সাহাদাৎ রানা

  ২৪ মে, ২০২২

দৃষ্টিপাত

রোহিঙ্গা সমস্যার শেষ কোথায়?

সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে রাজি করানোর জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্থা-আসিয়ানকে পাশে চেয়েছে বাংলাদেশ। এজন্য আসিয়ান সদস্যভুক্ত দেশগুলোকে প্রভাবিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিও আহ্বান জানানো হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। এমন আহ্বান অবশ্য নতুন নয়, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে। এখনো হচ্ছে। কিন্তু সে অর্থে কার্যকর কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। বাস্তবতা হচ্ছে রোহিঙ্গারা দিন দিন আমাদের জন্য বোঝা হয়ে উঠছে। নানা সমস্যার মধ্যে আরো একটি সমস্যা ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।

রোহিঙ্গা বিষয়ে এবার একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। প্রায় পাঁচ বছর আগে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ। দেখতে দেখতে বেশ কটি বছর পার হয়ে গেলেও এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকার এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। আদৌ নেবে কি না তাও স্পষ্ট নয়। কারণ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের আন্তরিকতায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে এটা স্পষ্ট। তাই রোহিঙ্গা সমস্যা কবে সমাধান হবে তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। অথচ বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রতি বরাবরই উদারতার পরিচয় দিয়েছে, এখনো দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার শুরু থেকেই কাজ করছে। অনেক জায়গায় সফলতাও রয়েছে। প্রায় তিন বছরের বেশি সময় আগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালত রায় দিয়েছেন। যেখানে মিয়ানমারের প্রতি অবশ্য পালনীয় চারটি অন্তর্বর্তী আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত বা আইসিজে। এই রায় বাংলাদেশের জন্য বহুল প্রত্যাশিত। কেননা, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ বলে আসছিল রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের কথা। তাই রায়টির জন্য অপেক্ষায় ছিল বাংলাদেশ, যা প্রায় দুই বছরের বেশি সময় হতে চলল। ২০১৯ সালের ১০, ১১ ও ১২ ডিসেম্বর টানা তিন দিন আন্তর্জাতিক আদালতে এ মামলার শুনানি হয়। যেখানে মিয়ানমারের পক্ষে তৎকালীন স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি অংশ নেন। যদিও তিনি রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। তবে সু চির বক্তব্য আমলে নেয়নি আন্তর্জাতিক আদালত। আদেশে আদালত মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে বলেছে। পাশাপাশি রাখাইন রাজ্যে এখন যেসব রোহিঙ্গারা বাস করছেন তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এর পরও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক। কেননা, রোহিঙ্গাদের একাংশকে নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী বসবাসের জন্য ভাসানচরে নির্মিত হয়েছে এক মনোরম আশ্রয়কেন্দ্র। যেখানে রয়েছে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা থেকে শুরু করে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, থানা ও বাজার। শুধু তাণ্ডই নয়, সেখানে রোহিঙ্গাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করারও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তার কথা ভেবে পুরো প্রকল্পটি নিয়ন্ত্রিত হবে সিসি ক্যামেরা দ্বারা। এত চমৎকার উদ্যোগ নেওয়া হলেও রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ ভাসানচরে যেতে আগ্রহী নয়। অথচ তারা বর্তমানে যেখানে আছেন, সেখান থেকে শতভাগ ভালো ব্যবস্থা রয়েছে ভাসানচরে। সরকারের পক্ষ থেকে এমন উদ্যোগ সত্যি প্রশংসনীয়। তবে এটা কোনোভাবেই স্থায়ী সমাধান নয়। রোহিঙ্গাদের একমাত্র প্রত্যাবাসনের মাধ্যমেই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব।

কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হলো আমাদের জন্য রোহিঙ্গা বোঝা ক্রমেই যেন ভারী হচ্ছে। রীতিমতো অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। তবে সরকার বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ নিয়েও তাদের নিজ দেশে পাঠাতে পারছে না। রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু মানবিক কারণ ও সরল বিশ্বাসে সেই আশ্রয় দেওয়াটা যেন এখন ক্রমেই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের জন্য। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। এই বোঝা সামাল দেওয়া একটি দেশের জন্য সত্যিই কঠিন। সাম্প্রতিক সময়ে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। রোহিঙ্গাদের এমন অপরাধপ্রবণতা সত্যিই উদ্বেগজনক। কারণ তাদের অপরাধ নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রায় হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। যেখানে রয়েছে অস্ত্র ও মাদক থেকে শুরু করে খুনের মামলাও। এমন তথ্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য সুখকর নয়। এ ছাড়া অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। বাস্তবতা হলো আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের আর্থসামাজিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এত দীর্ঘ সময় ধরে রোহিঙ্গারা এখানে বসবাস করায় নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থাকেও সংকটাপন্ন করে তুলেছে। ইদানীং রোহিঙ্গারা শরণার্থী ক্যাম্পের নিয়মের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে বসতি স্থাপন করেছে। শুধু তাণ্ডই নয়, তাদের অবাদ বিচরণ স্থানীয় শ্রমবাজারে পড়েছে বিরূপ প্রভাব। এতে স্থানীয়দের মধ্যে প্রতিনিয়ত ক্ষোভ বাড়ছে।

মনে রাখা উচিত, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর করা হলেও এটা হলো অস্থায়ী সমাধান। সঠিক সমাধান হলো রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন। জাতিসংঘে ৭৪তম সাধারণ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চার দফা প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর চার দফা প্রস্তাবের প্রথমটি ছিল- ‘রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন এবং আত্তীকরণে মিয়ানমারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পূর্ণ প্রতিফলন দেখাতে হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাবে ছিল- ‘বৈষম্যমূলক আইন ও রীতি বিলোপ করে মিয়ানমারের প্রতি রোহিঙ্গাদের আস্থা তৈরি করতে হবে এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের রাখাইন সফরের আয়োজন করতে হবে।’ তৃতীয় প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বেসামরিক পর্যবেক্ষক মোতায়েনের মাধ্যমে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তার শেষ প্রস্তাবে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণ সমূহ বিবেচনায় আনতে হবে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অন্যান্য নৃশংসতার দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে।’ এ ছাড়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনেও প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে পাঁচ দফা প্রস্তাব করেছিলেন বলে উল্লেখ করেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে রোহিঙ্গা সমাধানে প্রস্তাব তুলে ধরলেও শঙ্কার জায়গা হলো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইস্যুতে জাতিসংঘ ও প্রভাবশালী দেশগুলো দীর্ঘদিনেও মিয়ানমারের ওপর তেমন কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। বরং তারা বলছে, শরণার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না। এখন প্রশ্ন হলো- তারা কেন মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে না। যদি জাতিসংঘ ও প্রভাবশালী দেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের ওপর যথাযথ চাপ সৃষ্টি করা যেত অনেক আগেই এই সংকটের সমাধাণ সম্ভব হতো। কিন্তু এ বিষয়ে প্রভাবশালী দেশগুলো জোরালো ভূমিকা রাখছে না। বরং ক্ষেত্রবিশেষে তাদের ভূমিকা প্রশ্নসাপেক্ষ।

এখন প্রশ্ন হলো, এভাবে কত দিন আমাদের জন্য বোঝা হয়ে থাকবে রোহিঙ্গারা। যদি বছরের পর বছরের এভাবে চলতে থাকে তবে বাংলাদেশের রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। শুধু তাণ্ডই নয়, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বড় ধরনের নিরাপত্তার সংকট তৈরি করতে পারে। এর কিছু উদাহরণ আমরা এরই মধ্যে পেয়েছি। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের হাতে বাংলাদেশি খুন হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইস্যুতে জাতিসংঘ এবং বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিলেও সেই অর্থে কোনো জোরালো উদ্যোগ দেখা যায়নি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হওয়া মানেই আরো দীর্ঘ মেয়াদে তা ঝুলে যাওয়া। এর জন্য রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য সবচেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি করতে হবে মিয়ানমারের ওপর। পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে কোনো গোষ্ঠী যেন পরিস্থিতি জটিল করতে না পারে সেদিকেও নজর রাখতে হবে। ভাসানচরে স্থানান্তর সিদ্ধান্ত অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে এটা কোনোভাবেই স্থায়ী সমাধান নয়। রোহিঙ্গাদের একমাত্র প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে যাবতীয় সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী দেশগুলোকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close