খায়রুন নেছা

  ১৯ জুন, ২০২২

পর্যবেক্ষণ

আবারও পানির নিচে সিলেট-সুনামগঞ্জ

প্রতি বছরের মতো এ বছরও বন্যায় ভাসছে সিলেট। টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে সিলেটের নদ-নদীগুলোর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। শুক্রবার সকালে নদীর তীর উপচে নতুন করে বাড়িঘরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। এককথায় অবস্থা ভয়াবহ। এমন অবস্থায় বন্যাকবলিত পরিবারগুলো দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভোগের আশঙ্কা করছে। প্রায় ২৪৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সুরমা দেশের দীর্ঘতম নদী। ভারতের বরাক নদী থেকে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে।

এই নদী বছরের বেশির ভাগ সময় থাকে পানিহীন, মৃতপ্রায় কিন্তু বন্যার মৌসুমে ভারতের বরাক নদী হয়ে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতিতে বানভাসি লোকজন পড়ে চরম দুর্ভোগে। ভাঙন সৃষ্টি হয় সুরমা-কুশিয়ারার একাধিক স্থানে। লাখ লাখ মানুষ হয়ে পড়ে পানিবন্দি। চারপাশে পানি থাকায় বাড়িঘর থেকে বের হতে পারে না বন্যাকবলিতরা। পানির স্রোতে ভেসে গেছে ঘরের মজুদ খাদ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিস। কাজ না থাকায় চরম দুরবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে বানভাসি মানুষের।

ভঙ্গুর যোগাযোগ ব্যবস্থা। চরম খাদ্য সংকট। ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা বানভাসিরা নৌকা দেখলেই ত্রাণের আশায় ছুটে যাচ্ছেন। ক্ষতির তুলনায় সরকারি ত্রাণ বরাদ্দ অপ্রতুল। সিলেটের পাঁচ উপজেলার বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট চলছে। তা ছাড়া সুনামগঞ্জে বৃহস্পতিবার থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই বিচ্ছিন্ন। সুনামগঞ্জের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক পথের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন রয়েছে বলে জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন। তিনি জানান, বন্যার পানিতে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের ছাতক উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ-দিঘলী এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। সেখান দিয়ে কোনো দূরপাল্লার গাড়ি আপাতত যেতে পারছে না। তবে ছোট যানবাহন, মোটরসাইকেল চলছে। সুনামগঞ্জ ও ছাতক শহরজুড়ে এখন থইথই পানি। শহরের এমন কোনো এলাকা ও সড়ক নেই যেখানে বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়নি। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের আলফাত স্কয়ার থেকে শুরু করে নবীনগর পর্যন্ত পানি আর পানি। কোথাও হাঁটু, কোথাও এর চেয়ে বেশি। কাজীর পয়েন্ট এলাকায় পানি বেশি থাকায় সেখানে নৌকায় যাতায়াত করেছেন লোকজন।

সিলেটে প্রতি বছর এমন বন্যার কারণ হিসেবে জানা যায় পলি জমে ভরাট হয়ে পড়েছে নদীর তলদেশ। ফলে শুষ্ক মৌসুমে সুরমা হয়ে পড়ে বালুভূমি। অন্য দিকে অল্প বৃষ্টিতেই নদী উপচে নদী তীরবর্তী এলাকায় দেখা দেয় বন্যা। বৃষ্টিতে নদীর পানি উপচে তলিয়ে যায় হাওরের ফসল। পুরো সুনামগঞ্জ শহরের ৯০ ভাগ বসতঘরে বানের পানি ঢুকে পড়েছে। মানুষের সঙ্গে সঙ্গে দুর্বিপাকে পড়েছে গবাদিপশু। বসতভিটায় পানি ওঠায় গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি নিয়ে চরম বিপাকে এলাকার মানুষ। বহু কৃষকের হাঁস-মুরগি নদীতে ভেসে গেছে। অনেকে হাঁস-মুরগি নিয়ে ঘরের চালের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যার পানিতে বেশির ভাগ গো-চারণভূমি তলিয়ে গেছে। চরের কিছু উঁচু ভিটা এখনো পানিতে তলিয়ে না যাওয়ায় প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার পথ নদীতে পাড়ি দিয়ে এখানে ঘাস কাটতে আসেন ভুক্তভোগীরা। বন্যায় গো-চারণ ভূমি তলিয়ে যাওয়ায় বাজার থেকে চড়া মূল্যে শুকনো খাবার কিনে গবাদিপশু পালনের ক্ষমতা না থাকায় তাদের সামনে এখন শুধু ধূসর শূন্যতা।

প্রতিদিন নিজেদের খাবার না জুটলেও গবাদিপশুর খাদ্য জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বন্যার কারণে গৃহস্থদের গরু চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী দালাল-ফড়িয়াদের কাছে। বন্যায় প্লাবিত এলাকার ছোট খামারি এবং গৃহস্থরা ঘরবাড়ি সংস্কার ও ফসলের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম দামে গরু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। তা ছাড়া বন্যার কারণে এলাকায় গবাদিপশুর বিভিন্ন ধরনের রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। সুনামগঞ্জে প্রায় ১ লাখ ৫৬ হাজার গৃহপালিত পশু বন্যাকবলিত হয়েছে। হাঁস-মুরগি মিলিয়ে এই সংখ্যা ২৫ লাখ বলে জানিয়েছে জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ।

কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে জেলায় ৪৭ হাজার গরু মোটাতাজা করেছিলেন কৃষক ও খামারিরা। দুই দফা বন্যার আঘাতে এসব গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে আছেন খামার মালিকরা। পশু চারণ ভূমি পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় জেলাজুড়ে দেখা দিয়েছে পশু খাদ্যের অভাব। এমন পরিস্থিতিতে কম দামেও পশু বিক্রি করতে পারছেন না অনেক কৃষক। এমতাবস্থায় সাধারণ জনগণ প্রশাসনের যথাযথ উদ্যোগ ও ত্রাণের দিকে তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে আছেন। এ মুহূর্তে তাদের পাশে দাঁড়ানোটাই হচ্ছে সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি। দেশ, জাতি ও রাষ্ট্র সে দাবি পূরণে এগিয়ে আসবে বলেই আমাদের বিশ্বাস এবং প্রত্যাশা।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি

বিভাগ ইডেন মহিলা কলেজ, আজিমপুর, ঢাকা

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close