এম খান

  ২১ জুন, ২০২২

মতামত

মহাসড়ক তুমি কার

যদি আমি ভুল না বলি, মহাসড়ক তুমি কার? ‘মহা’ নামক বিশেষণ যে প্রত্যয়ের পূর্ব পদ হবে, তাহলে বুঝতে হবে পরবর্তী মূল শব্দটি মানে মহাব্যস্ত এক কথায় আমরা যে রকম বুঝে থাকি। মহাসাগর, মহাদেশ, মহাকাব্য, মহানয়ক। তবে মহাকবিকে কবিকুলের শিরোমনি হিসেবে অন্য দেশের কবি সমাজ নাও মানতে পারে। কিন্তু একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্টভাবে কোনো সড়কের শিরোমণি হবে মহাসড়ক, তার সীমারেখা এবং মহাসড়কে কী ধরনের যান চলবে, কী ধরনের যান চলতে পারবে না, তার সুষ্পষ্টকরণ রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে এখনো স্পষ্ট করতে পারেনি। তবে আমরা দিকহারা পথিক ধারণা করতে পারি আন্তজেলা সংযোগ সড়কই মহাসড়ক।

মহাসড়কে মানুষ কখন আসে? যখন মহাসংকটে পড়ে তখনই মহাসড়কে আসে। একই জেলাধীন পথিককুল যোগাযোগের ক্ষেত্রে বা পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে মহাসড়ক ব্যবহার না করেও বিকল্প পথে সমাধান করতে পারে। মহাসড়ক থাকায় সে অনেকটা স্থানীয় প্রভাব খাটিয়ে প্রাইভেট কার, হুন্ডা, ইঞ্জিনভ্যান, ঠেলাভ্যান, সরকারি-বেসরকারি অফিস ভেহিক্যাল, নছিমন, করিমন, সিএনজি, ব্যাটারিযান, বাইসাইকেল, রিকশা, অটোরিকশা, ব্রিক/বালু/মাটি পরিবহন ট্রলিসমূহ ভিন্ন কোনো বিকল্প পথ অবলম্বন করে না। মহাসড়কে সেসব যান চলাচল করে তাদের মধ্যে বাস, ট্রাক, কার্গোট্রলি, জিপ, মাইক্রোবাস, পিকআপ, ছোট-মাঝারিট্রলি, ট্রাক, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, নছিমন, থ্রি-হুইলার, কাভারভ্যান, অ্যাম্বুলেন্স, লাশবাহী যান, রিকশা, অটোরিকশা, বাইসাইকেল ও ঠেলাগাড়ি ইত্যাদি।

রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে মহাসড়কের মাধ্যমে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নাগরিক সেবা দিয়ে থাকে। এ ডিজিটাল যুগে আক্ষরিক জ্ঞানশূন্যরাও জ্ঞাত যে, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, গ্যাস সংযোগ নিতে হলে আগেই ডিমান্ড নোটের টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সেবা সংস্থার হিসাব নম্বরে পরিশোধ করতে হয়। অতঃপর এসব ইউটিলিটি সুবিধার জন্য মাসওয়ারি নির্দিষ্ট বিল পরিশোধ করতে হয়। মোবাইল ফোন সেবাসমূহের প্রি-পেইড সিস্টেমের মতো বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের ড্রাইভিং লাইসেন্স, রোড পারমিড, টেক্সটোকেন ইত্যাদি কিন্তু পূর্বপরিশোধিত। অন্যথায় গাড়ি রাস্তায় চালানোর কোনো অধিকার থাকে না। বিআরটিএ ড্রাইভিং লাইসেন্স, রোড পারমিট, টেক্স টোকেন ইত্যাদির প্রত্যয়ন/সনদ ছাড়া যেসব বাহন বা চালক মহাসড়কে প্রবেশ করে, অবাধে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করে এবং অধিকাংশ দুর্ঘটনা করে পার পেয়ে যায় তারাই মহাসড়কের মহানয়ক বা রাজপথের রাজকুমার। তাই তো পূর্বের ভেকেশনের মতো এবারও ঈদুল ফিতর’ ২০২২ উপলক্ষে ৬ দিনের ছুটিতে সড়কে যানবাহন দুর্ঘটনায় ঝরে ৬৫ প্রাণ। এদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ দুর্ঘটনা মোটরসাইকেলে সংঘটিত এবং অধিকাংশেরই হেলমেট ও বৈধ লাইসেন্স ছিল না। [সূত্র : প্রথম আলো : ০৬.০৬.২২]।

মহাসড়কের মহানয়ক বা রাজপথের রাজকুমারদের কোনো দিন মহাসড়কের নীতিবিধির ফ্রেমে আনতে পারবে না। তা ছাড়া প্রতিনিয়ত এসব রাজকুমারকে বাঁচাতে গিয়ে কত টেক্সটোকেন, রেজিস্ট্রেশন ও ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী গাড়িচালক, মালিক ও সাধারণ পথচারী রাস্তাচ্যুত হয়ে খাদে পড়ে গাছে ধাক্কা লেগে অকাতরে প্রাণ হারিয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের উঁচু-নিচু টেবিল সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে উদাসীন ও দিশাহারা। ফলে এ রহস্যও অধরা। সচেতন সুধীজন জ্ঞাত যে, ১৩ লাখ মোটরসাইকেলের চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। [সূত্র : দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, তারিখ : ১২-০৫-২০২২]। তারপর রাজপথের রাজকুমারদের বিষয়টি তাদের মাথায় কেন (?) খাটাবে। সমগ্র বাংলাদেশে টেক্সটোকেন, রেজিস্ট্রেশন ও ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী চালক ও মালিক এবং টেক্সটোকেন, রেজিস্ট্রেশন ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালক ও মালিকদের ভিন্ন ভিন্ন পূর্ণাঙ্গ তালিকা থাকলে সরকারের বছরে রাজস্বপ্রাপ্তি ও বঞ্চিতের হিসাব দৃশমান হতো।

লঙ্কার রাজা রাবন কর আদায়ের জন্য ঋষি ভিক্ষুক কাউকে তালিকাবহির্ভূত রাখেনি। এমনটি মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদ বধ মহাকাব্যে এমনই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাই রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্সবিহীন সব গাড়ি ও গাড়ির চালকদের একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের পক্ষে দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্ভব না হওয়াই স্বাভাবিক। সে লক্ষ্যে প্রতিটি থানার ওসি, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, মেয়র ও প্যানেল মেয়রদের সমন্বয়ে তাদের তালিকা প্রণয়ন করা সম্ভব। উল্লেখ্য, উপজেলাপর্যায়ে একাধিক সরকারি দপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী মনিটরিং করার জন্য বিভিন্ন এনজিও নিয়োজন করা আছে। নিয়োজিত এনজিওদের কর্মীরা এসব সরকারি নিরাপত্তা বেষ্টনী তদারকির জন্য শহর, গ্রাম, বন্দর, পাড়া-মহল্লা চষে বেড়ায়। সেই এনজিওদের মাধ্যমে সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের মধ্যে এ কাজটি করা সম্ভব। এখানে সরকারের ব্যয়ও হবে না। তাদের দেয় তথ্যাদি ফলোআপ করবে ইউপি মেম্বার, চেয়ারম্যান, প্যানেল মেয়র, মেয়র এবং তাদের তথ্যাদি ফলোআপ করবে থানা/উপজেলার ওসি। পূর্ণাঙ্গ হাল নাগাদ তথ্য পাওয়া গেলে রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্সবিহীন সব গাড়ি ও গাড়ির চালকদের কাছ থেকে প্রদেয় টেক্স আদায়ের কৌশল জানার অপেক্ষা অবশিষ্ট থাকবে না।

তা ছাড়া বাইসাইকেল, পেডেল-রিকশা, অটোরিকশা, ভ্যান, অটোভ্যান, ঠেলাগাড়ি সরকারি বা জনগুরুত্বপূর্ণ কার্য ছাড়া মহাসড়কে প্রবেশ করলে মোবাইল পুলিশ কোডিং নম্বর-সংবলিত ছাপানো রশিদের মাধ্যমে নির্ধারিত জরিমানা আদায় করতঃ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের ভ্রাম্যমাণ টেক্স আদায় হিসাব নম্বর শিরোনামে নিয়মিত জমা দেবে। প্রাপ্ত আদায় থেকে মোবাইল পুলিশ টিম ৩০% উৎসাহ ভাতা প্রাপ্য হবেন। ফলে রাজপথ বা মহাসড়কে দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে এবং ভ্রাম্যমাণ টেক্স আদায় বাবদ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাবে রাজস্বপ্রাপ্তি বৃদ্ধি হবে।

মহাসড়কের মেরামত ও সংস্কারের সিংহভাগ জোগানদাতা পরিবহন মালিক ও গাড়িচালকদের রেজিস্ট্রেশন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, রোড পারমিড, টেক্সটোকেন ইত্যাদি ফি আদায় খাত থেকে মেটানো হয়। অপ্রিয় হলেও সত্য, রেজিস্ট্রেশন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, রোড পারমিড এবং টেক্সটোকেনবিহীন চালকদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিয়মিত পরিশোধিত চালক, মালিক ও সাধারণ পথচারীরা অকালে প্রাণ ঝরে। এ সংকট থেকে মহাসড়ক বাঁচাও, লাইসেন্সধারী, রেজিস্ট্রেশনধারী, টেক্সধারী গাড়িচালক, মালিক ও পথচারী বাঁচাও পক্ষান্তরে লাইসেন্সবিহীন, রেজিস্ট্রেশনবিহীন ও টেক্সখেলাপিদের শনাক্ত করে জরিমানা আদায় নিশ্চিত করা দায়িত্বপ্রাপ্তদের নৈতিক দায়িত্ব। মহাসড়কে ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন, রেজিস্ট্রেশনবিহীন ও টেক্সটোকেন খেলাপিদের টু, থ্রি ও ফোর হুইলারের সারি দিন দিন এতটা দীর্ঘ হচ্ছে যে, বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী, রেজিস্ট্রেশনধারী, টেক্সটোকেন পরিশোধিত গাড়িচালক ও মালিকদের নিয়মিত হিমশিম খেতে হচ্ছে সর্বত্র।

কেননা, মহাসড়কে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন, রেজিস্ট্রেশনবিহীন ও টেক্সটোকেন খেলাপি চালক ও মালিক ৯০% দায়ী। এখানে হতবাক হওয়ার কিছুই নেই, তাৎক্ষণিক তারা উপঢৌকন বা অভিনব কায়দায় পার পেয়ে যায়। কিন্তু সংখ্যালঘু পরিবহন মালিক বা গাড়িচালক ওইসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী না হলেও সড়ক নিয়ন্ত্রণসেবায় নিয়োজিত ও সংখ্যাগরিষ্ঠদের দৃষ্টিতে সংখ্যালঘুরাই দায়ী। মামলার ক্রাইটেরিয়ায় না পড়লেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সড়কসেবায় নিয়োজিতদের অঙ্গভঙ্গিতে এমনটাই দৃশ্যমান হয়। ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী, রেজিস্ট্রেশনধারী, টেক্সধারী গাড়িচালক কিংবা মালিক যেন কাঠগড়ার পলাতক ফেরারি আসামি। এটি বাংলাদেশের সড়কে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত এলাকার সচিত্র চিত্র, যেন নিমিষেই এক রেডি জজ মিয়ার শটফিল্ম। এ ছাড়া প্রতিদিনের যান-সংক্রান্ত মামলার তালিকায় প্রতীয়মান হয় যে, ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী, রেজিস্ট্রেশনধারী, টেক্সটোকেন পরিশোধিত গাড়িচালক ও মালিক অপেক্ষাকৃত মামলা আক্রান্ত।

যে দেশে মহাপা-িতের অপেক্ষা অধিকতর হ্রাসকৃত ব্যক্তি দামি গাড়ি হাঁকায় ও দামি পোশাকে সজ্জিত থাকে। সে রাজ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী, রেজিস্ট্রেশনধারী, টেক্সটোকেন পরিশোধিত গাড়িচালক ও মালিকের মর্যাদা দিতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ নির্বিকার এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন, রেজিস্ট্রেশনবিহীন, টেক্সটোকেন খেলাপি গাড়িচালক ও মালিকদের নিশ্চিত চিহ্নিত করতে অপারগ।

ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন, রেজিস্ট্রেশনবিহীন, টেক্সখেলাপি গাড়িচালক ও মালিকদের হালনাগাদ তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। অন্যদিকে নিয়মিত ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী, রেজিস্ট্রেশনধারী, টেক্সটোকেন পরিশোধিত গাড়িচালক ও মালিকদেরও একটি হালনাগাদ তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। প্রস্তুত করা তালিকাণ্ডসংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে প্রকাশ করত ২০২২-২৩ করমেলা অনুষ্ঠানের আগেই তাদের জন্য রাজদণ্ড অথবা রাজটিকা পরিহিত করার জন্য আনুষ্ঠানিক আয়োজন করা হলে ভালো

সুফল পাওয়া যেতে পারে। এজন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

লেখক : কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close