আল আমিন মুহাম্মাদ

  ২৭ মে, ২০২২

পর্যবেক্ষণ

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিবেশী

মানুষ সামাজিক জীব। সে একা একা বসবাস করতে পারে না। প্রতিবেশীর সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ, আন্তরিক ও সহানুভূতিশীল আচরণের মধ্য দিয়েই তাকে বাঁচতে হয়। এজন্য প্রতিবেশীর প্রতি আমাদের অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তায়।

প্রতিবেশীর আরবি প্রতিশব্দ (জার) এবং ইংরেজি প্রতিশব্দ Neighbour. পারিভাষিক অর্থে- A person who lives next to you or near you. ‘তোমার পরে বা পাশে বসবাসকারী লোক’।

প্রতিবেশী কারা? হজরত হাসান (র.) থেকে বর্ণিত, তাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছেন, নিজ ঘর থেকে সম্মুখের চল্লিশটি, পশ্চাতের চল্লিশটি, ডান পাশের চল্লিশটি ও বাম পাশের চল্লিশটি যাদের ঘর রয়েছে এরাই প্রতিবেশী।

দূরত্বের বিবেচনায় প্রতিবেশী দুই প্রকার : ১. নিকটবর্তী প্রতিবেশী ২. দূরবর্তী প্রতিবেশী। ধর্মীয় ও আত্মীয়তার সম্পর্কের দিক দিয়ে প্রতিবেশী ৩ প্রকার। যথা- ১. মুসলিম আত্মীয় প্রতিবেশী, ২. মুসলিম অনাত্মীয় প্রতিবেশী ৩. অমুসলিম প্রতিবেশী।

আচার-আচরণের দৃষ্টিতে প্রতিবেশী দুই প্রকার। ১. উত্তম প্রতিবেশী ও ২. নিকৃষ্ট প্রতিবেশী। উত্তম প্রতিবেশী সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘একজন মুসলমানের জন্য খোলামেলা বাড়ি, প্রশস্ত বাসভবন, সৎপ্রতিবেশী ও রুচিসম্মত বাহন সৌভাগ্য স্বরূপ’। পক্ষান্তরে নিকৃষ্ট প্রতিবেশী থেকে রাসূল (সা.) দোয়া করতেন এই বলে, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি দুষ্টু প্রতিবেশী থেকে স্থায়ী বাসস্থানের। কেননা দুনিয়ার প্রতিবেশী পরিবর্তন হয়ে থাকে’।

প্রতিবেশীর ব্যাপারে রাসুল (সা.)-কে জিবরাইল (আ.) বারবার তাকিদ করতেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘জিবরাইল (আ.) এসে আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে অবিরত উপদেশ দিতে থাকতেন। এমনকি মনে হতো যে, হয়তো তিনি প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিবেন’।

আমাদের জীবনকে সুন্দর করে গঠন করতে হলে অবশ্যই প্রতিবেশীর সঙ্গে নিম্নোক্ত দায়িত্বগুলো পালনে সচেষ্ট হতে হবে : ১. প্রতিবেশী আত্মীয় হোক অথবা অনাত্মীয়, মুসলিম হোক অথবা অমুসলিম যে কোনো অবস্থায় সাধ্যানুযায়ী তাদের সাহায্য-সহায়তা করা। হজরত রাসুলে করিম (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব দুঃখণ্ডকষ্ট দূর করবে, আল্লাহ কিয়ামতে তার দুঃখণ্ডকষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো সংকটাপন্ন ব্যক্তির সংকট নিরসন করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় সংকট নিরসন করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ-ত্রুটি গোপন করবে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দাকে সাহায্য করে থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা নিজ ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে’।

২. সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে ও সুখী-সমৃদ্ধশালী জীবন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে’।

৩. প্রতিবেশীর সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে বাক-বিতন্ডা বা ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া অনুচিত। কেননা এতে উভয়ের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সেই ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদে থাকে না’।

৪. প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া ও নির্যাতন করে গৃহত্যাগে বাধ্য করা অতি বড় গোনাহের কাজ। হজরত ছাওবান (রা.) প্রায়ই বলতেন, যে প্রতিবেশী তার কোনো প্রতিবেশীকে নির্যাতন করে বা তার সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করে যাতে সে ব্যক্তি গৃহত্যাগে বাধ্য হয়, সে ব্যক্তি নিশ্চিত ধ্বংসের মধ্যে পতিত হয়।

৫. প্রতিবেশী যে ধর্মেরই হোক না কেন সবাই উত্তম আচরণ পাবার অধিকারী। বাড়িতে ভালো কোনো খাদ্য বা তরকারি পাক হলে তাতে প্রতিবেশীকে শরিক করা রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ। তিনি আবু যর (রা.)-কে বলেন, ‘হে আবু যর! যখন কোনো তরকারি পাক করবে, তখন তাতে একটু বেশি পানি দিয়ে ঝোল বাড়াও এবং তোমার প্রতিবেশীকে পৌঁছাও।’

৬. নিজের জন্য যা পছন্দ করবে, প্রতিবেশীর জন্যও তাই পছন্দ করবে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এ ব্যাপারে বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! তোমাদের মধ্যে কেউ পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ নিজের জন্য যা পছন্দ করে তা প্রতিবেশী অথবা তার ভাইয়ের জন্য পছন্দ না করবে’।

৭. প্রতিবেশীর যে কোনো দুঃখণ্ডশোকে তার পাশে দাঁড়ানো, তার প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা এবং তাকে সান্ত¡না প্রদান করা নেকির কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার মুমিন ভাইকে বিপদে সান্ত¡না প্রদান করবে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তাকে সম্মানের পোশাক পরিধান করাবেন’।

৮. প্রয়োজনে প্রতিবেশীকে কর্যে হাসানা প্রদান করা। এটা এমন একটি সৎকাজ যার কারণে আল্লাহ পাক সেই দাতাকে অনেক পুণ্য দান করেন। এর ছওয়াব বহুগুণ হয় এবং এর দ্বারা অপরাধ ক্ষমা করা হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান কর, তিনি তোমাদের জন্যে তা দ্বিগুণ করে দিবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন।’ (তাগাবুন ১৭)।

৯. মানুষ দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। ভালো এবং মন্দগুণের সমন্বয়ে মানুষ। প্রতিবেশীর দোষ গোপন রাখা অবশ্য কর্তব্য। কেননা মুসলিম ভাইয়ের দোষ গোপন রাখলে আল্লাহ কিয়ামতে তার দোষ গোপন রাখবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কারো দোষ গোপন রাখে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ গোপন রাখবেন’।

১০. কোনো মুসলমান প্রতিবেশী ইন্তেকাল করলে তার জানাজায় শরিক হওয়া ও শোকাহত পরিবারকে সান্ত¡না প্রদান ও খাদ্য সরবরাহ করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের হক পাঁচটি। সালামের জওয়াব দেওয়া, রোগীকে দেখতে যাওয়া, জানাজায় শরিক হওয়া, আহ্বানে সাড়া দেওয়া, হাঁচির জবাব দেওয়া। খাদ্য সরবরাহ করা।’ মুতার যুদ্ধে জাফর (রা.) শহীদ হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের বলেছিলেন, ‘তোমরা জাফরের পরিবারের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা কর। কেননা আজ তাদের প্রতি এমন জিনিস বা এমন বিষয় এসেছে, যা তাদের ব্যস্ত রেখেছে।’

১১. প্রতিবেশীদের মাঝে কোনো বিষয়ে সমস্যা দেখা দিলে ন্যায়সঙ্গতভাবে তা সমাধান করা ইসলামের নির্দেশ। সুরা হুজরাতের ভিতর আল্লাহ পাক বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমাদের ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আশা করা যায় তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হবে।’ (হুজুরাত ৪৯/১০)।

১২. প্রতিবেশীর মান-সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রাখা যেমন জরুরি, তেমনি মাল-সম্পদ হেফাজত করাও অবশ্য কর্তব্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) একদা তাঁর সাহাবিদের ব্যভিচার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, তা কেমন? উত্তরে তারা বললেন, হারাম; আল্লাহ ও তার রাসুল তা হারাম করেছেন। তখন তিনি বললেন, কোনো ব্যক্তি দশজন নারীর সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হলেও তা তার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া অপেক্ষা লঘুতর (পাপ)। অতঃপর তিনি বললেন, কোনো ব্যক্তির দশ ঘরের লোকজনের সামগ্রী চুরি করা তার প্রতিবেশীর ঘরে চুরি করার চেয়ে লঘুতর।

১৩. সমাজের মানুষের মধ্যে সুসম্পর্ক ও আন্তরিকতা সামাজিক বন্ধনকে সুদূঢ় করে। আর পরস্পরকে দাওয়াত দিলে হৃদ্যতা বৃদ্ধি পায়। দাওয়াত কবুল করা রাসুলের নির্দেশও বটে। তিনি বলেন, যখন তোমাদের কাউকে খাবারের জন্য দাওয়াত দেয়া হয়, তখন সে যেন তাতে সাড়া দেয় বা দাওয়াত কবুল করে। অতঃপর ইচ্ছা হলে সে খাবে আর না হলে সে ছেড়ে দিবে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, যখন তোমাদের কাউকে খাবারের জন্য আহ্বান জানানো হয়, তখন সে তাতে সাড়া দিবে। যদি সে ছায়েম হয়, তাহলে সে দোয়া করবে।

১৪. দুঃখ-দৈন্য, অভাব-অনটন মানব জীবনের নিত্যসঙ্গী। এসব দিয়ে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন। আবার ধনী-দরিদ্রও

আল্লাহ করে থাকেন। সুতরাং দরিদ্র প্রতিবেশীর

খোঁজ-খবর নেওয়া আবশ্যক। প্রতিবেশী অভুক্ত থাকলে তাকে খাদ্য না দিয়ে নিজে পেট পুরে খাওয়া ঈমানদারের পরিচয় হতে পারে না। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.)বলেন, ওই ব্যক্তি পূর্ণ মুমিন নয়, যে পেট পুরে খায় আর পাশেই তার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে।

প্রতিবেশী আল্লাহ পাকের বিশেষ এক নেয়ামত। অতএব এই অপরিসীম নেয়ামতের শোকর আদায়কল্পে প্রতিবেশীর সঙ্গে সৎ আচরণের মধ্য দিয়ে পারস্পারিক সম্প্রীতি গড়ে সুন্দর এক সমাজ উপহার দেওয়াই আমাদের অবশ্যই করণীয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close