এরশাদুল হক দুলাল

  ১২ মে, ২০২২

দৃষ্টিপাত

সংঘাত কখনো সংঘাত নিরসন করে না

যেখানে ক্ষুধা, দারিদ্র, অভাব-অনটন, স্বাস্থ্যহীনতা বিদ্যমান, সেখানে কোনোভাবেই বিশ্ব শান্তি সম্ভব নয়। এরপর আবার যুদ্ধ! মনুষ্যত্ববোধ হারিয়ে ফেললে মানুষ যেমন পশু হয়ে যায়, তেমনি নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেললে মনুষ্যত্ব চলে যায়। যে কারণে পৃথিবীর সেরা মেধাবীরাই সেরা অন্যায় করে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত লাভের আশা ও নেশা বিশ্বকে গ্রাস করে ফেলেছে। বিশ্বের অবস্থা আজ তাই। সংঘাত আর হানাহানির মধ্য দিয়েই চলছে সারা বিশ্ব। এতে কারো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে। এতে কারো লাভ হচ্ছে না বরং ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছি আমরা। কী করছি আমরা? একবার কি ভেবে দেখেছি? কেন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ? উত্তরে বলব- শুধু অপশক্তির প্রয়োগ ও আধিপত্য বিস্তার ছাড়া অন্যকিছুই নয়।

যুদ্ধের কারণ সম্পর্কে বলতে চাই। সোভিয়েত ইউনিয়নেই ছিল ইউক্রেন। পূর্ব ইউরোপের আরো কিছু কমিউনিস্ট দেশ এবং সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের মতো ইউক্রেনে দুটি রাজনৈতিক ধারা অব্যাহত রয়েছে। এর একটি অংশ চায় পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যোগ দিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠার জন্য ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য হতে। বাকিরা রুশ প্রভাব বলয়ে থাকার পক্ষপাতি। কারণ ইউক্রেনের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ রুশ ভাষাভাষী। রাশিয়ার সঙ্গে তাদের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সংস্কৃতি ও সামাজিক যোগাযোগ। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের রুশপন্থি প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকেভিচ যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সথেঙ্গ বাণিজ্যিক চুক্তির আলোচনা ভেঙে বেরিয়ে এলেন, তখন তার বিরুদ্ধে শুরু হয় গণবিক্ষোভ এবং দেশ ছেড়ে পালাতে হয় তাকে। তার পতনের পর যারা ক্ষমতায় আসেন তারা এমন কিছু পদক্ষেপ নেন, যা প্রেসিডেন্ট পুতিনকে আবার ক্ষুব্ধ করে। এ সময় ইউক্রেনের ভেতর বিভিন্ন এলাকায় সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হলে তাদের সমর্থন দেয় মস্কো। একপর্যায়ে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নিজেদের অংশ বলে ঘোষণা দেয়।

এদিকে ক্রিমিয়ার সিবাস্তু বাল্টিক সাগর পোলে রুশ নৌঘাঁটি কৌশলগত কারণে রাশিয়ার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাল্টিক সাগরে রাশিয়ার প্রবেশের পথ হচ্ছে এই বন্দর। তাই কোনো কারণেই এই বন্দর হাতছাড়া করতে চায় না রাশিয়া। দ্বিতীয়ত, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইউক্রেন যে ন্যাটোর সদস্য হবে তা কোনো কারণেই মানতে নারাজ রাশিয়া। তাই মস্কো যখনই দেখল ইউক্রেন তাদের প্রভাবের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন প্রেসিডেন্ট পুতিন সেখানে হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেয়। রাশিয়া এখনো নিজেদের বিশ্বের একটি পরাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করে। বিশ্বে তাদের সেই সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি অটুট রাখার ক্ষেত্রে রাশিয়া বদ্ধপরিকর। তাই সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ইউক্রেনকে বাগে আনতে চায় পরাক্রমশালী দেশটি।

এরই মধ্যে ন্যাটো মহাসচিব ইউক্রেনে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে আসছেন। তা ছাড়া রাশিয়া যদি ইউক্রেনে রাসায়নিক হামলা চালায় তাহলে এর প্রভাব পড়বে ন্যাটো অঞ্চলেও। এজন্য ন্যাটো কড়া জবাব দিতে বলেছে এবং পূর্ব ইউরোপে সেনা মোতায়েন জোরদার করছে। শুধু ন্যাটো নয় অস্ত্র দিয়ে ইউক্রেনকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন অন্যান্য জোটের নেতারাও। এতে দিন দিন যুদ্ধের উত্তেজনা আরো বাড়ছে।

ন্যাটো অস্ত্র দিয়ে ইউক্রেনকে আরো ১০ বছর আগে থেকেই সহায়তা করে আসছে। যার অর্থ দাঁড়ায় ন্যাটো সব সময় ইউক্রেনকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। এরই মধ্যে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, ন্যাটো রাশিয়াকে বারবার বিরক্ত করায় ইউক্রেনে হামলা হয়ে থাকতে পারে। আমিও মনে করি এই যুদ্ধ বাধার পেছনে ন্যাটোর কূটকৌশল বিদ্যমান আছে।

ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের কুপ্রভাব এরই মধ্যে সারা বিশ্বে শুরু হয়েছে। এতে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে বিশ্বের অনেক দেশ। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই বিশ্বে উৎপাদন সংকট বাড়বে এবং খাদ্যভাব দেখা দেবে। রাশিয়া থেকে তেল, গ্যাস আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। যাতে অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়ে রাশিয়া। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টো। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর মাত্র দু-মাসের মধ্যে রাশিয়া জ্বালানি বিক্রির মাধ্যমে আয় করেছে প্রায় দ্বিগুণ অর্থ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার পরও কেন রাশিয়া এ অর্থ উপার্জনে সক্ষম হয়েছে। এর কারণ বিক্রির পরিমাণ কমলেও ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে এই আয় অর্জনে সক্ষম হয়েছে রাশিয়া। এ রাজস্ব আয়ের বড় অংশ এসেছে ইউরোপের দেশ থেকে। সেন্টার ফর রিচার্স অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিনিয়ারের একটি বিশ্লেষণ বলেছে, মাত্র দুমাসে ছয় হাজার ২০০ কোটি ইউরো আয় করেছে রাশিয়া।

ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়া থেকে তেল গ্যাস আমদানির বিকল্প পথ খুঁজছে। এশিয়ার বাজার থেকে তেল-গ্যাস আমদানি করতে এরই মধ্যে লবিং শুরু করছে। কিন্তু তেমন কোনো সাড়া মিলছে না তাদের। এতে ইরোপীয় দেশগুলো দিন দিন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুধু সামরিক যুদ্ধ নয়, এটা একটি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য যুদ্ধও বটে। এ যুদ্ধ অবসানের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ফ্রান্স সফরকালে দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে বৈঠককালে অবিলম্বে ইউক্রেনের সংঘাত পরিস্থিতির অবসানের আহ্বান জানান। ফ্রান্স এ প্রস্তাবে একমত পোষণ করেন। যা নিঃসন্দেহে একটি ভালো বিবৃতি ও মহতি উদ্যোগ। যুদ্ধ অবসানে মানবতার দিক বিবেচনা করে বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করতে হবে।

সংঘাত দিয়ে কখনো সংঘাত নিরসন সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন শান্তিপূর্ণ ও গঠনমূলক আলোচনা। ন্যাটো জোট, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইউক্রেনে অস্ত্র ও অর্থ সাহায্যের চেয়ে যদি মানবিক দিক গুরুত্ব দিয়ে শান্তি আলোচনায় এগিয়ে আসত তাহলে, দ্রুত যুদ্ধ সমাপ্তি ও শান্তি ফিরে আসত। এই প্রসঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উদ্বাস্তু হওয়া লোকজনের জন্য খাবার সরবরাহ জরুরি। প্রাণঘাতী অস্ত্র সরবরাহ অযৌক্তিক। এ সংকট নিয়ে চীনের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, ইউক্রেনে চলমান দুঃখজনক ঘটনা অনেকের হৃদয় ভেঙে দিয়েছে। চীন যুদ্ধের বিরোধিতা করে শান্তির সপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এটি চীনের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে গভীরভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে আলোচনার সময় তাদের মতামত পরিষ্কার করেছেন। রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক আইন এবং সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত চর্চাগুলোকে সমর্থন করি। যেগুলো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও জাতিসংঘ সনদের মূল ভিত্তি। স্নায়ুযুদ্ধের মানসিকতা ও জোটকেন্দ্রিক সংঘাত-সংঘর্ষ বিশ্বের জন্য একটি অভিশাপ ছাড়া কিছুই নয়।’

প্রত্যেক প্রাণীরই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে (আল-কোরআন)। যিনি মারছেন তাদেরও মরতে হবে এবং মৃত্যুর যন্ত্রণা গ্রহণ করতে হবে। প্রত্যেকটি জাতি ও সম্প্রদায়ের রয়েছে নিজ নিজ ধর্ম, যা তারা মেনে চলে। কিন্তু মানুষ হত্যার বিষয়ে কোনো ধর্ম সমর্থন করেনি। তা ছাড়া কোনো ধর্মেই অশান্তির কথা নেই। আছে শান্তির কথা। তাহলে কেন মানুষ হয়ে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে? কেন অশান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে! নিউটনের তৃতীয় সূত্র মোতাবেক এর হিসাব দিতে হবে। যার ফলাফল ভোগ করতে হবে আগামী প্রজন্মেও মানুষকে।

সামরিক যুদ্ধ করে শক্তিশালী দেশগুলো সেরা হতে চায়। আমরা দেখেছি ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা নিক্ষেপ করেছিল। সামরিক যুদ্ধের নিয়ম ভঙ্গ করে আমেরিকা বেসমারিক নাগরিকদের ওপর কেন এ বোমা নিক্ষেপ করল? নিয়ম অনুযায়ী সামরিক ঘাঁটিতে এ বোমা নিক্ষেপ করার কথা। শুধু বিশ্ব সেরা হওয়ার জন্যই আমেরিকা এ কাজটি করেছিল। যা ইতিহাসের একটি জঘন্য কালো অধ্যায় হয়ে রয়েছে।

আমরা যেন আমাদের মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে না দিই। পারমাণবিক যুদ্ধ কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশে ক্ষতি করে না বরং সমগ্র পৃথিবীর ক্ষতি করবে। যদি পৃথিবীতে পারমাণবিক যুদ্ধ হয়, তবে আগামী পঞ্চাশ বছরে কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ পঞ্চাশ বছর পর পৃথিবীতে কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা। তাহলে কেন এই যুদ্ধ? যুদ্ধ কোনো সমস্যা সমাধানের পথ নয়। তাই আমাদের প্রশান্তির লক্ষ্যে নতুন অঙ্গীকার, নতুন স্বপ্ন, নতুন অনুপ্রেরণা, নতুন প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এমন একটি বিশ্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যেখানে থাকবে না দুশাসন, অন্যায়, অত্যাচার ও সংঘাত। অর্থাৎ শান্তিময় বিশ্ব গঠনের লক্ষ্যে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, কবে ও কোথা থেকে যাত্রাটা শুরু হবে?

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close