ড. মুহাম্মদ আবদুল মুমীত

  ১৮ মে, ২০২২

মতামত

গুরু-শিষ্যের গূঢ় রহস্য

মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করলেও পদে পদে শৃঙ্খলার শিকলে বন্দি মানুষের জীবন। অসীম চাওয়ার রাজ্যে মানুষের পাওয়াগুলো নিতান্তই আপেক্ষিক। চাওয়া-পাওয়ার চোরাবালিতে মরীচিকাময় স্বপ্নে বিভোর মানুষগুলোর আকাক্সক্ষার যেন শেষ নেই। এ হিসাব এতটাই নির্মম ও নিষ্ঠুর যার নির্মমতায় আপন-পর ঠাহর করাই মুশকিল হয়ে পড়ে। তৈরি হয় অবিশ্বাস, ভেঙে পড়ে সংসার, ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে পড়ে বন্ধন, ভূলুণ্ঠিত হয় মানবতা। অতৃপ্ত আত্মা এতটাই বেসামাল হয়ে পড়ে যে, মিথ্যে তৃপ্তির আস্বাদন লাভে ন্যূনতম সামাজিকতা দেখানোর প্রয়োজনও বোধ করে না। কিন্তু সামাজিক বন্ধনের দৃঢ়তার ওপরই নির্ভর করে আত্মার প্রশান্তি, বিষয়টি বেমালুম ভুলে যায়। অদৃশ্য এ বন্ধন নির্মাণে তাই প্রয়োজন হয় গুরুর দীক্ষা, আবির্ভূত হয় শিষ্য।

মূলত এই পৃথিবী একটি শিক্ষা ক্ষেত্র, যেখানে শিখন-শেখানোর আবর্তে আবর্তিত হয় মানুষের জীবন। যদি বন্ধন সুদৃঢ় হয় তাহলে শিক্ষা হয় স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাণবন্ত, অন্যথায় তা আকর্ষিত ও মূঢ় হয়ে পড়ে। বিশ্বজোড়া পাঠশালাসদৃশ শিক্ষার এ ভুবনে গুরু-শিষ্য বলতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বোঝানো হলেও এর অর্থ ব্যাপক। জোয়েল সেøকো বলেছেন, ‘গু’ মানে অজ্ঞতা আর ‘রু’ মানে বিতরণকারী, গুরু মানে সেই ব্যক্তি যিনি সব ধরনের অজ্ঞতা দূর করেন। ক্যারেন পেচেলিসের মতে, ‘অন্ধকার দূরকারী, যিনি পথনির্দেশ করেন’ তিনিই গুরু। অন্যদিকে যিনি শূন্য মস্তিষ্কে গুরুর কাছে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের সঙ্গে জ্ঞান লাভ করেন এবং গুরুর আজ্ঞা পালন করেন তিনিই শিষ্য। 

জন্মগুরু পর্ব : এই পর্বে মা-বাবা একদিকে জন্মদাতা, অন্যদিকে আবার শিক্ষক হিসেবে শিক্ষাগুরুর ভূমিকাও পালন করে থাকেন। সে ক্ষেত্রে বাবা-মা-ই শিশুর বুনিয়াদি শিক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হন। তাই বাবা-মাকে এ সময় যথেষ্ট যত্নবান ও মনোযোগী হতে হয় শিশুর প্রতি। শৈশবকালে বাবা-মার সামান্যতম অনীহা বা অযত্ন শিশুর চলার ছান্দিক স্বকীয়তা ও শিক্ষার পরিবেশ বিঘিœত করতে পারে। মাতাণ্ডপিতার যেমন সন্তানের ওপর দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, সন্তানকেও তেমনি মা-বাবার সন্তুষ্টি অর্জনের প্রচেষ্টায় মনোযোগী থাকতে হবে সর্বান্তকরণে। মহান এ দায়িত্ব যথাযথ পালনের মাধ্যমেই তৈরি হতে পারে আত্মিক বন্ধন, যা এনে দিতে পারে আত্মার পরম সুখ। সন্তানকে এ বিষয়টি সমগ্র জীবনের বিনিময়ে উপলব্ধি করে তার যথাযথ মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে, অন্যথায় জীবনের প্রকৃত নির্যাস আস্বাদন সম্ভব নয়। শূন্য থেকে শুরু হয়ে পর্যায়টি ছয় বছর, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আরো বর্ধিত হতে পারে, কিন্তু বন্ধন টিকে থাকে আমরণ। সন্তান জন্ম দিয়েই জন্মদাতা আর শিশু হিসেবে জন্ম নিয়েই সন্তান হওয়া যায়, কিন্তু গুরু-শিষ্য পর্যায়ের জন্মদাতা ও সন্তান হতে থাকা চাই অনেক অর্জন। পবিত্র সম্পর্ক, শ্রদ্ধাবোধ, কর্তব্যবোধ ও আনুগত্যের ওপর-ই নির্মিত হয় এ পর্বের সাফল্যের বন্ধন।

শিক্ষাগুরু পর্ব : কৈশোর ও বয়োসন্ধিকাল পেরিয়ে মানবশিশু এ পর্বে এসে যৌবনে পদার্পণ করে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষককেই মূল ভূমিকায় অবতীর্র্ণ হতে হয়। শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীকে জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সুযোগ তৈরি করে দেয়। শিক্ষাই মানুষকে জৈবিকতার নিচের ঘর থেকে মনুষ্য লোকের ওপরের ঘরে পৌঁছে দেয়। এখানে এসেই মানুষ বুঝতে শেখে অর্থ সাধনার চেয়ে জীবন সাধনা বড় এবং জীবন সাধনায় মুক্তি। শুধু অর্থ আর শক্তিই নয়; নিষ্ঠা, সততা, ন্যায়বোধ, দেশাত্মবোধ, সহমর্মিতা, সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্য ইত্যাদি নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ মানবকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এই পর্বে এসে শিক্ষক একদিকে শিক্ষাগুরু ও অন্যদিকে জন্মগুরুর ভূমিকাও পালন করে থাকেন। এজন্য একজন সুশিক্ষক কখনো শিক্ষক, কখনো পিতা, কখনো অভিভাবক, আবার কখনো বা বন্ধু। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে তাই থাকতে হবে এক অদৃশ্য পবিত্র সুসম্পর্ক, ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য। শিক্ষক যেভাবে তার শিক্ষার্থীকে সত্য ও আলোর সন্ধান দেন, একজন শিক্ষার্থীকেও সারা জীবন দিয়ে সেই আলোর মূল্য খুঁজে বেড়াতে হবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। এ পর্যায়টি ছয় বছর থেকে শুরু হয়ে চব্বিশ বছর বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কমণ্ডবেশি হতে পারে। শিক্ষা দিলেই শিক্ষক আর শিক্ষা নিয়েই শিক্ষার্থী হওয়া যতটা সহজ, গুরু-শিষ্য স্তরের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী হওয়া ততটা-ই কঠিন। এর জন্য থাকা চাই মঙ্গলবোধ, শ্রেয়বোধ ও মনুষ্যত্ববোধের মতো মহৎগুণের সন্নিবেশ।

কর্মগুরু পর্ব : কর্মজীবন মানুষের এক বিস্ময়কর আর অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। কারণ এ ক্ষেত্রে গুরুর কোনো নির্দিষ্টতা থাকে না। কর্মজীবনে এসে মানুষ তার সমগ্র জীবনের এক বৃহৎ অংশ অতিবাহিত করে কর্মক্ষেত্রে, তাই কর্মক্ষেত্রের প্রশান্তি জীবনের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। শিক্ষাজীবন শেষ করে মানুষ যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করে, অনেক কিছুই তার কাছে অপরিচিত মনে হয়। সে সময়ের সমস্যা-সংকুল সমুদ্র পাড়ি দিতে বস বা মনিবের দীক্ষা অতি প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মানুষ তার প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে অর্জিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এখানে কাজে লাগাতে পারে কর্তৃপক্ষ বা মনিবের সহযোগিতায়। যেখানে প্রয়োজন হয় আন্তরিকতা, আস্থা ও বিশ্বস। পিতাণ্ডমাতা ও শিক্ষক যেমন জীবনকে আলোকিত করেন, তদ্রƒপ কর্মগুরু তার কর্মকৌশলের উষ্ণ পরশ বুলিয়ে সেই আলোকে কাজে পরিণত করতে সাহায্য করেন। তাই গুরু ও শিষ্য উভয়কেই পদণ্ডপদবির ঊর্ধ্বে নিজেকে মানুষ ভাবতে হবে। পঁচিশ বছর থেকে শুরু হয়ে ষাট বছর পর্যন্ত এ পর্যায় চলতে থাকে, কারণ ষাটের পর মানুষ নতুন করে আর কিছু শিখতে চায় না! এ ক্ষেত্রে কর্মদাতা ও কর্মী বনে যাওয়া যতটা সহজ, কর্মগুরু ও যোগ্য শিষ্য হওয়া ততটাই দুরূহ; এজন্য প্রয়োজন হয় নির্লোভ সম্পর্ক, দক্ষতা, নিষ্ঠা, বিশ্বাস ও দেশপ্রেম। 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close