লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান

  ১৯ মে, ২০২২

দৃষ্টিপাত

নীরব ঘাতক উচ্চরক্তচাপে করণীয়

গত ১৭ মে ছিল বিশ্ব উচ্চরক্তচাপ দিবস। বিশ্ব হাইপারটেনশন লিগের (WHL) সদস্য হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও উচ্চরক্তচাপ দিবস পালিত হয়েছে। উচ্চরক্তচাপ একটি নীরব ঘাতক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। কারণ বাংলাদেশে শতকরা ২১ ভাগ মানুষ উচ্চরক্তচাপে ভুগছে; এরমধ্যে অর্ধেক নারী এবং দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষই জানে না যে, তাদের উচ্চরক্তচাপের সমস্যা রয়েছে। নীরবে এ ব্যাধি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের ক্ষতি করতে থাকে। 

এ সমস্যার শেকড় খুঁজতে মানবদেহের কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। দৈহিক ও শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ড বিস্ময়কর। প্রায় ৩৮ ট্রিলিয়ন কোষ, শতাধিক ছোট-বড় অঙ্গ ও ১১টি তন্ত্রে প্রতি মুহূর্তেই ঘটতে থাকে মহাকর্মযজ্ঞ। কিছু কর্মকাণ্ড আমরা চোখে দেখি কিংবা টের পাই; সিংহভাগই ঘটে থাকে আমাদের অগোচরে বা অণুবীক্ষণিক। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ছন্দময় এ কর্মশালা।

রক্ত সংবহনতন্ত্র আমাদের শরীরের অন্যতম তন্ত্র, যা মূলত শরীরের বিভিন্নাংশে প্রয়োজনীয় পুষ্টি, হরমোন কিংবা বিভিন্ন উপাদান আনা-নেওয়ার কাজ করে। হৃৎপিণ্ডটি এ তন্ত্রের প্রধান কেন্দ্র; তা থেকে সাড়া দেহে ছড়িয়ে পড়ে মহাধমনী, মহাশিরা, ধমনী, রক্তনালি, শিরা ও উপশিরা। নদীপ্রবাহের মতোই আমাদের সারা দেহে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এসব শিরা-উপশিরা। এদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় তরল রক্ত। রক্ত সংবহনতন্ত্রের কেন্দ্র বা হৃৎপিণ্ড একটি গড় সাধারণ চাপে এসব নালি বা শিরার মাধ্যমে সারা শরীরে রক্ত ছড়িয়ে দেয় কিংবা শরীর থেকে হৃৎপিণ্ডে ফিরিয়ে আনে। রক্তনালির মাধ্যমে শরীরে রক্ত ছড়িয়ে দিতে হৃৎপিণ্ড সংকোচনের সময় যে চাপ প্রয়োগ করে সেটাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, সিস্টোলিক রক্তচাপ; আর সারা দেহ থেকে রক্তকে হৃৎপিণ্ডে ফিরিয়ে আনতে হৃৎপিণ্ড প্রসারিত হতে যে প্রসারণ চাপ প্রয়োগ করে তাকে বলা হয় ডায়াস্টোলিক চাপ। সাধারণভাবে সিস্টোলিক রক্তচাপ ১২০ মিমি অব মার্কারি এবং ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ ৮০ মিমি অব মার্কারি হয়ে থাকে। 

রক্ত সংবহনতন্ত্রের যেকোনো অংশে কোনো সমস্যা দেখা দিলেই এ চাপ বেড়ে যেতে পারে; অনেক ক্ষেত্রে কমেও যায়। বেড়ে যাওয়া চাপকেই বলা হয় উচ্চরক্তচাপ বা হাইপারটেনশন। রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গেলে; সাধারণভাবে ১৪০/৯০ মিমি অব মার্কারি বা তার বেশি হলেই বুঝতে হবে উচ্চরক্তচাপের সমস্যা রয়েছে। তবে, একবার প্রেশার বেশি হলেই হাইপারটেনশন বলা যাবে না। সাধারণত পরপর তিন মাস রক্তচাপ বেশি পেলে হাইপারটেনশন রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে বয়সভেদে এর তারতম্য দেখা দিতে পারে। 

বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৭০ কোটির ওপর মানুষ হাইপারটেনশনে ভুগছে। শতকরা হিসাবে এই হার ২২ ভাগ; আফ্রিকায় এর হার ২৭ ভাগ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ২৫ ভাগ, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ২৬ ভাগ, শতকরা হারের দিকে আমেরিকা অঞ্চলে এ হার কিছুটা কম ১৮-১৯ ভাগ। মারা যাচ্ছে বছরে প্রায় ১ কোটি মানুষ, যা সব সংক্রামক রোগে মৃত্যুর চেয়েও বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, হাইপারটেনশন রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি হচ্ছে, এ বৃদ্ধির হার বছরে প্রায় ০.০৫ ভাগ। বাংলাদেশে দেড় কোটিরও বেশি লোক হাইপারটেনশন রোগে ভুগছে। আইসিডিডিআর,বির গবেষণা তথ্য মতে, জনসংখ্যার প্রতি পাঁচজনে একজন ভুগছে এ রোগে। তুলনামূলক নারীদের (২০ ভাগ) তুলনায় পুরুষদের (২৫ ভাগ) এ রোগে বেশি ভুগতে দেখা যায়। 

অনেক ক্ষেত্রেই হাইপারটেনশনের কারণ অজানা। তবে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বংশগত বৈশিষ্ট্য, দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ, স্থূলতা, ডায়াবেটিস রোগ, অলস জীবনযাত্রা, শারীরিক পরিশ্রমে কমতি, চর্বিযুক্ত খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ, ধূমপান ও অ্যালকোহল পান ইত্যাদিকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। হাইপারটেনশনের আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বেশির ভাগ সময়ই এর লক্ষণ বা উপসর্গ টের পাওয়া যায় না; সাধারণত অন্য কোনো রোগের পরীক্ষার সময় বা কোনো কারণে রক্তচাপ মাপার সময় রোগটি ধরা পড়ে। অনিয়ন্ত্রিত হাইপারটেনশনের রোগীদের প্রায়ই প্রচণ্ড মাথাব্যথা, মাথা ঘোরানো, ঘাড়ব্যথা, বমি ভাব বা বমি হওয়া, অস্থির ভাব, ঘুম কম হওয়া, মাথা গরম হয়ে থাকা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে নাক দিয়ে রক্ত পড়া, বুকে ব্যথা , দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, হৃৎপিণ্ডে অনিয়মিত স্পন্দন, হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ফেইলর দেখা দিতে পারে। 

উচ্চরক্তচাপের প্রধান লক্ষ্যস্থল মানবদেহের মূল অঙ্গ মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, কিডনি ও চোখসহ বেশ কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। হাইপারটেনশনে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ কিংবা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সারা বিশ্বে হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ উচ্চরক্তচাপ। দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপে মানুষের কিডনি বিকল হয়ে যায়। বাংলাদেশে কিডনি রোগে ভুগছে এমন রোগীর সংখ্যা দেড় কোটিরও বেশি। কিডনি রোগের ফলে এলডোস্টেরন নামক হরমোন বৃদ্ধি পায়, স্থূলতা বাড়ে এবং ডায়াবেটিস রোগের উৎপত্তি হয়। শরীরের ফুসফুস ও রক্তনালিরও বিস্তর ক্ষতি করে হাইপারটেনশন। চোখের রেটিনা নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণও উচ্চরক্তচাপ। 

জীবনযাত্রায় সামান্য নিয়ম-কানুন মানলেই হাইপারটেনশনের টেনশন থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব। মূলত খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, ব্যায়াম, শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ টেনশনকে দূর করা যায়। অতিরিক্ত লবণ খাওয়া পরিহার, ফ্যাটযুক্ত খাবার নিয়ন্ত্রণ, ওজন কমানো, ধূমপান ও মধ্যপান পরিহার করতে পারলেই নীরব এ ঘাতক ব্যাধি আমাদের থেকে দূরে থাকবে। লবণ খেতে হবে প্রতিদিন ৫ গ্রামের কম, প্রতিনিয়ত শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে, যতটা সম্ভব দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা, উচ্চরক্তচাপ শনাক্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ সেবন, নিয়মিত রক্তের চাপ পরিমাপ ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হতে হবে।

বিশ্ব উচ্চরক্তচাপ দিবস ২০২২-এর প্রতিপাদ্যেই হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি রয়েছে, Measure your blood pressure accurately, control it, live longer. অর্থাৎ ‘সঠিকভাবে রক্তচাপ মাপুন, নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং দীর্ঘজীবী হন।

লেখক : সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা

জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা, ঢাকা

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close