হীরেন পণ্ডিত

  ১৯ জুন, ২০২২

মুক্তমত

বাজেট বাস্তবায়নে যা করতে হবে

আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬টি বিষয়কে দেশের অর্থনীতির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে তিনি এসব চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রতি বছরের মতো এবার বাজেট প্রণয়নের অংশ হিসেবে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন, স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। এসব আলোচনার মাধ্যমে আগামী অর্থবছরে ৬টি চ্যালেঞ্জ উঠে এসেছে। এগুলো হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়ানো, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়ার কারণে বাড়তি ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান, বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ব্যবহার এবং উচ্চ-অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন, অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন কর সংগ্রহের পরিমাণ এবং ব্যক্তি আয়করদাতার সংখ্যা বাড়ানো এবং টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা।

জনপ্রত্যাশা ছিল বাজেট হবে মূল্যস্ফীতি থেকে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার দলিল। বাজেট অন্যবারের মতো গতানুগতিক ধারাতেই প্রণয়ন করা হয়েছে, যেটি বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় যথেষ্ট নয় বলে অনেকে মনে করছেন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে যে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে সেটি প্রশংসনীয়, তবে যথেষ্ট নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হলেও সেটির বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় থেকে যায়। নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও পুরোনো চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠার জন্য তেমন বিশেষ কিছু নেই বাজেটে। চ্যালেঞ্জগুলো হলো যেমন : বাণিজ্য ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান, টাকার অবমূল্যায়ন, কর্মসংস্থানের অভাব, আয়বৈষম্য। মানুষ শুনতে চায়, যারা বঞ্চিত তাদের জন্য বাজেটে কী বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তারা জানতে চায়, সমসাময়িক সমস্যা থেকে পরিত্রাণ এবং কীভাবে জীবনযাত্রার মানের আরেকটু উন্নয়ন ঘটানো যাবে। দেশের প্রবৃদ্ধি হবে, রিজার্ভ বাড়বে। এগুলো অর্থনীতির সূচক মাত্র। জীবনমানের উন্নয়ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের স্বস্তি প্রদানই হওয়া উচিত এবারের বাজেটের মূল লক্ষ্য।

করোনা অতিমারী এবং পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা বৈশ্বিক সংকট সৃষ্টি করেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব দেশেও পড়েছে, পড়ছে। বাজেটে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেওয়া প্রয়োজন ছিল। প্রথমত, ডলার সংকট। ডলার সংকটের একমাত্র কারণ আমদানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নয়, অর্থ পাচারও অনেকাংশে দায়ী। আমদানিতে ওভার-ইনভয়েসিং যাতে না হয়, তার জন্য নজরদারি বাড়াতে হবে। বাজেটে এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। ক্রমাগত মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। এ-সংক্রান্ত সরকারি তথ্যে বিভ্রান্তি আছে। সরকার বলছে, মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তা ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবিও বলছে- চাল, ডাল ও তেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ। সুতরাং প্রকৃত তথ্য না পেলে কোনো নীতি প্রণয়নই কাজে আসবে না। অথচ অর্থমন্ত্রী উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক হিসেবে অভিহিত করে পাশ কাটিয়ে গেলেন। তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জ্বালানি সংকট। আমাদের জ্বালানি খাতের মহাপরিকল্পনার একটি বড় অংশ সাজানো হয়েছে আমদানি করা এলএনজির ওপর নির্ভর করে। গত বছরের শেষ দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে স্পট মার্কেটে পণ্যটির দাম প্রতি এমএমবিটিইউ ৫৫ ডলারে উঠে যায়। এর মধ্যে শুরু হয় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। জ্বালানির বাজার আরো অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। শেষতক প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৮৮ ডলারে। শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, সরকারিভাবে জ্বালানির দাম বাড়ানো হলে কারখানা সচল রাখাই দুরূহ হয়ে পড়বে। এজন্য বিশেষ করে বস্ত্র, সিরামিক ও ইস্পাতের মতো ভারীশিল্পে আশঙ্কা বিরাজ করছে। চতুর্থ চ্যালেঞ্জ কর-জিডিপি অনুপাত। আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত খুবই কম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও কর-জিডিপির গড় অনুপাত ১৫ শতাংশ, যেখানে আমাদের ৮ শতাংশেরও কম। গবেষকরা মনে করেন, এ হার অন্তত ২২ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন। এর জন্য সম্পদ কর আরোপসহ কর-কাঠামোকে সম্প্রসারিত করতে হবে। কর আহরণে দক্ষতা বাড়াতে হবে, পাশাপাশি আহরণের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করতে হবে। বাজেটে কর আহরণ বাড়াতে নতুন কোনো উদ্যোগের কথা বলা হয়নি। উল্লিখিত চারটি চ্যালেঞ্জের বিপরীতে একটি সুযোগও সরকারের কাছে রয়েছে। আমরা জানি, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হলো ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি জনসংখ্যা। এটাকে বলে জনমিতি ডিভিডেন্ড বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড। আশার কথা, এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড আমাদের অনুকূলে আছে। আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৬ শতাংশ এ স্তরে অবস্থান করছে। আমরা যদি প্রকৃত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষ করে তুলতে পারি, তাহলে উৎপাদনশীলতায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে। অদক্ষ শ্রমিকের পরিবর্তে দক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তানির সুযোগ বাড়বে। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনা। বছরের পর বছর ধরে বলা হলেও এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে কোনো ঘোষণা আসেনি।

করোনাকালে শিক্ষা খাতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। সেগুলো পুষিয়ে নিতে শিক্ষার সঙ্গে কিন্তু অনেক খাত রয়েছে। সেসব বাদ দিয়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় যতটা বিনিয়োগ দরকার ছিল এবং জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে যতটুকু অংশ হওয়ার কথা ছিল, সেই অঙ্ক এখনো অপ্রতুল। প্রাথমিক শিক্ষায় যে ক্ষেত্রটিতে শিক্ষার অধিকার আইন সার্থক করতে সরকার দায়বদ্ধ, সেখানে টাকা বরাদ্দ হয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। মানুষের জীবনে উন্নতির চেষ্টা করতে, তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা নিতে বিপুল রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন, সে কথা বোধ হয় আলাদা করে না বললেও চলে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় সেটি যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। কারণ একে তো কোভিড-পরবর্তী সময়, তার ওপর আছে মূল্যস্ফীতি। দুটো মিলিয়ে অনেকেরই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার শঙ্কা আছে। আবার মধ্যবিত্তদেরও আরো নিচে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেদিক বিবেচনা করে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ আরো বাড়ানো হবে বলে প্রত্যাশা ছিল। সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে বিলাসদ্রব্য আমদানির ক্ষেত্রে একটু কড়াকড়ি করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতা আগেও দেখা গেছে। রপ্তানি খাতকে এক ধরনের প্রণোদনা দেওয়ার মাধ্যমে ডলারের সংকট কাটানো এবং আমদানি কমানোর মাধ্যমে ডলারকে ধরে রাখার একটা অভিপ্রায় লক্ষ করা যায় বটে, তবে তা পর্যাপ্ত নয়।

প্রচুর ব্যবসাকে প্রণোদনা দিতে অনেক সুযোগ রয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। করপোরেট কর পরপর তিনবার কমানো হলো। এখানে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে, আগে তৈরি পোশাক খাতে প্রণোদনা থাকলেও এখন সার্বিক রপ্তানি খাতে প্রণোদনা বাড়ানো হয়েছে। এটি একদিক দিয়ে ভালো। এতে রপ্তানি বহুমুখীকরণ হবে। তবে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরির যে চেষ্টা রয়েছে, সার্বিকভাবে তা ইতিবাচক হলেও এ ধরনের উদ্যোগ অন্যান্য বছর দেখা গেছে। সামষ্টিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে রপ্তানি প্তৃদ্ধির উদ্যোগ হয়তো সফলতা আনছে, কিন্তু সার্বিকভাবে এ সুবিধা ব্যবসায়ীদের শিল্পায়ন এবং তার মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরির জন্য দেওয়া হয়, সেখানে অগ্রগতি নেই। এজন্য ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করা দরকার। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুতের পাশাপাশি অবকাঠামো উন্নত করতে হবে। যত দিন ব্যবসার পরিবেশ উন্নত না হবে, তত দিন ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়বে না। আর ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ না বাড়লে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নতুন শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক কিছু দেখার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

সরকার কিছুটা হলেও গ্রামকে এবং কৃষি খাতে গুরুত্ব দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মুক্তবাজার অর্থনীতির পরামর্শে কৃষকদের জন্য সার বা কৃষিযন্ত্রে ভর্তুকিতে ব্যয় নিষিদ্ধ ছিল। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন পর্যন্ত কৃষি ও কৃষকবিরোধী নীতি অব্যাহত ছিল। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর আমল থেকে এ ক্ষেত্রে এ ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়। তবে আরো পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। কৃষিজমি সংরক্ষণ, ভূমি ব্যাংক ও ভূমিহীনদের মধ্যে ভূমিবণ্টন ও সেজন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষি এবং বর্গাচাষিদের সংগঠিত করা প্রয়োজন।

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনের প্রধান উপায় হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতা কাঠামো থেকে অসৎ ব্যবসায়ী, অসৎ আমলা ও অসৎ রাজনীতিবিদকে সরিয়ে উৎপাদন শক্তির অবাধ বিকাশের বাধাগুলো দূর করা। শ্রম বা মানবসম্পদ উভয়ের ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। আর সেজন্যই আবার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close