মো. কায়ছার আলী

  ১৬ মে, ২০২২

পর্যবেক্ষণ

বিশ্ববিদ্যালয় আমার বিশ্ববিদ্যালয়

গ্রিস আধুনিক শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতার জন্মভূমি বা তীর্থভূমি। এথেন্স মাতৃপীঠস্বরূপ। প্লেটোর লাইসিয়াম এবং এরিস্টটলের অ্যাকাডেমি প্রাচীনকালে জ্ঞানের আলোর ফুলকি জ্বালিয়েছে। গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের মৃত্যুর শত বছর পর রোমানরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তবে তারা গ্রিসের প্রাচীন শিক্ষা-সংস্কৃতিকে আদর্শ মনে করত। বাস্তবমুখী এবং জীবনমুখী শিক্ষায় রোমানরা আনন্দ পেত। রোমে শিক্ষাব্যবস্থার মূল কাঠামোতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় তিনটি স্তরে বিভক্ত করেছিল। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল সে সময় জ্ঞানী-গুণীদের মহামিলন কেন্দ্র। গ্রিক, রোমান, প্রাচীন ভারত, মধ্যযুগে ভারত এবং আজকের দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা বিবর্তনের ফল।

ব্রহ্মপুত্র এবং গঙ্গা মানসসরোবর ও গঙ্গোত্রী নামক হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে দেশ দেশান্তরে ছুটে গিয়ে নিজের বুকের জল উজাড় করে দিয়ে মানুষ, পশু, পাখি তথা প্রাকৃতিক পরিবেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে, ঠিক সেভাবে জ্ঞানের পিপাসা মিটিয়ে আলো জ্বালিয়ে মাথা উঁচু করে আপন মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে আমাদের প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ছাত্রজীবন যেকোনো ব্যক্তির জন্য জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। এ সময় কেউ শিশু থেকে পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত হয়। তেমনি ভবিষ্যৎ জীবনের পাথেয় হিসেবে যা কিছু অর্জন করা উচিত, সে সময় করতে হয়। জীবনের বীজ রোপণের শেষ অনুভূতি বড় ট্র্যাজেডি। আমরা সবাই সেই বেদনার অংশীদার হতে চাই।

বরফের ফোঁটার মতো ক্ষয়ে যাচ্ছে জীবন। যতই তুস দিয়ে চেপে রাখা যাক নীরব ক্ষরণ অবিরত চলছেই। জীবনে সুখের সময় ক্ষণস্থায়ী। দুরন্ত শৈশব, উচ্ছল কৈশোর, চঞ্চল বাঁধভাঙা, বাঁধনহারা যৌবন খুব তাড়াতাড়ি কেটে যায়। কর্মময় জীবন শুরু করার আগে মধুরতম রঙিন জীবন হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন। সেখানে সিনিয়র-জুনিয়র সহপাঠী, নবীন-প্রবীণ শিক্ষক সবার সঙ্গেই সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির এক অমিয় অবিচ্ছেদ্য বন্ধন গড়ে ওঠে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের সময়টুকু সাংসারিক চিন্তাশূন্য পরিবেশে ছাত্রছাত্রীরা বেশি আনন্দ পায়। কালের ধারাবাহিকতায় সেই গল্পগাথা অমলিন স্মৃতিগুলো সারাজীবন হৃদয়ে জুড়ে থাকে। প্রিয় ডাইনিং, ফিস্টের দিন, হই চই, হলের ছাদে বসে জ্যোৎস্না উপভোগ, বন্ধু বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা, গান, তর্ক, বিতর্ক, বৃষ্টিস্নাত হওয়া, বর্ষাযাপন, গেস্টরুমে বসে কত কল্পনা, পরিকল্পনা, খেলাধুলা, টিভি রুমে প্রিয় দল বা খেলোয়াড়ের নামে স্লোগান, করতালি, ক্যানটিনের নাশতায় কারো জন্য অপেক্ষা, শিক্ষাসফর, হল ফেস্টের আয়োজনে হুলুস্থুলতা, গল্পময় রাত, র‌্যাগ ডে পালন, কোনো কিছুতে বাজি ধরা, বিভিন্ন উৎসবে একসঙ্গে মেতে ওঠা, চায়ের কাপে টুং টাং শব্দ তথা সৌন্দর্যের প্রতিমায় ভরা ভ্রাতৃত্বপূর্ণ এক সুখের জীবন।

ভালোবাসা বন্ধুত্ব, রক্ত-সংগ্রাম, হাসিকান্না, একাকিত্বে সময় কাটানো, দেবদাস পার্বতীদের ভিড় কিংবা প্রেমিকযুগলের হাতের উষ্ণ ছোঁয়া, অনেকের ঘর বাঁধার স্বপ্ন, যুগের পর যুগ ধরে এমন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার নীরব সাক্ষী হয়ে ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। হঠাৎ কখনো বিদ্রোহে কেঁপে উঠেছে এর বুক, কখনো ভালোবাসায় শীতল হয়েছে, আবার কখনো সবুজ শ্যামল চত্বর লাল তাজা খুনে হয়েছে ক্ষতবিক্ষত। অনেকের প্রেমনিবেদনের সফলতা, ব্যর্থতা, ক্যাম্পাসে হাত ধরাধরি করে হাঁটাহাঁটি, অল্প বৃষ্টিতে ভিজে হলে ফেরা, লাইব্রেরিতে নোট তৈরি করা, কেউ ব্যস্ত থাকে মুক্তবুদ্ধি, চিন্তাচর্চায়, আবার কেউ কেউ আজান শোনা মাত্রই মসজিদে ছুটে যায়। ধরাবাঁধা নিয়ম নেই, স্কুলের মতো স্যার ম্যাডামদের বকুনি শাসন নেই, তাই কেউ পরাধীন নয়।

অনেকে অজপাড়াগাঁ বা রক্ষণশীল পরিবার থেকে সেখানে প্রথমে গিয়ে হতভম্ব হয়ে যায়। কিছুদিন তারাও বড়দের দেখে অনেক কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। আজকাল উচ্চশিক্ষা বিলাসিতা নয়, উন্নতি ও প্রগতির জন্য অত্যাবশ্যকীয়। দক্ষ, যোগ্য এবং আন্তর্জাতিক মানের জনসম্পদ হিসাবে তাদের পরিণত করতে সরকার এবং ইউজিসিকে আরো ভূমিকা পালন করতে হবে। তা না হলে আমরা বিশ্ব থেকে পিছিয়ে পড়ব। ব্যক্তিগতভাবে আমি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশে লেজুড়ভিক্তিক দলীয় ছাত্র রাজনীতি কম পছন্দ করি। ছাত্রদের ন্যায্য দাবি, অধিকার রক্ষায় নিজস্ব ফোরাম তাদের থাকতে পারে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডার ছিনতাই, মাদকদ্রব্য, র‌্যাগিং, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, মেধাহীন নিয়োগ-বাণিজ্য, প্রশ্নফাঁস, অনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকের জীবনে করুণ পরিণতি ডেকে এনেছে। করোনা মহামারি সারা বিশ্বে শিক্ষাব্যবস্থায় সেশনজট বাড়িয়ে দিয়েছে, এখন উত্তরণের পালা শুরু হয়েছে। নিয়মিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি সরকার রাষ্ট্রপ্রধান, নোবেলবিজয়ী অথবা গুণীদের পদচারণে মুখরিত হোক প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close