দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

  ২৩ জুন, ২০২২

পর্যবেক্ষণ

দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক দল

বাঙালি জাতির মুক্তির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গণতান্ত্রিকভাবে জন্ম নেয় আওয়ামী লীগ। দেশের প্রতিটি আন্দোলনে যেমন আওয়ামী লীগের অবদান রয়েছে, তেমনি টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার রেকর্ড শুধু এই দলেরই। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল। ১৯৪৯ সালে ঢাকার টিকাটুলির কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগই ছিল প্রথম বিরোধী দল। দলটি জন্মলগ্নেই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। পাকিস্তানি শাসনের সূচনালগ্ন থেকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষাকে স্বীকৃতি, এক মানুষ এক ভোট, গণতন্ত্র, শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, সংসদীয় সরকার পদ্ধতি, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং দুই প্রদেশের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ ইত্যাদি ছিল আওয়ামী লীগের প্রধান দাবি। ১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ এবং এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ (১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার পূর্বে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনে আওয়ামী লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

জেনারেল আইয়ুবের স্বৈরাচারী শাসনামলে (১৯৫৮-১৯৬৯) বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন লাভের সংগ্রামে প্রধান দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৬৩ সালে মৃত্যুর পূর্বে সোহরাওয়ার্দী প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল নিয়ে ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) নামে আইয়ুববিরোধী একটি মোর্চা গঠন করেন। এই ফ্রন্ট গণতন্ত্র ও আইনের শাসন পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানায়। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা হন। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি তার ধানমন্ডির বাসভবনে কেন্দ্রীয় সদস্যদের সভায় তিনি আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেন।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন করে এবং কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৬২টি আঞ্চলিক আসনের (৭২.৫৭ শতাংশ ভোট) মধ্যে ১৬০টি আসন লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের (৮৯ শতাংশ ভোট) মধ্যে ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। দলটি জাতীয় পরিষদেও মোট ৭টি মহিলা আসন ও প্রাদেশিক পরিষদের মোট ১০টি মহিলা আসনের সব আসনেই জয়লাভ করে। এই নির্বাচনের অর্থ এই দাঁড়ায় যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এবং আওয়ামী লীগ অভিন্ন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়ংকর রাতে ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের ফলে পাকিস্তানের ভবিষ্যতের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহীর অভিযোগে বিচারের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে আওয়ামী লীগের নেতা বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি) এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে যে সরকার গঠিত হয়, তাণ্ডই ছিল প্রথম বাংলাদেশ সরকার, যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার (তখন মহকুমা) বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বিপুলসংখ্যক বিদেশি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এই সরকারের অধীনেই পরিচালিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। একটি নিয়মিত সরকারের মতো এর ছিল বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, কেবিনেট সচিব ও অন্যান্য সচিব, স্থায়ী ও বেতনভুক্ত বেসামরিক-সামরিক সরকারি কর্মচারী। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেক সেক্টরে একজন করে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। অন্য সরকারি কর্মচারীদের মতো তারাও ছিলেন বেতনভুক্ত। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সর্বাধিনায়ক বা কমান্ডার-ইন-চিফ। জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী ছিলেন সেনাপ্রধান। সরকার বাংলাদেশকে ১১টি সামরিক সেক্টরে বিভক্ত করার পাশাপাশি সমগ্র দেশকে কয়েকটি জোনে বিভক্ত করে রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বে মাঠ পর্যায়ে বেসামরিক প্রশাসন-ব্যবস্থা গড়ে তোলে এই সরকার। দেশের মুক্ত অঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের অনুশাসন পালিত হয়।

প্রথম বাংলাদেশ সরকার বা মুজিবনগর সরকারের বৈধ ভিত্তি ছিল ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ৭২.৫৭ শতাংশ ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয় অর্জন করে (৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন)। পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল আরো নিরঙ্কুশ। জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলার জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি (৭টি নারী আসনসহ) লাভ করে। এর মধ্যে ১৬২টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে মাত্র ২টি হাতছাড়া হয়, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসন অর্জন করে। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদেও আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল অবিস্মরণীয়। ৩১০টি প্রাদেশিক পরিষদ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৮টি আসন ও প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৮৯ ভাগ লাভ করে।

৭০-এর নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শুধু আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবেই আবির্ভূত হননি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তিনি স্বীকৃত হন বাঙালিদের একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে। ৭০-এর নির্বাচনের গণম্যান্ডেট না থাকলে বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের (১৯৭১) স্বাধীনতার ঘোষণা চিহ্নিত হতো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে, যে-পথ বঙ্গবন্ধু সর্বদা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পরিহার করে তার লক্ষ্যে এগিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাসহ বাঙালি জাতির যা কিছু শ্রেষ্ঠ অর্জন, তার মূলে এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্ব অনস্বীকার্য। তাই আওয়ামী লীগের ইতিহাস বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল অর্জন ও সংগ্রামের ইতিহাস।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতাণ্ডউত্তর বাংলাদেশে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন ছিল। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ সাল থেকে পরপর তিনবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।

স্বাধীনতার পর এই সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আওয়ামী লীগকে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। জাতীয়ভাবে অনেক সংকট মোকাবিলা এবং দলের অভ্যন্তরীণ ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছে। কখনো নেতৃত্বের শূন্যতা, কখনো দমন-পীড়ন, কখনো ভাঙনের মুখে পড়তে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর নেতৃত্ব শূন্যতায় পড়ে আওয়ামী লীগ। নেতৃত্বের এই শূন্যতা থেকেই দলের মধ্যে একাধিক ভাঙন-গ্রুপিং ও বহু ধারায় বিভক্তি দেখা দেয়। দলের নেতাকর্মীদের ওপরও নেমে আসে জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যা-খুন। এক ধরনের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে দলটি। দলের চরম ক্রান্তিকালে ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন।

৭৫ পরবর্তী সময়ে একের পর এক সামরিক শাসনের কবলে পড়ে দেশ। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে ঘুরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে দ্বিধা-বিভক্ত আওয়ামী লীগ আবার ঐক্যবদ্ধ হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সম্ভাবনার দিগন্তে পত পত করে উড়ছে পতাকা। তার একনিষ্ঠ তত্ত্বাবধানে দেশের উন্নয়ন প্রকল্প একের পর এক পেখম মেলে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি পদ্মা সেতু ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। চার লেন মহাসড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পানগাঁও নৌ-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, গ্যাস সংকট নিরসনে এলএনজি টার্মিনাল প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা সমুদ্রবন্দর, রাজধানীর চারপাশে স্যুয়ারেজ ট্যানেল নির্মাণের মতো অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। উন্নয়নের এ কর্মযজ্ঞে যোগ হয়েছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প এবং দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম প্রকল্প। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের কাজ চলছে। এরই মধ্যে কয়েকটি অঞ্চলের কাজের উদ্বোধনও করা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ নিরাপদ এবং পণ্য পরিবহন-খালাস সহজীকরণ করতে নেয়া আরো কিছু অবকাঠামোর সংস্কার হচ্ছে। একই সঙ্গে তথ্য-প্রযুক্তি খাতেও এগিয়েছে দেশ। আওয়ামী লীগের সঙ্গে দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তুলনা হয় না। এত আত্মত্যাগ, এত বিপর্যয়ের মধ্যেও আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক দল- ইতিহাসই তার সাক্ষী।

লেখক : পরিচালক, এফবিসিসিআই

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close