আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা

  ২০ জুন, ২০২২

দৃষ্টিপাত

জলবায়ু বিপর্যয় রোধে আমাদের করণীয়

ছোটবেলা থেকে আমরা জেনে এসেছি আমাদের চারপাশে তাকিয়ে যা কিছু দেখতে পাই সবই পরিবেশের অংশ। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে পরিবেশ দূষণের মাত্রা বাড়ছে। এর জন্য দায়ী প্রধানত মানুষের অতিরিক্ত মাত্রা ভোগবিলাসী জীবনযাত্রা। মানুষ বুঝে ও না বুঝে লালসার কারণে পরিবেশের ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত হচ্ছে, যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিপন্ন করছে। বিশেষ করে তথাকথিত উন্নয়ন নামে ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের মাধ্যমে পরিবেশ ধ্বংস করছে কলকারখানা রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে ও বায়ুদূষণ করে জীববৈচিত্র্য প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। এজন্য বিশ্বব্যাপী অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ অনেক বেশি হুমকির সম্মুখীন।

জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে কার্বন ও মিথেন গ্যাস নিঃসরণের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটানো হচ্ছে। ফলে সারা বিশ্বের প্রাণ-প্রকৃতি আজ হুমকির মুখে। যার কারণে বাংলাদেশেও বহুমাত্রিক পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যগত বিপর্যয় দেখা যাচ্ছে। ব্যক্তিগত গাড়ি ও বিমানের ব্যবহার, কয়লা এবং তেলনির্ভর বিদুৎসহ আরো নানা কারণে আমাদের পৃথিবী প্রতিনিয়ত উত্তপ্ত হচ্ছে। বিশেষ করে, জি-২০ দেশগুলোর লাগামহীন কার্বন নিঃসরণ এবং মাত্রাতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এ অবস্থার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। তারা জলবায়ু বিপর্যয় ঘটিয়ে বাংলাদেশের মানুষের অস্তিত্ব বিলীন করতে চাচ্ছে। তথাকথিত উন্নয়নের নামে বিনিয়োগের অজুহাতে অতিমাত্রায় লোভ বিলাসের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে হুমকি দিচ্ছে আমাদের। কারণ আমরা এখন চারদিকে শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত। যদিও শত্রুরা ক্ষমতাবান এবং জ্ঞানপাপীও বটে। তবে এ বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের মতো প্রান্তিক দেশগুলো। যার কারণে বাংলাদেশের এক কোটি নব্বই লাখেরও বেশি শিশু সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। এসব শিশুর এক-চতুর্থাংশের বয়স পাঁচ বছরের কম।

প্রাক-ইসলামি আরবকে অন্ধকারময় যুগ বলা হতো, কারণ তারা নিজের জীবন্ত কন্যাশিশুকে হত্যা করত। অতিমাত্রায় জীবাশ্ম পুড়িয়ে আমরা এখন পুরো মানবসভ্যতা ও মানুষের অস্তিত্বকে ধ্বংস করতে অহমিকা দেখাচ্ছি। জাতিসংঘের তথ্য মতে, প্রকৃতি ধ্বংসের বর্তমান ধারা চলতে থাকলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০ লাখ প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। জলবায়ু বিপর্যয় যেভাবে ঘটানো হচ্ছে, তা যদি চলতে থাকে তাহলে ২০৭০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রতি তিনটির মধ্যে একটি প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। গত ৫০ বছরে গড়ে ৬০ শতাংশের বেশি বন্যপ্রাণী হ্রাস পেয়েছে। সে হিসেবে গত ১০ মিলিয়ন বছরের তুলনায় বর্তমানে প্রজাতি বিলুপ্তির গড় হার ১০ থেকে ১০০ গুণ বেশি। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ সামুদ্রিক প্রতিবেশ আজ পরিবেশগত হুমকির সম্মুখীন। ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ৩২ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। পরিবেশগত এ অবক্ষয় রোধ করতে না পারি তাহলে ব্যাপকভাবে জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ ধ্বংসের কারণে মানুষের খাদ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মারাত্মক নীতিবাচক প্রভাব পড়বে।

পৃথিবীর বেশির ভাগ অংশের জলবায়ু বিপর্যয়ের সাধারণ নীতিবাচক প্রভাব হলো লবণাক্ততা ও খরা। জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে আবহাওয়ার আরো চরম হচ্ছে, যার বিরূপ প্রভাবের ফলে নানা ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে বাংলাদেশে। এ বিপর্যয়-সংক্রান্ত বিপদ ও ঝুঁকিগুলো হলো- বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, দাবদাহ, খরা, শৈত্যপ্রবাহ, লবণাক্ততা ও নদীক্ষয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবাশ্ম জ্বালানির মাত্রারিক্ত ব্যবহার আবহাওয়াকে উষ্ণ করে তুলছে, যার কারণে বিপর্যয় বাড়ছে এবং পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে। এর ফলে আরো বেশিসংখ্যক মানুষ অপ্রত্যাশিত বন্যা ও ঝড়ের কারণে ঘর ছাড়তে বাধ্য হবেন। পাশাপাশি ফসলের ক্ষতি ও খরার মতো কারণও এ ধারাকে আরো প্রকট করে তুলছে। জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে খরার ঝুঁকিতে বাংলাদেশের ২২ জেলা, এসব তথ্য উঠে এসেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যান্ড ডিজাস্টার রিস্ক অ্যাটলাস’ শীর্ষক সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে। মূলত দীর্ঘ সময় ধরে চলা শুষ্ক আবহাওয়া, অপর্যাপ্ত বৃষ্টি, বৃষ্টিপাতের তুলনায় বাষ্পীভবন ও প্রস্বেদনের পরিমাণ বেশি হলে খরার সৃষ্টি হয়।

এ ছাড়া বর্তমান অবস্থাতেই উপকূলীয় এলাকায় মাটিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে কৃষিজমির উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং লবণাক্ততার কারণে প্রয়োজনীয় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হিমালয়সহ উত্তর ও দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের বিপুল বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের স্থলভাগের প্রায় ২০ ভাগ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাবে। আইপিসি এক প্রতিবেদনে আরো আশঙ্কা জানিয়েছে, বাংলাদেশের ১৯টি জেলার প্রায় ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এ কারণে গৃহহীন হবে প্রায় দুই কোটি মানুষ। জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে প্রতি বছর ঝড়ের পরিমাণ ও আকৃতি বাড়ছে। অবিলম্বে পৃথিবীব্যাপী কার্বন-ডাইঅক্সাইড, মিথেনসহ প্রভৃতি গ্যাস নিঃসরণ বন্ধ না করলে আগামী ৮০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের বেশির ভাগ স্থলভূমি পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে।

জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রভাবে বাংলাদেশে তাপমাত্রা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে; বিশেষ করে সম্প্রতি রাজধানী ঢাকা ও রাজশাহীতে প্রায় মরুভূমির মতো তাপমাত্রা অনুভূত হচ্ছে, যা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চল জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে এবং মরূকরণ ত্বরান্বিত হচ্ছে। এসবের ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন, সুপেয় পানির সংকট দেখা দেবে। জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রভাব মোকাবিলায় এবং বিপর্যয় রোধে করণীয় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কপ-২৬ অনুষ্ঠিত হলেও কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে বিশ্বনেতারা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে এবারও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। পৃথিবীব্যাপী প্রাণ-প্রকৃতির অস্তিত্ব যখন বিনাশের পথে এখনো জি-২০ দেশের নেতারা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। যার কারণে বাংলাদেশের মতো সমুদ্র উপকূলের দেশসমূহের জন্য এ বিপর্যয় ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

মানুষের অস্তিত্ব না থাকলে রাষ্ট্রের অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যাবে। রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান উপাদান মানুষ। জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে খাদ্য উৎপাদন ও সুপের পানির সংকটে জনস্বাস্থ্যকে হুমকিতে ফেলছে। মানুষের বাস্তুচ্যুত হচ্ছে জীবন ও জীবিকার তাগিদে। রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের কি কোনোপ্রকার দায়িত্ব নেই? যদিও আগামী জলবায়ু বিপর্যয় বিষয় এ আন্তর্জাতিক সম্মেলন কপ-২৭ অনুষ্ঠিত হবে। ওই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রাণ-প্রকৃতির অস্তিত্ব রক্ষায় বাংলাদেশের প্রধান দাবি হওয়া উচিত ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে ক্ষতিপূরণ নয়, অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করা। ধনী দেশগুলোর রাজনীতিকরা সদিচ্ছা না থাকায় কার্বন নিঃসরণ কিছুতেই কমানো যাচ্ছে না।

এজন্য রাষ্ট্রেগুলোকে প্রাণ-প্রকৃতির কথা বিবেচনা করে উন্নয়নকে কীভাবে পরিবেশসম্মত বা পরিবেশবান্ধব (Enveronment-Friendly) করা যায় সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা সময় এসেছে। পৃথিবীতে মানুষ ও প্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষা করতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৪৫ ভাগ কমিয়ে আনতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতির রক্ষায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির এই ব্যবহার বন্ধ করতে প্রয়োজন নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা; যেমন : যাতায়াতের ক্ষেত্রে অযান্ত্রিক যানবাহন ব্যবহার করে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করতে পারি। ব্যবহৃত প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। এজন্য পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণে সবুজ কর প্রণোদনা বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক জলবায়ু বিপর্যয় রোধে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে পরিবেশ আইনের কঠোর প্রয়োগের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা জরুরি। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব যানবাহন, যন্ত্রপাতি ও সম্পদ আহরণের জন্য বিনিয়োগ করছাড় এবং সবুজসেবা প্রদানকারীদের আয়কর মওকুফের বিষয়টি বিবেচনা করা।

বাংলাদেশের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি, জাতীয় শিক্ষানীতি, ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় জলবায়ু পরিবর্তন রোধে করণীয় বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু কীভাবে জলবায়ু বিপর্যয় রোধে ব্যক্তিগতভাবে একজন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে, তা পাঠ্যপুস্তকে বিষয় তেমন একটা উল্লেখ নেই। যেহেতু বাংলাদেশ অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে, তাই জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তকে জলবায়ু বিপর্যয় এবং করণীয় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা খুবই জরুরি। যাতে করে রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সভা, সমাবেশ ও সম্মেলনে বাংলাদেশর মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতির ক্ষতির বিষয়টি জোরালো উপস্থাপন করতে পারে; এবং জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসি, সার্কের মাধ্যমে বহির্বিশ্বকে বিশেষ করে জি-২০ রাষ্ট্রসমূহকে চাপ প্রয়োগ করা যায়।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close