অন্জন কুমার রায়
বন্যা
সিলেটে নদীর নাব্যতা সংকট
সিলেট নগরীর কাজির বাজার থেকে শ্রীরামপুর পর্যন্ত প্রায় ৮-১০ কিলোমিটার এলাকা। শুষ্ক মৌসুমে পুরো এলাকা জুড়ে চর জেগে থাকে। তাতে ঘাস গজায়, ছোট ছেলেমেয়েরা খেলা করে। দুই কূলের মাঝখান দিয়ে খালের মতো পানি বয়ে চলে। বোঝার কোনো উপায় নেই, এটি সুরমা নদীর তীর। অথচ একসময়ের খড়স্রোতা নদী এখন নাব্যতা হারিয়ে খালের মতো রূপ ধারণ করেছে। শুষ্ক মৌসুমে সুরমা নদীর উৎপত্তিস্থল থেকে পুরো নদীর তীরই এমন মনে হয়। অন্যদিকে, বর্ষার শুরুতে নদীটি পানিতে টইটুম্বর হয়ে থাকে। বিশেষ করে উজান থেকে নেমে আসা পানি এবং ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে নদীতে পানি ফুলে ওঠে।
সাম্প্রতিক সময়ে সুরমা নদীর পানি উপচে উঠে সিলেট শহর প্লাবিত হয়। শহরের কোনো কোনো জায়গায় হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানি ছিল। যেসব নালা দিয়ে নদীতে পানি প্রবাহিত হয় সেসব নালা এখনো পানিতে ভরপুর। শহরে বিভিন্ন রাস্তা পানিতে তলিয়ে যায়। নগরীর উপশহরের বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনে পানি ওঠায় বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল। ফলে সেসব এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। ফলে, স্বাভাবিক জীবনযাপনে বিঘ্ন ঘটেছে। সবকিছু মিলিয়ে মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করেছে। এ ছাড়া শহরের কয়েকটি এলাকায় এখনো জলাবদ্ধতা দেখা যায়। বিশেষ করে শহরের তালতলা, উপশহর, কাজীর বাজার, তোপখানা, যতরপুর, সোবহানীঘাট, ছড়ার পাড়, মাছিমপুর ইত্যাদি এলাকাগুলো পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল।
সুরমা নদীটির নাব্যতা হারিয়ে যাওয়াই বন্যার প্রধান কারণ। সিলেট শহরের ভেতর দিয়ে সুরমা নদী বয়ে চলেছে। ভারতের করিমগঞ্জে বরাক নদীর দুটি শাখা সুরমা ও কুশিয়ারা নদী। এদের মিলনস্থল সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার অমলশিদ এলাকায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র মতে, একসময় বরাক নদী হয়ে আসা পানির ৬০ শতাংশ কুশিয়ারা নদী দিয়ে প্রবাহিত হতো, বাকি ৪০ শতাংশ পানি সুরমা নদী দিয়ে প্রবাহিত হতো। কিন্তু উৎপত্তিস্থল অমলশিদ থেকে ৩৩ কিলোমিটার পর্যন্ত সুরমা নদীর বিভিন্ন স্থানে চর জেগে ওঠায় বর্তমানে ৮০ শতাংশ পানি প্রবাহিত হয় কুশিয়ারা নদী দিয়ে, বাকি ২০ শতাংশ প্রবাহিত হয় সুরমা নদী দিয়ে। মূলত, সুরমা নদীতে চর জেগে ওঠায় নদীটি ভরাট হয়ে আসছে। তাই, বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢল আর ভারী বর্ষণে নদী উপচে নদীর আশপাশের এলাকাসহ সিলেট নগরীর নিচু এলাকা সহজেই প্লাাবিত হয়। এ ছাড়া নদীর তলদেশে প্লাস্টিক, আবর্জনা আর পলিথিনে ভরাট হয়ে আছে। তাই, শুষ্ক মৌসুমে নদীতে যেমন কম পানি থাকে, তেমনি বর্ষাকালে অল্পতেই পানি উপচে পড়ে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) মতে, সিলেটে পুকুর-দিঘি মিলে তিন শতাধিক জলাশয় ছিল। এর দু-তৃতীয়াংশ ভরাট হয়ে গেছে। এ ছাড়া সিলেটের ভেতর দিয়ে ছোট-বড় ২৫টি প্রাকৃতিক খাল প্রবাহিত হয়েছে, যা ‘ছড়া’ নামে পরিচিত। পাহাড় বা টিলার পাদদেশ থেকে এসব টিলার উৎপত্তি হয়ে সুরমা নদীতে মিশেছে। এসব ছড়া দিয়ে পানি নিষ্কাশনের জন্য ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে কয়েকটি ছড়া চোখে পড়লেও এগুলোর ড্রেনেজব্যবস্থা তেমন ভালো নয়। এগুলো সচল রাখারও কোনো উদ্যোগ চোখ পড়ে না। ফলে, সামান্য বৃষ্টির ফলে শহরে অতিসহজেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। আবার, এই দুটি নদীর মধ্য দিয়ে ছোট-বড় প্রায় ১০০টি নদীর পানি প্রবাহিত হয়। তাই এ দুটি নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাওয়া মানে প্রবহমান পানিপথে অন্যান্য নদীর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলা।
সর্বশেষ ২০০৪ সালে সারা দেশের মতো সিলেটে বড় ধরনের বন্যা হয়। এবারের বন্যা ও জলাবদ্ধতার জন্য সুরমা নদীর নাব্যতা সংকটই দায়ী। বিশেষ করে হাওর অঞ্চলে জলাধার নির্মাণ, নিম্নাঞ্চল ভরাট, পানির স্বাভাবিক গতিপথ বদলে দেওয়া ইত্যাদি। সুরমা নদীর গতিপথে পানির স্বাভাবিক প্রবাহের ধর্ম অনুযায়ী পাহাড়ি ঢলের শেষ গন্তব্য সিলেট-সুনামগঞ্জের হাওর। কিন্তু বর্তমান সময়ে বন্যার পানি ভাটির দিকে না নেমে সিলেট শহরের বিভিন্ন জায়গা প্লাবিত হয়। নদীর বাড়তি পানি ধরে না রাখতে পারলে পানির সৃষ্ট বাড়তি চাপে গতিপথ বদলে যায়। তাই, সুরমা নদীর পানিও অন্যদিকে প্রবাহিত হয়। যার ফলে বন্যার প্রকোপ দেখা দেয়।
সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও পাশের জেলা সুনামগঞ্জে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। আবার, ভারতের বরাক নদী থেকে প্রবলবেগে পানি ঢুকে জকিগঞ্জ উপজেলা জুড়ে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় সিলেটের গোয়াইনঘাট, সুনামগঞ্জ-ছাতক-দোয়ারা বাজার সড়ক, বিশ্বম্ভরপুর-তাহিরপুর সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বন্যার পানিতে ভেসে গিয়েছে কয়েক শ পুকুরের মাছ। খাল-বিল, নদী-নালা ও হাওরের পানি এখনে বিপৎসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হচ্ছে। পানিতে ঢেউয়ের কারণে নদীতীরবর্তী দোকানপাট, রাস্তাঘাট ক্রমেই ধসে যাচ্ছে। অনেক ফসলি জমি তলিয়ে যাচ্ছে। বন্যার পানি প্লাবিত হওয়ায় অনেকে গৃহস্থালি মালামাল রক্ষায় ব্যস্ত থাকায় আশ্রয়কেন্দ্রে অনেকেই আশ্রয় নিতে পারেনি। তাই, গবাদি পশু নিয়ে অনাহারে, অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পানির কারণে হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রাখা দুরূহ ব্যাপার। তাই অনেকেই সস্তা দামে এগুলো বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।
বন্যাকবলিত এসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, শিশুখাদ্য, শুকনো খাবার, গো-খাদ্যের মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। প্লাবিত এলাকায় জ্বর, ডায়রিয়া, আমাশয়, জ-িসসহ পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। তবে, পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় ওষুধ, খাবার স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে।
টানা পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টি হলে সুরমা এবং কুশিয়ারা নদীর খনন ছাড়া সিলেটের বন্যা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সুরমা নদী পানির ধারণক্ষমতা হারিয়েছে। খনন হলে পানির ধারণক্ষমতা থাকবে। পাশের জেলা মৌলভীবাজারের মনু নদী খনন হওয়ায় মৌলভীবাজার শহর বন্যামুক্ত হয়েছে। তাই সুরমা এবং কুশিয়ারা নদী খনন করলে সিলেটের এলাকা বন্যার কবল থেকে রক্ষা পাবে। এ দুটি নদী খনন না করলে সিলেট অঞ্চলের সব নদীই একসময় বিপন্ন হয়ে পড়বে। কয়েক বছর পরপর বন্যা দেখা দেবে, ফসলের ক্ষতি হবে, মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"