মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন

  ১৩ মে, ২০২২

দৃষ্টিপাত

কোরআন-হাদিসের আলোকে বৃষ্টি

সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। ষড়ঋতুর এই দেশে নেয়ামতের ডালি নিয়ে বর্ষা এসেছে। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের অগণিত নেয়ামতে ডুবিয়ে রেখেছেন। আল্লাহর নেয়ামত সম্পর্কে ভাবতে গেলে কৃতজ্ঞতার সেজদায় দেহ-মন নুয়ে আসে। আল্লাহতায়ালার অন্যতম নেয়ামত হলো বর্ষা। আর আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণের সঙ্গে আল্লাহ অনেক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকেন। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের রিজিক উৎপন্ন বা বণ্টিত হয়ে থাকে। মূলত আল্লাহর হুকুম ব্যতীত এই বৃষ্টি বর্ষিত হয় না। ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃজন করেছেন এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে অতঃপর তা দ্বারা তোমাদের জন্য ফলের রিজিক উৎপন্ন করেছেন এবং নৌকাকে তোমাদের আজ্ঞাবহ করেছেন, যাতে তার আদেশে সমুদ্রে চলাফেরা করে এবং নদণ্ডনদীকে তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন’- (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৩২)।

হাদিস শরিফে আছে, নবী করিম (সা.) বৃষ্টিতে একবার বের হয়েছিলেন এবং শরীরে পানি লাগিয়ে ছিলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কেন তিনি এমনটি করেছেন? তখন তিনি বললেন, বৃষ্টিকে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বরকত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বান্দার প্রতি বেশি খুশি হলে তিনটি জিনিস দান করেন। সেগুলো হলো- কন্যাসন্তান, মেহমান এবং বৃষ্টি। বর্ষা মৌসুমে অধিক বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি বেশি হলেই অনেকে নানা কথা বলে থাকেন। কিন্তু বৃষ্টির সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে ৬টি করণীয় প্রমাণিত। প্রিয়নবী (সা.) বৃষ্টিবর্ষণ ও বজ্রপাত সম্পর্কে বলেছেন, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেছেন, ‘আমার বান্দারা যদি আমার বিধান যথাযথভাবে মেনে চলত, তবে আমি তাদের রাতের বেলায় বৃষ্টি দিতাম আর সকালবেলায় সূর্য (আলো) দিতাম আর কখনো তাদের বজ্রপাতের আওয়াজ শোনাতাম না।’ (মুসনাদে আহমদ)। বৃষ্টির সময়ের ৬ করণীয় এবং বৃষ্টির সময় মুমিন মুসলমানের ৬টি করণীয় রয়েছে। বৃষ্টির উপকারী ও ক্ষতিকর বিষয়গুলোও তাতে উঠে এসেছে।

হাদিসের একাধিক বর্ণনায় এ করণীয়গুলো সুস্পষ্ট :

১. বৃষ্টির সময় কল্যাণের দোয়া করা, যখন বৃষ্টি হয় তখন বৃষ্টি থেকে উপকার পেতে দোয়া করা জরুরি। বৃষ্টি শুরু হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) কল্যাণ ও উপকার পেতে তিন শব্দের ছোট্ট একাটি দোয়া বেশি বেশি পড়তেন। ‘আল্লাহুম্মা সাইয়্যেবান নাফিআ’- (বোখারি, নাসাঈ)। অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনি মুষলধারায় যে বৃষ্টি দিচ্ছেন, তা যেন আমাদের জন্য উপকারী হয়। এ দোয়া পড়লে আল্লাহতায়ালা বৃষ্টির ক্ষতিকর দিকগুলো দূর করে দেবেন এবং কল্যাণকর ও উপকারী বৃষ্টি দান করবেন।

২. বৃষ্টিতে অল্প সময় ভেজা : আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারিমের বৃষ্টির অনেক উপকারিতার কথা তুলে ধরেছেন। বৃষ্টি মানুষের জন্য রহমতস্বরূপ। আল্লাহর রহমত ও বরকত পেতে কিছু সময় বৃষ্টি ভেজার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। হাদিসে এসেছে, হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে থাকাকালীন একবার বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) তার পরনের কাপড়ের কিছু অংশ তুলে ধরলেন, যাতে করে তার শরীরে কিছুটা বৃষ্টির পানি পড়ে। এ রকম করার কারণ জানতে চাইলে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এটা (বৃষ্টি) এইমাত্র আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে’- (মুসলিম)।

৩. বৃষ্টি শুরু হলে দোয়া করা : দোয়া কবুল হওয়ার বিশেষ সময়গুলোর মধ্যে বৃষ্টির সময়ও একটি। সুতরাং বৃষ্টি শুরু হলে নিজেদের জানা দোয়াগুলো পেশ করতে আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে রোনাজারি করা বা দোয়া করা জরুরি। প্রিয়নবী রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দুই সময়ের দোয়া কখনো ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। এক. আজানের পরে করা দোয়া। আর দুই. বৃষ্টির সময় করা দোয়া’- (আল-হাকিম)।

৪. বৃষ্টির জন্য দোয়া ও ক্ষতি থেকে আশ্রয় চাওয়া ঝড়-বৃষ্টির ভারী বর্ষণের ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়ে দোয়া করাও সুন্নাত। দীর্ঘ এক হাদিসে এসেছে- হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি জুমার দিন দারুল কাজা (বিচার করার স্থান)-এর দিকের দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করল। এ সময় আল্লাহর রাসুলুল্লাহ (সা.) দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। লোকটি আল্লাহর রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! ধন-সম্পদ নষ্ট হয়ে গেল এবং রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গেল। আপনি আল্লার কাছে দোয়া করুন যেন তিনি আমাদের বৃষ্টি দান করেন। তখন আল্লাহর রাসুলুল্লাহ (সা.) দুই হাত তুলে (তিনবার) দোয়া করলেন- ‘আল্লাহুম্মা সকিনা, আল্লাহুম্মা সকিনা, আল্লাহুম্মা সকিনা।’ অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করুন। হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করুন। হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করুন।’ হজরত আনাস (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মেঘ নেই, মেঘের সামান্য টুকরোও নেই। অথচ সালা পর্বত ও আমাদের মধ্যে কোনো ঘরবাড়িও ছিল না।

তিনি বললেন, হঠাৎ সালার ওই পাশ থেকে ঢালের মতো মেঘ উঠে এলো এবং মধ্য আকাশে এসে ছড়িয়ে পড়ল। অতঃপর প্রচুর বর্ষণ হতে লাগল। আল্লাহর কসম! আমরা ৬ দিন সূর্য দেখতে পাইনি। এরপরের জুমায় সে দরজা দিয়ে এক ব্যক্তি প্রবেশ করল। আল্লাহর রাসুল (সা.) তখন দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। লোকটি তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল- ‘হে আল্লাগর রাসুল! ধন-সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেল এবং রাস্তাঘাট বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কাজেই আপনি বৃষ্টি বন্ধের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। হজরত আনাস (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) তখন দুই হাত তুলে (এভাবে) দোয়া করলেন উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা হাওয়ালাইনা ওয়া লা আলাইনা; আল্লাহুম্মা আলাল আকামি ওয়াল ঝিবালি ওয়াল আঝামি ওয়াজ জিরাবি ওয়াল আওদিয়াতি ওয়া মানাবিতিশ শাঝারি।’ অর্থ ‘হে আল্লাহ! আমাদের আশপাশে, আমাদের ওপর নয়। হে আল্লাহ! টিলা, মালভূমি, উপত্যকায় এবং বনভূমিতে বর্ষণ করুন।’ হজরত আনাস (রা.) বলেন, তখন বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল এবং আমরা বেরিয়ে রোদে চলতে লাগলাম। (রাবী) শরিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমি আনাস (রা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম, এ লোকটি কি আগের সেই লোক? তিনি বললেন, আমি জানি না- (বোখারি)।

৫. বজ্র-বৃষ্টির সময় দোয়া করা : বজ্রপাত মহান আল্লাহতায়ালার মহাশক্তির এক ছোট নিদর্শন। এতেই মানুষ বিচলিত হয়ে পড়ে। যার ওপর বজ্রপাত হয়, তার মৃত্যু অনেকটাই নিশ্চিত। বজ্রবৃষ্টি থেকে বাঁচতে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা ও দোয়া করতে বলেছেন বিশ্বনবী (সা.)। হাদিসে এসেছে- হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) তার বাবা থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন বজ্রের শব্দ শুনতেন বা বিদ্যুৎ চমক দেখতেন, তখন সঙ্গে সঙ্গে বলতেন উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা লা তাকতুলনা বিগাদাবিকা ওয়া লা তুহলিকনা বিআজাবিকা, ওয়া আফিনা কবলা জালিকা’- (তিরমিজি)

অর্থ : ‘হে আমাদের প্রভু! তোমার ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আমাদের মেরে ফেলো না আর তোমার আজাব দিয়ে আমাদের ধ্বংস করো না। বরং এর আগেই আমাদের ক্ষমা ও নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে নাও।’ বজ্রপাত থেকে হেফাজত থাকার তাসবিহ বজ্রের আক্রমণে মৃত্যু থেকে বাঁচতে ছোট্ট একটি তাসবিহ পড়ার কথা এসেছে হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ মুসান্নেফে আবি শায়বায়। তাতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি এ তাসবিহ পড়বে- ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি।’ অর্থ : সে বজ্রপাতের আঘাত থেকে মুক্ত থাকবে- (মুসান্নেফে আবি শায়বায়)।

৬. উপকারী বৃষ্টির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বৃষ্টিপাত বন্ধ হলে আল্লাহর কাছে এ বৃষ্টি সবার জন্য উপকারী হতে কিংবা বৃষ্টি বন্ধ হলে আল্লাহর কাছে এ দোয়া করা সুন্নাত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলতেন, ‘যে ব্যক্তি (বৃষ্টির পর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের) এই দোয়া পাঠ করে, সে আমাকে বিশ্বাস করে আর তারকায় (তারার শক্তিতে) অবিশ্বাস করে। তা হলো উচ্চারণ : ‘মুতিরনা বিফাদলিল্লাহি ওয়া রাহমাতিহি’ অর্থ : ‘আমরা আল্লাহর দয়া ও করুণার বৃষ্টি লাভ করেছি।’ (বোখারি ও মুসলিম) সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, বৃষ্টির সময় ও বৃষ্টি-পরবর্তী সময়ে হাদিসে নির্দেশিত ৬টি সুন্নাত যথাযথভাবে পালন করা জরুরি। পরিশেষে আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে বৃষ্টির সময় ও বৃষ্টি-পরবর্তী সময়ে করণীয়গুলো যথাযথভাবে পালন করার তওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর আমল করার তওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : এম এ কামিল (হাদিস)

ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

drmayed689@gmail. com

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close