অরূপ তালুকদার

  ২৪ মে, ২০২২

মতামত

কী ঘটতে চলেছে শ্রীলঙ্কায়?

একসময়ের দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের রোল মডেল হিসেবে খ্যাত ছিল দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। সেই দেশটি এখন নানা সমস্যা এবং সংকটের কারণে মহাদুর্দশায় পড়েছে। শুধু তাণ্ডই নয়, এরই মধ্যে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের দেশ শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার ফলে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে দেশটি পরিণত হয়েছে ‘দেউলিয়ারাষ্ট্রে’।

কিছুদিনের মধ্যে সেখানে অতিদ্রুত যেসব ঘটনা ঘটেছে এবং এখনো ঘটে চলেছে, তাতে দেশটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই এখন কষ্টকর হয়ে উঠছে। কারণ প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে পাল্টে যাচ্ছে সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি। তামিলদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য একসময় যে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল, তা চলেছিল প্রায় ২২ বছর ধরে এবং তার সমাপ্তি ঘটেছিল ২০০৯ সালে ও নির্দ্বিধায় বলা যায়, সেই দীর্ঘকালব্যাপী চলা এই গৃহযুদ্ধ দেশটির সাধারণ মানুষের সামাজিক সম্প্রীতির ভিত একেবারে নড়বড়ে করে দিয়েছিল।

সার্বিকভাবে শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির শুরুটা হয়েছিল প্রচণ্ড অর্থনৈতিক সংকটকে কেন্দ্র করে। বেশ কিছুদিন আগে থেকে বর্তমান সরকার সাধারণ মানুষের কাছে নিজের ভাবমূর্তি বড় করে দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যাপকভাবে কর হ্রাসের ঘোষণা দেওয়ার পর সরকারের রাজস্ব আয় একেবারেই কমে যায়। ফলে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দেয়। পরে সেই বিশাল ঘাটতি পূরণ করার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিপুল পরিমাণ কাগুজে টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ার ফলে স্বাভাবিকভাবে বাজারে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়। কমে যায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। পাশাপাশি সরকার ডলারের নির্ধারিত মূল্য একইভাবে রেখে দেওয়ার কারণে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকরা তাদের উপার্জিত রেমিট্যান্স দেশে পাঠাতে থাকেন হুন্ডির মাধ্যমে। যাতে স্বাভাবিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সরকার। এদিকে আবার কোনো ধরনের পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই হঠাৎ করে অরগানিক

চাষাবাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার। তার ফলে রাসায়নিক সার ব্যবহার বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। সে কারণে একদিকে যেমন কৃষি উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যায়, অন্যদিকে খাদ্যপণ্যের নানা রকম সংকট দেখা দেয়। ফলে অস্বাভাবিকভাবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। এ ছাড়া দ্বীপরাষ্ট্রটির

একটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিপণ্য চা, নানা সমস্যার কারণে তার উৎপাদন এবং রপ্তানি ব্যাহত হতে থাকে, যার ছায়াপাত ঘটে রাজস্ব আদায়ের ওপর এবং একসময় অবধারিতভাবে যার প্রভাব পড়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর, পরে যা বিপজ্জনক পর্যায়ে নেমে আসে।

অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কার আরেকটি অর্থনৈতিক খাত ছিল পর্যটন। ২০১৯ সালে ইস্টার বোমা হামলার কারণে এই খাতটিতে ধস নেমে আসে। এরপর ২০২০ সাল ভয়ংকর করোনা মহামারির জন্য সারা বিশ্বের সব দেশের জন্যই ছিল আতঙ্ক আর সমস্যাসংকুল। এই পরিস্থিতিতে পড়ে শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাত একেবারেই মুখ থুবড়ে পড়ে। পরবর্তীকালে এই খাতটি ঠিকভাবে আর দাঁড়াতেই পারেনি। ফলে সার্বিক অর্থনৈতিক সমস্যা ক্রমেই বেড়ে যেতে থাকে এবং সাধারণ মানুষ পড়ে মহাদুর্ভোগে।

মারাত্মক সংকট দেখা দেয় জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্য, ওষুধসহ সর্বক্ষেত্রে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য সংকট

দেখা দেয় কাগজের। কাগজ না পাওয়ার জন্য সংবাদপত্রের প্রকাশনা পর্যন্ত বাধাগ্রস্ত হয়। এরই মধ্যে বিভিন্ন

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, সাম্প্রতিক অবস্থা আরো ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছায়। ৯ মে শ্রীলঙ্কান

প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ক্রমবর্ধমান গণবিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কারণ বিক্ষুব্ধ জনগণ রীতিমতো মারমুখী হয়ে হামলা চালাচ্ছিল বিভিন্ন স্থানে। হামলাকারীরা একপর্যায়ে মাহিন্দার পৈতৃক বাড়িসহ বেশ কটি বাসস্থান আগুনে পুড়িয়ে দেয়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, যে কারণে রাজাপাকসের জীবন বাঁচাতে তাকে সরিয়ে নেওয়া হয় ত্রিঙ্কুমালির একটি নৌঘাঁটিতে।

ধারণা করা হচ্ছে, মাহিন্দা রাজাপাকসের ছোট ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের দিনও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। বিক্ষোভকারীরা কদিন আগে থেকেই গোতাবায়ারও পদত্যাগ দাবি করে আসছে। এর পেছনে সাম্প্রতিক সময়ের ক্ষোভ এবং প্রতিবাদ ছাড়াও একটা অতীত কাহিনি আছে, সেটি হচ্ছে ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধের একেবারে শেষপর্যায়ে তামিলদের সশস্ত্র সংগঠন এলটিটিইর বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কা সরকার যখন ভয়াবহ অভিযান চালিয়েছিল, সে সময় বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া ছিলেন দেশটির তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা ছিলেন প্রেসিডেন্ট। সেদিনের নির্মম অভিযানের স্মৃতি এখনো অনেকের মনে জাগরূক রয়েছে।

সর্বোপরি ২০০৫ সাল থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকে পরবর্তীকালেও ক্ষমতায় থাকার জন্য নিজেদের সুবিধার্থে রাজাপাকসে পরিবার বারবার সংবিধান সংশোধন করেছে। দেশের সাধারণ মানুষ এ বিষয়টি কখনো ভালো মনে নেয়নি, ভালো চোখেও দেখেনি। এ ছাড়া তামিল এবং সিংহলিদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে যে একটি অন্তর্নিহিত বিভেদ রেখা এবং সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা রয়েছে সেই মানসিকতা নানাভাবে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করেছে রাজাপাকসে পরিবার। এসব কৌশল এবারে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে। এর সবকিছুর ফলে তাদের এখন একটাই দাবি, রাজাপাকসে পরিবারের ক্ষমতা থেকে পতন ও বিদায়।

কারণ এরই মধ্যে দেশের সাধারণ মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য রাজাপাকসের পরিবারের ব্যাপক দুর্নীতি এবং উচ্চাভিলাষই দায়ী।

এদিকে গোতাবায়া নিজের পদ ও ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তড়িঘড়ি করে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন রনীল বিক্রমাসিংহেকে, যার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে। ফলে বিক্ষোভকারীদের প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ থামেনি। বরং তারা নতুন করে কয়েক দফা দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিক্ষোভ জোরদার করেছে।

তাদের উত্থাপিত দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে : অনতিবিলম্বে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগ, একটি অস্থায়ী সরকার গঠন যার মাধ্যমে চলমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট সমাধানের দায়িত্ব থাকবে এবং সেই সরকার-পরবর্তী ১৮ মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচনের আয়োজন করবে, সংবিধানের কিছু ধারা পরিবর্তনসহ ২০তম সংশোধনী বাতিল, কথিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবশ্যই স্বচ্ছতার ভিত্তিতে চলমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে, নির্বাচিত সব জনপ্রতিনিধিকে বাধ্যতামূলক তাদের সব সহায় সম্পত্তির হিসাব দিতে হবে, কেউ যদি অবৈধ সম্পদের মালিক হয়ে থাকে তাহলে সেই সম্পদ সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে হবে, দেশব্যাপী আইনের শাসন এমনভাবে নিশ্চিত করতে হবে, যাতে দেশের সব নাগরিক এবং পর্যটকদের অধিকার রক্ষিত হয় এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ শেষ হয়ে গেলে তা ভেঙে দিয়ে সব ক্ষমতা জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে হস্তান্তর করা।

এই পরিস্থিতির মধ্যে ভবিষ্যৎ বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া জনসমক্ষে না এসেও এরই মধ্যে নতুন অর্থমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন এবং সর্বদলীয় সরকার গঠনের আহ্বান জানাতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু তাতে জনগণ আশ্বস্ত হয়নি। এমনকি প্রেসিডেন্টের আহ্বানে এখন পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার কোনো রাজনৈতিক দল সাড়া দেয়নি। এদিকে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে করতে আমাদের দেশেও কেউ কেউ নতুন করে দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। সমমনাদের কাছে বলে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশের অবস্থা একসময় শ্রীলঙ্কার মতো হলেও হতে পারে। কেউ আবার নানাভাবে যখন তখন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সাবধান বাণীও উচ্চারণ করেছেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আসলে কি বাংলাদেশের পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো সমস্যাসংকুল ও সংকট পূর্ণ কোনোদিন হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া তেমন সহজ না হলেও, তেমন কঠিন কিছু নয়। কারণ বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ এখনো সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। আর তালিকা না দিয়েও যেসব মেগা প্রকল্পের কথা বলা হয় তার কিছু কিছু প্রকল্প যদিও অন্যান্য দেশের তুলনায় কমবেশি অতিমূল্যায়িত, তবে তা দেশের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় নয়। এর পরও এটা বলা প্রয়োজন, হাজার হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে নানাজনের নানা মত থাকতে পারে, যার সবটাই হয়তো সত্য বা মিথ্যা নয়। এ ক্ষেত্রে সিপিডির অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান যা বলেছেন, তা নিয়ে আমাদের

ভাবনাচিন্তা করার অবকাশ রয়েছে! তিনি বলেছেন, দুদেশের পরিস্থিতি তুলনীয় নয়, তবে এতে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষণীয় রয়েছে।

লেখক : শব্দসৈনিক ও কথাসাহিত্যিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close