রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৬ মে, ২০২২

পর্যবেক্ষণ

চিন্তার স্বাধীনতার ওপর বর্বরোচিত হামলা

বিশ্বের অনেক দেশেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ। গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী শাসকরা যেন ঐক্যবদ্ধ। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকরা কাজের ক্ষেত্রে ডিজিটাল মাধ্যমে যে আক্রমণ ও বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন পদে পদে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে বা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, ডিজিটাল নজরদারিতে সাংবাদিকতা। ডিজিটাল নজরদারি এবং আক্রমণের মুখে সাংবাদিকতা আজকের দিনে বিশ্বজুড়ে যে হুমকি মোকাবিলা করছে সে বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ প্রয়োজন।

ইউনেসকোর থ্রেটস দ্যাট সাইলেন্স : ট্রেন্ডস ইন দ্য সেফটি অব জার্নালিজম শীর্ষক পেপার থেকে দেখা যায়, দুনিয়া জুড়ে ডিজিটাল নজরদারি ও হ্যাকিং সাংবাদিকতাকে বিপদগ্রস্ত করছে। ডিজিটাল নজরদারি সাংবাদিকের সংগ্রহ করা তথ্যকে প্রকাশ করে দিতে পারে। এতে তার সোর্সের নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। এমন নজরদারি সাংবাদিকের ব্যক্তিগত তথ্যকে উন্মুক্ত করে দিতে পারে, যা তার নিরাপত্তাকে বিঘিœত করবে। তাই বিশ্বজুড়ে অনলাইনে নিগ্রহ, নজরদারি হ্যাকিংয়ের মতো ডিজিটাল অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে সাংবাদিকের নিরাপত্তা ও পেশাগত স্বাধীনতা বিঘিœত করা হচ্ছে। রাষ্ট্র এবং নন-স্টেট প্রতিষ্ঠান উভয়ই সাংবাদিকদের চাপে ফেলতে এসব ডিজিটাল কৌশল ব্যবহার করছে। বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের ওপর ডিজিটাল হুমকির ঘটনা বাড়ছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রে নিরাপত্তা বাহিনীর ডিজিটাল নজরদারির পরিধি বৃদ্ধি স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করছে।

এ কারণে ডিজিটাল হুমকি থেকে সাংবাদিকদের সুরক্ষা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি আরববিশ্বের বিখ্যাত সাংবাদিকদের একজন আলজাজিরার শিরিন আবু আকলেহকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড শুধু তার বন্ধু ও অনুরাগীদের জন্যই দুঃখজনক ও বিপর্যয়কর আঘাত নয়, বরং এটি এই ভয়ংকর বার্তাও দেয় যে পবিত্র ভূমিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আক্রমণের মুখে রয়েছে। আবু আকলেহ সম্প্রতি পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি অভিযান কাভার করতে যাওয়া একদল সাংবাদিকের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন। উপস্থিত সাংবাদিকদের মতে, ইসরায়েলি সেনারা তার মাথায় গুলি করে। ওই সময় তিনি এবং তার প্রযোজক দুজনই প্রেস ভেস্ট পরা ছিলেন। তার কাতারভিত্তিক নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটির অভিযোগ, ইসরায়েলি সেনারা ঠাণ্ডা মাথায় আবু আকলেহকে গুলি করেছে। অভিযোগের ব্যাপারে ইসরায়েলও স্বভাবসুলভ জবাব দেয়। তাৎক্ষণিকভাবে দেশটি দাবি করে যে শিরিনকে গুলি করা ব্যক্তিটি ছিল একজন ফিলিস্তিনি। কিন্তু এই দাবি অসার প্রমাণিত হয় এবং সেনাদের বক্তব্যও মারাত্মকভাবে গ্রহণযোগ্যতা হারায়। এখন ইসরায়েল বলছে, তাদের সেনারা ‘দুর্ঘটনাবশত’ তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। কিন্তু গুলি ছোড়া নিয়ে সাধারণের যুক্তি বলছে, ইসরায়েলের ভাবনাটা এমন যে সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ প্রমাণ করতে হবে অথবা এই হত্যা নির্দেশিত ছিল এই দোষারোপ করার সুযোগ নেই। এই যুক্তিতর্ক এখন আদালতে নয়, বরং জনতার আদালতে উঠছে।

আবু আকলেহ একজন আমেরিকান নাগরিক ছিলেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র এ ঘটনা তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছে। এই ঘটনার অবশ্যই তদন্ত হওয়া উচিত। যে ব্যক্তি আবু আকলেহকে গুলি করেছে, তাকে জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু ইসরায়েলি সেনাবাহিনী নিজেরাই তদন্ত করছে, এ জন্য তারা ফিলিস্তিনি বা বৃহত্তর বিশ্বের আস্থা পাবে না। ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে কমপক্ষে ৪৭ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। ফিলিস্তিনি সাংবাদিকরা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, প্রায়ই তাদের নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক হিসেবে নয়, বরং পক্ষপাতদুষ্ট বলে ভাবা হয়। তাদের খুব কমসংখ্যকই সরকারি অনুমোদন পান। তাদের গতিবিধি সীমাবদ্ধ থাকে এবং দায়মুক্তি নিয়েই তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। গণমাধ্যমকর্মীদের মৃত্যুর জন্য ইসরায়েল কখনো কাউকে বিচারের আওতায় আনেনি। এবার আবু আকলেহের মৃত্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যেতে চাচ্ছেন ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। এ ছাড়া তাকে হত্যার আগে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস একই আদালতে দাখিল করা এক অভিযোগে দাবি করেছে যে ইসরায়েল যেভাবে গণমাধ্যমকে লক্ষ্য বানিয়েছে, তা যুদ্ধাপরাধের শামিল।

অন্যদিকে ইসরায়েল গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঢেউ দেখছে। বন্দুক ও ছুরি হামলায় ১৮ ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। ফিলিস্তিনে নাকবা দিবস পালন করা হয়। ফিলিস্তিনিরা এদিন নবগঠিত রাষ্ট্র ইসরায়েলের কাছে তাদের মাতৃভূমি হারানোর শোক প্রকাশ করে। এ মুহূর্তে যখন উত্তাপ কমানো উচিত, তখন ইসরায়েল পরিস্থিতি উত্তপ্ত করেছে। গত শুক্রবার আবু আকলেহের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শোকার্ত মানুষ পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হয়েছে। ইসরায়েল গণতন্ত্রের জন্য গর্ববোধ করে। তাই সাংবাদিকদের ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কাভার করার সুযোগ পাওয়া উচিত এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রমাণ করা উচিত যে তাদের পদক্ষেপ সাংবাদিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়। পশ্চিমা রাজনীতিকরা যেভাবে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে শত্রুতা সৃষ্টিতে উসকানি দিচ্ছেন তা গণতন্ত্রের জন্য বিরাট হুমকি তৈরি করছে বলে মন্তব্য করেছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে সক্রিয় একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ বা আরএসএফ।

বিশ্বে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে সূচক আরএসএফ প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, সাংবাদিকরা সাধারণত কর্তৃত্বপরায়ণ বা স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোতে যে ধরনের বৈরিতার মুখে পড়েন, সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে পশ্চিমের পরিণত গণতন্ত্রের দেশগুলোতেও। রিপোর্টে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, সেখানে সাংবাদিকরা যে ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, তার ফলে ‘সেলফ সেন্সরশিপ’র প্রবণতা বাড়ছে। আরএসএফ তাদের এই রিপোর্টে বলছে, সাংবাদিকদের প্রতি বৈরিতা এখন তুরস্ক বা মিসরের মতো কর্তৃত্বপরায়ণ দেশেই শুধু সীমাবদ্ধ নেই। পশ্চিমা গণতন্ত্রের দেশগুলোতেও রাজনীতিকরা এখন যে ভাষায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কথাবার্তা বলছেন, তাকে আগুন নিয়ে খেলার সঙ্গে তুলনা করেছে আরএসএফ।

শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তে থেকে শুরু করে চেক প্রজাতন্ত্র পর্যন্ত, সর্বত্র রাজনীতিকরা অশালীন ভাষায় সাংবাদিকদের গালমন্দ করছেন। এই ব্যাপারটা শুধু মৌখিক হুমকি বা ধমকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না, সেটি সত্যিকারের শারীরিক সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতে একজন সাংবাদিককে হত্যাও করা হয়েছে। আরএসএফ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ, যাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একসময় আদর্শ বলে ভাবা হতো, সেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে ভাষায় গণমাধ্যমকে আক্রমণ করছেন, তা পুরো বিশ্ব পরিস্থিতির ওপরই প্রভাব ফেলছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক সূচকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দুই ধাপ নেমে গেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখনই তার কোনো সমালোচনা করা রিপোর্ট কোথাও দেখতেন, তখনই সেটা ভুয়ো খবর বলে উড়িয়ে দিতেন। এটা খুবই উদ্বেগজনক ছিল। তিনি বিশ্বের কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকদের জন্য খুবই খারাপ একটা নজির তৈরি করছেন।

গ্রিসে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জগুলো পদ্ধতিগত, যুক্তি দেওয়া হয় যে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তসহ সরকারের পক্ষে অসুবিধাজনক সংবাদগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয় না। এটি তথ্যে জনগণের প্রবেশাধিকার এবং পরবর্তীকালে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাদের অবহিত অংশগ্রহণে একটি উল্লেখযোগ্য বাধা সৃষ্টি করে। এমআরডিএফ অভিবাসন নীতি অনুসারে, এর বাস্তবায়নে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অভিবাসী স্রোতের দ্বারা সৃষ্ট মানবিক সংকট সরকারের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। সাংবাদিকরা বাধার সম্মুখীন হয়, যার মধ্যে রয়েছে নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং আটক, মাইগ্রেশন হটস্পটে অ্যাক্সেস সীমিত করা, এ বিষয়গুলোতে রিপোর্ট করার চেষ্টা করার সময় নজরদারি এবং হয়রানি। এমনকি যখন স্বাধীন সাংবাদিকরা সরকারি তথ্যের ওপর নির্ভর করে, তখন তারা স্বচ্ছতার সম্পূর্ণ অভাব বা এমনকি তথ্য অস্বীকারের সম্মুখীন হয়। মূল্যবোধ এবং স্বচ্ছতার জন্য ইইউ কমিশনার ভেরা জোরোভা খোলাখুলিভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে আইনের শাসন রিপোর্ট দুই হাজার বাইশ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা সম্পর্কিত উন্নয়নের দিকে বিশেষ মনোযোগ দেবে। বিশেষ করে এক বছর আগে নিজের বাড়ির সামনে ক্রাইম রিপোর্টার জিওরগোস কারাইভাজকে হত্যার ঘটনায় এই উদ্বেগ আরো উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। গ্রিক ও ইউরোপীয় সাংবাদিক সমিতির চাপ সত্ত্বেও, মামলার অগ্রগতি ক্ষীণ এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা হয়নি। এমনকি রক্ষণশীল রাজনীতিবিদরাও এখন দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close