জাকির আজাদ

  ১৬ মে, ২০২২

দৃষ্টিপাত

পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে করণীয়

দেশে প্রতি বছর প্রায় ১৪ হাজার শিশু-কিশোর পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করে। তাদের গড় বয়স ৫ থেকে ১৫ বছর। প্রতিদিন ১-৪ বছর বয়সি ৩০টিরও বেশি শিশু পনিতে ডুবে মারা যাচ্ছে, পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে শিশুমৃত্যু রোধসহ বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে সফলকাম হয়েছে। কিন্তু পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত হলেও তেমন কোনো অগ্রগতি এখন পর্যন্ত লক্ষ করা যায়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরে‌্যার (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২০’ থেকে পরিলক্ষিত হয়, দেশে ৫ বছরের কম বয়সি ৪৪ শতাংশ শিশুর মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া। এরপরই পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার ৯ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সফলতার দিক থেকে ডায়রিয়ায় মৃত্যুরোধে বাংলাদেশ প্রথম স্থান অধিকার করেছে। গণটিকা দেওয়ার কারণে ডিপথেরিয়া বলতে গেলে একেবারে শূন্যের কোঠায়। তা ছাড়া ধনুষ্টংকার রোগটিও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে পানিতে ডুবে মৃত্যুরোধে উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য পরিলক্ষিত হয়নি। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুরা পরিবারের অন্য সদস্যদের অগোচরে বাড়ির আশপাশের পুকুর বা জলাশয়ে চলে যায় এবং পানিতে ডুবে মৃত্যুর মতো মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটায়।

এ ব্যাপারে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশে (সিআইপিআরবি) পরিচালক ড. আমিনুর রহমান বলেন, ‘দিনের প্রথম ভাগে শিশুদের নিবিড় তত্ত্বাধানে রাখা হলে দেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ রোধ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে গ্রামভিত্তিক শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র সফলভাবে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে কার্যকর।’

তথ্য মতে, গত ২১ মাসে দেশে এক হাজার ৯০১ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ৪০৯ জন, ঢাকা বিভাগে ৪০৮, রাজশাহী বিভাগে ২৩৮, রংপুর বিভাগে ২৩৩, ময়মনসিংহ বিভাগে ২১১, বরিশাল বিভাগে ১৬১, খুলনা বিভাগে ১৩৭ ও সিলেট বিভাগে ১০৪ জন মারা যান। উৎকণ্ঠার বিষয় হলো, পানিতে ডুবে মৃতদের ৮৩ শতাংশই শিশু। আর এসব শিশু বাবা-মায়ের অনুপস্থিতির কারণে বাড়ির পাশের পুকুর বা জলাশয়ে ডুবে মারা গেছে। বর্ষাকাল ও এর আগে অথবা পরবর্তী মাসগুলোতে (জুন-অক্টোবর) পানিতে ডুবে শিশুদের মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ২০২১ সালে সর্বোচ্চসংখ্যক ২১০ জন মারা যায় আগস্ট মাসে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু ছিল জুলাই মাসে ১৫৭ জন। পরিবারের সদস্যদের যথাযথ নজরদারি না থাকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

এ ব্যাপারে গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচআই) সহযোগিতায় সমষ্টির পরিচালক মীর মাসরুর জামান বলেন, ‘পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনাগুলোর জাতীয়ভাবে কার্যকর তথ্যায়ন ব্যবস্থা না থাকায় বেশির ভাগ ঘটনাই গণমাধ্যমে আসে না। ফলে গ্রামের ক্ষেত্রে এ-সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের সরকার এরই মধ্যে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর বিষয়টি একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে এ ক্ষেত্রে অধিকতর গুরুত্বারোপ করেছে। সরকার দাতা সংস্থার যৌথ উদ্যোগে পাইলট ভিত্তিতে কয়েকটি জেলায় কিছু কিছু কাজ হচ্ছে। তা ছাড়া শিশু সুরক্ষার জন্য দেশব্যাপী এসব কার্যক্রম বর্ধিত করনে ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) প্রণয়ন করা হয়েছে।’

এখন সারা দেশের ১০ উপজেলায় ৩ হাজার ২০০টি কেন্দ্রে প্রায় ৮০ হাজার শিশুকে দিবাযত্ন কেন্দ্র বা আঁচলে রাখা হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন নারী শিশুদের দেখভাল করেন। যিনি ‘আঁচল মা’ নামে পরিচিত। আঁচল মায়ের একজন নারী সহযোগী রয়েছে।

শিশুবিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, ‘আঁচল প্রকল্পে যে প্রক্রিয়ায় ডুবে যাওয়া রোধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তার প্রতিটি বিজ্ঞানসম্মত। তা ছাড়া সরকার সম্প্রতি ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৩০৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকার একটি প্রকল্পও তৈরি করেছে। প্রকল্পটি হচ্ছে ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার-সুবিধা প্রদান প্রকল্প।’ সরকারের ৮০ শতাংশ অর্থছাড়াও বাকি অর্থ প্রদান করবেন রুøমবার্গ ফিলানথ্রোপিজ ও রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউট (আর এনএলআই) নামের দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থা।’

পরিবারের সদস্যদের অগোচরে বাড়িসংলগ্ন পুকুর বা জলাশয়ে চলে যায় শিশুরা এবং মৃত্যুর ঘটনার শিকার হয়। তবে শিশুদের যথাযাথ পর্যবেক্ষণে রাখা গেলে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়ানো সম্ভব। কীভাবে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ করা যায়, সে সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘প্রিভেটিং ডাউনিং অ্যান ইমপ্লিমেন্টশন’ গাইডে স্থানীয় পর্যায়ের মানুষকে সম্পৃক্ত করে দিবাযতেœ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কথা বলছে। এ ছাড়া পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে পারিবারিক পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি ও জাতীয়ভাবে কর্মসূচি গ্রহণের ওপর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠান সুপারিশ করেছে। দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে হয়তো একেবারে স্বল্পবয়সি শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের আওতায় আটটি সংস্থার মাধ্যমে ‘শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম’ প্রকল্পের আওতায় শিশু ও মাতৃমৃত্যু রোধ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুুষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়ের পাশাপাশি শিশু ও কিশোরদের সাঁতার প্রশিক্ষণের গুরুত্বের ওপর দেশব্যাপী বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালানো হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শিশুদের পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধে ১০টি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এর তিনটিই বাংলাদেশের সাফল্যের অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া। এগুলো মধ্যে পুকুরের চারিপাড়ে বেষ্টনী তৈরি করা। শিশুদের দিবাযত্ন কেন্দ্র গড়ে তোলা এবং শিশুকে সাঁতার শেখানো। পানি থেকে উদ্ধারের পরপরই শিশুকে কার্যকর প্রাথমিক চিকিৎসা অর্থাৎ শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করতে সাহায্য করা। শিশুকে দ্রুত হাতপাতালে বা চিকিৎসকের কাছে নেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। শিশু বিশেষজ্ঞদরে মতে, পানিতে ডুবে মৃত্যুর কারণ হলো ফুসফুসে পানি প্রবেশ করায় অক্সিজেন স্বল্পতাজনিত এবং ফলে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব। মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটটিতে শিশুরা দ্রুত জ্ঞান হারায়, এজন্য দরকার যত দ্রুত শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস প্রতিস্থাপন করা।

শিশুদের সাঁতার শেখার গুরুত্বের ওপর স্কুলের শিক্ষকরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। সাঁতার একটি খুবই ভালো ব্যায়াম। আর এ কারণে প্রতিটি শিশুর শিশুকাল থেকে সাঁতার কাটার অভ্যাস করা অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সাঁতারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে পারেন। পাঠ্যপুস্তকেও সাঁতার শেখার গুরুত্ব বিষয়ে অধ্যায় সংযুক্ত করা যেতে পারে। সরকারের পাশাপাশি আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সচেতনতাই পারে শুধু পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধ করতে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

পানিতে ডুবে অকালমৃত্যু কারো কাম্য নয়। বর্তমান সরকার পানিতে ডুবে মৃত্যুরোধে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তবে শুধু সরকারি উদ্যোগে পানিতে ডুবে মৃত্যুরোধ সম্ভব নয়। পারিবারিক, সামাজিক ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতা ছাড়া ও ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতাহীন হলে এ মৃত্যু রোধ করা সম্ভব নয়। আর সঙ্গে সবাই মিলে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে, যাতে শিশুরা নিরাপদে বেড়ে উঠতে পারে। প্রয়োজন আমাদের এগিয়ে আসা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close