মো. জিল্লুর রহমান

  ২৮ মে, ২০২২

পর্যালোচনা

যানজটের কারণ ও ক্ষতির মূল্যায়ন

অসহনীয় যানজটে অতিষ্ঠ নগরবাসী। যানজট শুধু ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোই নয়, অন্য ছোট ছোট শহরেও ধীরে ধীরে প্রকট আকার ধারণ করছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও নিবন্ধনহীন যানবাহনের কারণে যানজট ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। রাজধানী ঢাকা শহরে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে প্রতিদিনই পোহাতে হয় অসহনীয় যানজট এবং বেশিরভাগ কর্মজীবী সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে মধ্যে অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করেন এবং বিকাল চারটা থেকে রাত সাড়ে আটটার মধ্যে বাড়ি ফিরেন। ফলে রাজধানীতে এ সময়ে যানজট চরমে পৌঁছায়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, যানজটের কারণে প্রতিদিন যে কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে তার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। ২০২২ সালে ঢাকার সড়কে প্রতিদিন ৮০ লাখের বেশি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে, যা ২০১৭ সালে ছিল দিনে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা। উক্ত গবেষণায় আরও বলা হয়, ঢাকায় প্রতিদিন স্বল্প ও দীর্ঘ দূরত্বে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে প্রায় আড়াই কোটি ট্রিপ দেওয়া হয়, যার মধ্যে ৪৪% অফিসগামী যাত্রীরা। গত কয়েক বছরে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন যানবাহনের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির ফলে যানজটের তীব্রতা বেড়েছে। প্রাইভেট কার, জিপ এবং মোটর সাইকেলের সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে। যার ফলে গণপরিবহন সহজ হওয়ার পরিবর্তে যানজট সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এক্ষেত্রে যানজট বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে বলা হয় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি এবং নতুন বাস কম নিবন্ধন হওয়া। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে নতুন বাসের নিবন্ধন ৩২.৩% কমেছে, একই সময়ে জিপ বিক্রি ৫৫%, প্রাইভেট কার ২৮% এবং মোটরসাইকেল ২৭ % বেড়েছে। যানজটের আরেকটি ক্ষতি হল রাস্তার আয়ুষ্কাল কমে যাওয়া। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি থেমে থাকলে রাস্তার আয়ুষ্কাল ১৮-৩০% কমে যায়। প্রকৌশলীরা যখন রাস্তা ডিজাইন করেন তখন তারা চলমান লোড বিবেচনা করেন। ঘন্টার পর ঘন্টা কয়েক হাজার যানবাহনে ভরা থাকায় রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

যানজটের একটি বড় কারণ হলো সড়কের সংস্কার ও উন্নয়নের কাজ যথাসময়ে ও সঠিকভাবে সম্পন্ন না হওয়া। উদ্বেগের বিষয় হল, রাজধানীর যানজট কমাতে ইতিমধ্যে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তার কোনোটাই বিশেষ একটা কাজে লাগছে না। দিনের বেলা শহরে ট্রাক ও আন্তঃনগর বাসের প্রবেশ বন্ধ করাসহ যানজট নিরসনে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া বিভিন্ন রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। পথচারী পারাপারের জন্য ফুটওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস তৈরি করা হয়েছে। ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি এবং সিসি ক্যামেরাও বসানো হয়েছিল। কিন্তু এরপরও যানজট কমেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের যতটুকু সড়কপথ আছে, তাতে সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে বাস্তবায়ন করা হলে যানজট ৮০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব।

রাজধানী ঢাকার যানজটের প্রধানতম কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ। ১৯৭৪ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২০ লক্ষ। ১৯৮১ ও ১৯৯১ সাল নাগাদ তা যথাক্রমে ৩৫ ও ৬৫ লক্ষে পৌঁছায়। কিন্তু ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের অভাবহেতু গত বিশ বছরে সারা দেশ থেকে দলে দলে মানুষ কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসতে শুরু করে। যার দরুন ২০২১ সাল নাগাদ এই মহানগরের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি। চীনের বৃহত্তম সাংহাই শহরে দেশের জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ বাস করে। প্রতিবেশী ভারতের প্রধান শহরে জনসংখ্যার ২ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ৪ শতাংশ, পাকিস্তানে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ভিয়েতনামে ৮ দশমিক ১ শতাংশ বাস করে। অথচ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১১ দশমিক ২ শতাংশই বাস করে ঢাকায়—যা এই অঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ। মাত্র ১৬০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ঢাকা এত বিপুল লোকসংখ্যার চাপ সইতে পারছে না। ফলে নানাবিধ নাগরিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে এবং এর মধ্যে অন্যতম হলো যানজট। কোনো নগর-মহানগরের যানবাহনের স্বাভাবিক গতি বজায় রাখতে মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ রাস্তা থাকা প্রয়োজন। অথচ অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরে সড়কের পরিমাণ মাত্র ৭-৮ শতাংশ। যা আমাদের রাজধানীতে চলমান গাড়ি চলাচলের জন্য প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল।

রাজধানীর অসহনীয় যানজটের আরেকটি বড় কারণ শহরটির দুর্বল পরিবহন ব্যবস্থাপনা ও যোগাযোগ অবকাঠামো। ঢাকার রাস্তা যে পরিমাণ গাড়ি ধারণে সক্ষম, তার চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ বেশি গাড়ি চলে। এছাড়া, ঢাকার সব যানজটের ৩০ শতাংশের জন্য দায়ী পার্কিং ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা। ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে নতুন নতুন অবকাঠামো গড়ে তুললেও সেগুলোর ব্যবস্থাপনা ভালো নয়। ফলে এসব অবকাঠামোর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকার অসহনীয় যানজট সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য সঠিক ট্রাফিক ও পরিবহন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা দরকার। এছাড়াও পথচারীবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা, উন্নত গণপরিবহন প্রবর্তন, গণপরিবহনের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ, পার্কিং ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের পাশাপাশি সড়ক ব্যবহারীদেরও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটানোর ওপর জোর দেওয়া দরকার।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থাপিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানী ঢাকার অসহনীয় যানজটে শুধু মানুষের ভোগান্তি ও কর্মঘণ্টাই নষ্ট হচ্ছে না—এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জিডিপি এবং মাথাপিছু আয়ও। শুধু ঢাকার যানজটের কারণেই বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০১৫-১৬ সালের নতুন ভিত্তি বছরের হিসাবে অর্থমূল্যে এই ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। আর অপরিকল্পিত নগর সম্প্রসারণের পরোক্ষ ক্ষতির হিসাব যুক্ত হলে এক্ষতি জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি হয়ে যায়। উক্ত গবেষণায় আরও বলা হয়, দেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতু সবচেয়ে বড় অবদান রাখবে। এই সেতুর নির্মাণ ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি হলে রাজধানীর যানজটের কারণে প্রত্যক্ষ যে ১ লাখ টাকার ক্ষতি হচ্ছে, তা দিয়ে তৈরি করা যেত পদ্মা সেতুর সমান দৈর্ঘ্য ও সুবিধার তিনটি সেতু। এতে অবকাঠামোর উন্নয়ন যেমন হতো, তেমনি গতি বাড়ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেরও। ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারত ৩ শতাংশের বেশি। দারিদ্র্য বিমোচনের হারও বাড়ত আড়াই শতাংশের কাছাকাছি। এছাড়াও ঢাকার যানজটের কারণে প্রতি মাসে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে কর্মজীবীদের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জিডিপিতে। অর্থনীতির এই ক্ষতিকে আরও বড় করে তুলেছে রাজধানীর অপরিকল্পিত নগরায়ণ। যানজটের কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীরাও বাংলাদেশে আসতে চায় না যা দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের এক সেমিনারে বলা হয়, যানজটের কারণে ঢাকায় প্রতি বছর আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে আনুমানিক ৩ থেকে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় ২৫ হাজার থেকে ৪২ হাজার কোটি টাকা। বলার অপেক্ষা রাখে না, সীমিত সড়ক ও যানবাহনের আধিক্যই মাত্রাতিরিক্ত যানজটের অন্যতম কারণ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, যানজটের কারণে রাজধানীতে গাড়ির গতি এবং মানুষের পায়ে হাঁটার গতি প্রায় সমান। সেমিনারে আরও বলা হয়, সড়ক খাতে বিনিয়োগ, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং যানজট নিরসনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এ ক্ষতির অন্তত ৬০ শতাংশ বা ২২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারীতে ঢাকার খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ (কেআইবি) এর ‘দি ফিউচার প্ল্যানিং আরবান ট্রান্সপোর্টেশন ইন ঢাকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে বলা হয়, যানজটের কারণে রাজধানীতে একটি যানবাহন ঘণ্টায় গড়ে ৫ কিলোমিটার যেতে পারে। ১২ বছর আগে এ গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। পাশাপাশি যানজটে শুধু ঢাকায় দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা অপচয় হচ্ছে। যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া ঢাকা শহরে সামান্য দূরত্বের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেও মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ ও সময়ের অপচয় এখন অস্বাভাবিক মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছে। হাঁটার গতির ন্যায় ঘণ্টায় প্রায় ৫ কিলোমিটারে নেমে এসেছে যন্ত্রচালিত যানবাহনের গতি। সেমিনারে আরও বলা হয়, রাজধানীতে প্রতিদিন লোকসংখ্যা বাড়ছে। বিদ্যমান যানবাহনের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে বিপুলসংখ্যক নতুন নতুন যানবাহন। কিন্তু সড়কের বেহাল দশা ও সংখ্যা থেকে যাচ্ছে সেই আগের মতোই। সরকারের ভিশনারী প্রকল্পগুলো বিশেষ করে, মেট্রোরেল স্থাপনের কাজ চলমান থাকায় নগরবাসীর দুর্ভোগ অবর্ণনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। চলমান পরিস্থিতি উত্তোরণে যেসব পরিকল্পনা বা সুপারিশ গৃহীত হয়েছে বা হচ্ছে তার বেশিরভাগই স্বল্পমেয়াদী ও অদূরদর্শী। সমম্বিত পরিকল্পনাও দৃশ্যমান নয়।

দেশের যানজট কমিয়ে আনার জন্য দেশি-বিদেশি সদস্যের সমন্বয়ে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করা যেতে পারে, যারা যানজটের প্রকৃত কারণ নির্ণয়সহ সমাধানের পরামর্শ দেবেন। যানজটের কারণে মূল্যবান শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। দুর্নীতি যেমন অর্থনীতির জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর, তেমনিভাবে যানজট কুরে কুরে দেশের অর্থনীতির বিরাট ক্ষতি করে চলছে। যানজট এক নীরব দানব এবং এর থেকে উত্তরণ দরকার। উপরন্তু যানজটের শিকার হয়ে অনেক মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবেও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। কাজেই যানজট নিরসনে অবিলম্বে সমন্বিত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট

[email protected],

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close