আজহার মাহমুদ

  ১২ মে, ২০২২

মুক্তমত

উইঘুর মুসলিম বনাম বর্বর বিশ্ব

উইঘুর জাতির ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছরের পুরোনো। এ জাতি মূলত স্বাধীন-পূর্ব তুর্কিস্তানের অধিবাসী। পূর্ব তুর্কিস্তান প্রাচীন সিল্ক রোডের পাশে মধ্য এশিয়ার একটি দেশ, যার চতুর্পাশ্বে চীন, ভারত, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়া। অঞ্চলের মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস ১৩০০ বছরের বেশি পুরোনো। ১৯৪৯ সালে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে চীনের অভ্যুদয়ের সময় প্রদেশটির জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলমান ছিল; বর্তমানে যা মাত্র ৪৫ শতাংশ। ১৯১১ সালে মাঙ্কু সাম্রাজ্য উৎখাতের মাধ্যমে পূর্ব তুর্কিস্তানে চীনা শাসন চালু হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনচেতা বীর উইঘুররা এই বৈদেশিক শাসনের সামনে মাথা নোয়ায়নি। এ কারণে ১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে তারা দুবার চীনাদের সঙ্গে সাহসিকতার চরম রূপ দেখিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু তবু ভাগ্য তাদের অনুকূলে ছিল না। ১৯৪৯ সালে তারা চীনা কমিউনিস্টদের হাতে পরাজিত হয় আর জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হিসেবে গড়ে ওঠে।

চীনের স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হওয়ার পর থেকেই এই জাতির ওপর শুরু হয়েছে এক অমানবিক নিপীড়ন নির্যাতন। সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হচ্ছে তাদের এই অমানবিকতা নিয়ে পুরো বিশ্ব অনেকটাই নির্ভার। ফ্রিডম ওয়াচের মতে, ধর্মীয় কারণে চীন হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম একটি নিপীড়িত দেশ। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকায় এসব নিপীড়নের কথা বিশ্ববাসী খুব একটা জানতে পারে না।

জাতিসংঘের তথ্য মতে, ১০ লাখের মতো উইঘুর মুসলিমকে পশ্চিমাঞ্চলীয় শিনজিয়াং অঞ্চলে কয়েকটি শিবিরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এসব ক্যাম্পে তাদের নতুন করে শিক্ষ দেওয়া হচ্ছে। চীন সরকার এ বন্দি শিবিরকে ‘চরিত্র সংশোধনাগার’ নাম দিয়েছে। চীন সরকারের দাবি, উচ্ছৃঙ্খল অবস্থা থেকে নিরাপদ ও সুরক্ষা দিতেই তাদের এ কার্যক্রম। চরিত্র সংশোধনাগারের নামে চীন সরকার এই মুসলিমদের প্রতি চরম অত্যাচার ও নির্যাতন করছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জানা যায়, জিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসরত উইঘুর মুসলমানদের ওপর চীন সরকারের বর্বরতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মুসলিমদের বন্দি করা এখনো থামেনি। সংবাদমাধ্যম বিবিসির তথ্য মতে, চীনের শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের জন্য যেসব ‘পুনঃশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে- তাতে নারীরা পরিকল্পিতভবে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। একই সঙ্গে শিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসকারী লোকজনের ওপর চীন সরকারের নিপীড়নমূলক নজরদারির তথ্যপ্রমাণ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

মুসলিম নির্যাতনের এসব তথ্য যাতে চীনের বাইরে যেতে না পারে সেজন্য তারা প্রতিনিয়িত মোবাইল ও ইন্টারনেট সংযোগে বিধিনিষেধ আরোপ করছে। সরকারিভাবে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য জিনজিয়াং প্রদেশে ভ্রমণও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সম্প্রতি জিনজিয়াং প্রদেশের যেকোনো একটি শহরকে ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষা ও বিস্ফোরণের জন্য বাছাই করার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করছে চীন সরকার। শুধু তাণ্ডই নয়, ১৯৬৪ সাল থেকে জিনজিয়াং প্রদেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা না করে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০টি ক্ষতিকর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। চীন সরকারের জুলুম, অত্যাচার থেকে বাঁচার লক্ষ্যে জিনজিয়াংয়ের প্রায় ২৫ লাখ অধিবাসী পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। নানা অজুহাতে উইঘুর মুসলিমদের জেল-জুলুম এমনকি মৃত্যুদন্ড দিচ্ছে চীন সরকার। শুধু তাণ্ডই নয়, চীন সরকার মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধ্বংসে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, যা ধীরে ধীরে তারা বান্তবায়ন করছে। তার কিছু হলো- জিনজিয়াং প্রদেশের কোনো পুরোনো মসজিদ সংস্কার করতে না দেওয়া। নতুন মসজিদ নির্মাণের অনুমোদন বন্ধ। বৌদ্ধমন্দিরের আদলে সংস্কার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই শুধু পুরোনো মসজিদ সংস্কারের অনুমোদন মেলে।

প্রকাশ্যে ধর্মীয় শিক্ষার কোনো সুযোগ নেই জিনজিয়াংয়ে। তাই কঠিন গোপনীয়তার মধ্যেই ধর্মীয় শিক্ষা নিতে হয় উইঘুরদের। পবিত্র হজকে পুরোপুরি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। পোস্টারের মাধ্যমে চীন সরকার এ প্রচারণা চালাচ্ছে যে, নামাজের জন্য মসজিদ নয় বরং নামাজ পড়ার জন্য ঘরে যাও। উইঘুর মুসলিমদের ইসলামি সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধকে ধ্বংস করতে চীন সরকার নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। মুসলমানদের শিক্ষার সুযোগও অত্যন্ত সীমিত করা হয়েছে। সুকৌশলে তাদের অশিক্ষিত রাখা হচ্ছে। এই একটি বিষয়ে মুসলিমবিশ্বের নীরবতা নানা ধরনের প্রশ্ন তৈরি করে দেয় সাধারণ মানুষের মনে। মিয়ানমার সরকার যখন হাজার হাজার সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাকে হত্যা করে এবং সাত লাখ রোহিঙ্গাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে, মুসলিম বিশ্ব চুপ ছিল না। প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল। কিন্তু একই প্রতিবাদের ঝড় উইঘুরের প্রশ্নে কখনো আসেনি। পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশে ইসলামকে দমন করার যে নারকীয় চেষ্টা, সে বিষয়ে সব সময়ই সবাই নীরব থেকেছে।

শুধু মুসলমান হওয়ার অপরাধে ১০ লাখেরও বেশি উইঘুর মুসলিমকে অবৈধভাবে জিনজিয়াংয়ের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ আটকে রাখা হয়েছে। কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে সমাজের মূল ধারায় নেওয়ার প্রক্রিয়ার নামে সেখানে তাদের ওপর চালানো হচ্ছে নির্যাতন। আর এই দমন-নিপীড়নের প্রতিবাদে বিশ্বের ৪৯টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ প্রায় নিশ্চুপ থেকেছে। মালয়েশিয়া গত বছর এক ডজন উইঘুর শরণার্থীকে চীনে ফেরত পাঠাতে অস্বীকার করেছিল, কুয়েত পার্লামেন্টের চার সদস্য জানুয়ারিতে উইঘুরদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছিল এবং তুরস্ক গত মাসে চীনের নির্মম আচরণের নিন্দা জানিয়েছিল। ব্যস, এটুকুই। বাকিরা বিষয়টি নিয়ে কিছুই বলেনি, বলা ভালো এড়িয়ে গেছে। একমাত্র আল-জাজিরা ছাড়া আরব মিডিয়াগুলোতে এমনকি ইরান, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার মতো বড় মুসলিম দেশগুলোতেও এ বিষয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য করতে শোনা যায়নি, যা কখনোই সভ্যতার নিদর্শন হতে পারে না।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close