অলোক আচার্য

  ১৪ মে, ২০২২

পর্যালোচনা

দ্বিমুখী সংকটে শ্রীলঙ্কা

অর্থনৈতিক সংকট থেকে শ্রীলঙ্কার বর্তমান উত্তাল পরিস্থিতির শুরু। জনগণের বিক্ষোভে ঘটেছে নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনাও। সহিংসতায় মারা গেছেন একজন সরকারদলীয় এমপি। সহিংস আন্দোলন ঠেকাতে কারফিউ জারিসহ আরো কঠোর অবস্থানে রয়েছে সেদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অর্থনীতির তীব্র দুরবস্থা, জনরোষ, নেতৃত্বের ব্যর্থতা এবং বর্তমান সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কাকে কোণঠাসা করে দিয়েছে। সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তৈরি হয়েছে।

বহু বছর ধরে রাজনীতিতে থাকা এবং ক্ষমতায় থাকা একটি পরিবারের দাপট জনরোষের মুখে দাঁড়িয়ে। সেখানে দুই দশক ধরে রাজাপাকসে পরিবার ক্ষমতায় রয়েছে। তাদের পিতা আলউইন রাজাপাকসের হাত ধরেই গড়ে উঠে এসএলএলপি (শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি)। ২০০৫ সালে মাহিন্দ রাজাপাকসে প্রসিডেন্ট ও তার ভাই গোতাবায়া প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। এরপর ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় পান এবং ২০২০ সালের পার্লামেন্টারি নির্বাচনেও জয় পান। এই পরিবারের প্রায় সবাই রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন।

জনগণের তীব্র আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজপাকসে পদত্যাগ করেছেন। তার মন্ত্রিসভার প্রায় সব মন্ত্রীই পদত্যাগ করেছেন। এখন কেবল প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রয়েছেন। তারও পদত্যাগ দাবি করছে বিক্ষোভকারীরা। শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হয় এই রাজপাকসে পরিবারকে। ফলে এই পরিবারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ফলে এখন শ্রীলঙ্কাকা নেতৃত্বশূন্য এবং দ্রুতই নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত না হলে রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ হবে না। সেক্ষেত্রে সামরিক অভ্যুত্থানের শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর তাছাড়া এই চরম সংকট মুহূর্তে রয়েছে গুজব ছড়ানোর আশঙ্কা, যা পরিস্থিতিকে আরো খারাপ দিকে ঠেলে দিতে পারে। যদিও প্রতিরক্ষামন্ত্রী কমল গুণারতেœ জানিয়েছেন, এ ধরনের কোনো ফঙ্কা নেই। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, কোনো দেশ ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পড়লে, কেবল তখনই সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো হয়। শ্রীলঙ্কায় এখনো সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আর সেনাবাহিনীর সে ধরনের কোনো চিন্তা নেই বলেও জানান তিনি।

এখন প্রশ্ন হলো, শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির বর্তমান অবস্থা কী? দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এখন অর্থনীতিতে সবচেয়ে বিপর্যস্ত সময় পার করছে সবুজ দেশ, চায়ের দেশ বলে খ্যাত দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। জনরোষের অগ্নিকান্ডে পুড়ছে শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা বন্দরনায়েক কামারাতুঙ্গা বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে সেনাশাসকের হাতছানির বিষয়ে জনগণকে সতর্ক করেছেন। তিনি চলমান পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কায় ঐকমত্যের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। ২ কোটি ২২ লাখ জনসংখার দেশটি সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি পার করছে।

শ্রীলঙ্কার বর্তমান সংকটের পেছনে যে ঋণ একটি বড় কারণ, তা এখন মোটামুটি সবারই জানা। শ্রীলঙ্কার ইতিহাস একটু জানা দরকার। শ্রীলঙ্কার বিট্রিশ উপনিবেশের অংশ ছিল। স্বাধীন হয় ১৯৪৮ সালে। এখন যিনি প্রেসিডেন্ট গোতাবায় রাজাপাকসের পিতা ডিএ রাজাপাকসে ১৯৪৭ সালে হামবানটোটা ডিস্ট্রিক্ট থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৫১ সালে শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি গঠনের মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে পরিবারটি গুরুত্বপূর্ণ হতে শুরু করে। অর্থাৎ রাজাপাকসে পরিবার বহু বছর ধরেই শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে পরিচিত, জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি মুখ। ২০২০ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন গোতাবায় রাজাপাকসে। অথচ এ সময়ে এই পরিবারের বিরুদ্ধেই শ্রীলঙ্কার ডুবন্ত পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হচ্ছে।

মূলত অদূরদর্শী সিদ্ধান্তই দেশটাকে এ পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। গত দুই বছরের করোনা মহামারির কারণে অর্থনীতির গতি স্লথ হওয়া, বর্তমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং শ্রীলঙ্কার সরকারের বিগত কয়েক বছরের কিছু সিদ্ধান্ত বর্তমান পরিস্থিতির মুখে দাঁড় করিয়েছে। দেশটির রিজার্ভ প্রায় শূন্য অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সালের প্রথম থেকে মুদ্রা ঘাটতি এখন আরো তীব্র হয়েছে। খাদ্যপণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় এ বছর বেড়েছে ৩০ শতাংশ।

বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি করার জন্য যে অর্থের দরকার, তা শ্রীলঙ্কার হাতে নেই। ফলে খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসাসামগ্রীর ঘাটতি ব্যাপকভাবে। অবস্থা এমন যে, শ্রীলঙ্কার মানুষকে বিদ্যুতের অভাবে একটি বড় সময় পার করতে হচ্ছে। শ্রীলঙ্কা মূলত চা উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। দেশটিতে নগদ অর্থের চরম সংকট চলছে। সাগরের পাড়ের চমৎকার এই দেশটি এখন মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ভয়াবহ এই অর্থনৈতিক সংকট এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে একাধিক সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা; যা আজকের সময়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। শ্রীলঙ্কার জনগণ এখন মারাত্মক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে পার করছে সময়। তারা এমন সময় পার করছে, যখন প্রতিদিনের পণ্য জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছে। পণ্য সংকটে দাম আকাশছাঁয়া।

এমনিতেই বিশে^ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে খাদ্য সংকটের সম্ভাবনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, তার ওপর শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে আরো খারাপ পরিস্থিতিতে পড়েছে দেশটি। বৈশি^ক অর্থনীতির পরিস্থিতিও সুবিধার নয়। একটি দেশের উন্নয়নের বিপরীতে প্রয়োজন স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। একটি অর্থনৈতিক কাঠামো যেখানে দেশের জনগণের প্রয়োজনীয় খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জোগান থাকে এবং তা তাদের ক্রয়ক্ষমতার ভেতরে থেকে কিনতে সক্ষম হয়। আর অর্থনৈতিক উৎস যেমন- কর, রেমিট্যান্স প্রভৃতি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে। অর্থাৎ একটি কার্যকর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি।

করোনার ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই পৃথিবী রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এর জেরে বিশ্বজুড়েই মূল্যস্ফীতি ব্যাপক আকার ধারণ করে বিভিন্ন দেশে। অর্থনৈতিক অস্থিরতা, বেকারত্ব, খাদ্য সংকট, পণ্যমূল্য বৃদ্ধি প্রভৃতি জীবনযাত্রাকে অস্থির করে তুলেছে বিশ্বজুড়েই। দেশের জনগণ এমন একটি দুঃসময় পার করছে, যেখানে কোনো যুদ্ধ নেই, কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে, প্রতিদিন নিত্যপণ্য সংগ্রহ করতেই যুদ্ধ করতে হচ্ছে। ২০১৯ সালে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসা দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপাকসের সরকারের বিরুদ্ধে এখন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দেশটির ঋণ দ্বিগুণ হয়ে যায়। তারপর করোনায় অর্থনীতি চাপের মধ্যে পড়ে। ২০২০-২১ সালে কলম্বোকে ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয় চীনকে। এতে চাপ পড়ে দেশটির রিজার্ভের ওপর। শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ কমতে কমতের্ এখন পাঁচ কোটি মার্কিন ডলারেরও নিচে নেমে গেছে। অথচ ২০২৬ সালের মধ্যে শ্রীলঙ্কাকে বিদেশি ঋণের আড়াই হাজার কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। যার মধ্যে চলতি বছরই দিতে হবে অন্তত ৭০০ কোটি ডলার।

ইতোমধ্যেই বিদেশি ঋণের কিস্তি প্রদান স্থগিত করেছে। এই অর্থনৈতিক সংকটই শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। জনগণ এখন একটি স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থা চায়, যেখানে তারা অন্তত মৌলিক দাবিগুলো সামর্থ্যরে মধ্যেই পূরণ করতে সক্ষম হয়। রাজাপাকসের পরিবারের ওপর জনগণের অনাস্থা জন্মেছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে শ্রীলঙ্কাকে বের করে আনতে পারে কে? প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে কত দিন পরিস্থিতির সামাল দিতে পারবেন? কারণ জনগণ তারও পদত্যাগ চায়। শ্রীলঙ্কাকে এখন অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক সংকটও সামাল দিতে হবে। প্রকৃত অর্থেই যা একটি কঠিন ও দুরূহ কাজ।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close