ ভাগ নারী এর মধ্যে ৮০ ভাগ তরুণ, ৬০ ভাগ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত, ৯৮ ভাগ ধূমপায়ী, ৫৭ ভাগ যৌন অপরাধী এবং ৭ শতাংশ নেশা গ্রহণকারী এইচআইভি আক্রান্ত। বাংলাদেশে বর্তমানে জনপ্রিয় নেশা ইয়াবা এবং এই ইয়াবা আসক্তদের ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী। ইয়াবা এমনই একটি ধ্বংসাত্মক মাদক যেটা গ্রহণ করলে সাময়িকউত্তেজনা বৃদ্ধি পেলেও চরম শারীরিক ও মানসিক অবসাদ হয় এবং সেটা থেকে চরম হতাশা, নৈরাজ্য ও বিষাদে পতিত হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে পারে এই ইয়াবা গ্রহণকারী।
সংবাদমাধ্যমে তথ্য বিবরণীতে জানা যায়, গত ১০ বছরে নেশাখোর সন্তানের হাতে প্রায় ২০০ বাবা-মা খুন হয়েছেন, স্বামী হত্যা করেছে স্ত্রীকে, স্ত্রী হত্যা করেছে স্বামীকে। খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, পরকীয়া, দাম্পত্য কলহ, অর্থ লেনদেন, হত্যা, সন্ত্রাসী কার্যক্রম সবকিছুর মূলেই রয়েছে এই মাদকের নেশা। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব কিন্তু সেই মানুষ মাদকের নেশায় হয়ে উঠে হিংস্র দানব, নরপশু। সড়ক দুর্ঘটনার ৩৩ ভাগ ক্ষেত্রে দায়ী চালকের মাদক সেবন।
মেয়েদের মধ্যেও মাদকের নেশা এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা ৫ নারী। তাদের বয়স ১৫-৩৫ বছরের মধ্যে। নারী মাদকাসক্তদের শতকরা ৪৩ শতাংশ ইয়াবাসেবী। কিছু ভ্রান্ত ধারণা থেকে তারামাদক নেয়, যেমন সিøম হওয়া যায়, রাত জেগে পড়া যায়, যৌনশক্তি বৃদ্ধি হয়। কিন্তু সবই ভুল, আসলে তার উল্টোটি হয়। মাদক ধীরে ধীরে জীবনীশক্তি হ্রাস করে। শিরায় মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যে সংক্রমণের হার ২২ শতাংশ। বাংলাদেশ জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ ভাগ মানুষ বয়সে তরুণ অর্থাৎ দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১ কোটি ৫৬ লাখ। মাদক ব্যবসায়ীরা এই কর্মক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠীকে মাদকের ভোক্তা হিসেবে পেতে চায়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, দিন দিনই বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা। মাদকসেবী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাদকের বাজারও বিস্তৃত হচ্ছে। শহর থেকে তা গ্রাম-গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। দেশে ১৫ বছরের বেশি মাদকসেবী আছে ৬৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এতে করে প্রতি ১৭ জনে একজন তরুণ মাদকাসক্ত। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউএনওডিসির তথ্য মতে, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের প্রতি দশজনে একজন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে। এই সত্য ধরে নিলে ৭৫ লাখে রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ লাখ ৫০ হাজার। কিন্তু চারটি সরকারি নিরাময় কেন্দ্র এবং ২০৯টি বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্র মিলে চিকিৎসার সুবিধা আছে পাঁচ হাজারের মতো। বাকি মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা থাকছে চিকিৎসাসেবার বাইরে।
বাংলাদেশ সরকারএরই মধ্যে মাদকের বিরুদ্ধে গত দুই বছরেরও বেশি সময় থেকে অভিযান পরিচালনা করছে। প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। এখন থেকে সরকারি চাকরিতে ঢোকার আগে প্রার্থীদের ডোপ টেস্ট বা মাদক পরীক্ষা করা হবে, যাদের পজিটিভ হবে তারা চাকরির জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। এরই মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ কার্যকর হয়েছে। এই আইনে মাদক ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
মাদকাসক্তি একটি রোগ। তাই মাদকাসক্তদের শাসন বা ঘৃণা, অবহেলা না করে তাকে স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ চিকিৎসা দিতে হবে। সে সুস্থ হয়ে আবার পরিবারে ফিরে আসবে। তাই বাবা-মারে প্রতি অনুরোধ আপনার সন্তানকে মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে লুকিয়ে রাখবেন না, ঘৃণা করবেন না, বরং তাকে স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যান, তাকে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা দিন। মাদকাসক্তরা সমাজের এই পরিস্থিতির স্বীকার। পাপকে ঘৃণা করুন পাপীকে নয়।
আসুন, আমরা সবাই মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে সাহায্য করি, তাদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাব্যবস্থার সুযোগ করে দিই। তাহলেই তারা সমাজের বোঝা না হয়ে বরং সুস্থ হয়ে পরিবারে ফিরে আসবে, তারাই সমাজকে সঠিকপথে পরিচালিত করবে। বিশ্ব মাদকমুক্ত দিবসে আজকের দিনে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম হাসপাতাল
"