মোতাহার হোসেন

  ১০ মে, ২০২২

বিশ্লেষণ

এডিবির প্রতিবেদনে আশার আলো

করোনা মহামারিতে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত অনেকটা দুর্বল হয়েছে। বিশ্বে ও দেশে দেশে করোনার ধকল সামলাতে তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ে খরচের হিসেবে কাটছাঁট করেছে। চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব কিছুতে রেশনিং করছে। এমনই অবস্থায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা শক্ত অবস্থানে রয়েছে। এ নিয়ে ইতোপূর্বে বিশ্বেব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদেরও অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাদের প্রতিবেদনে করোনার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক বলে মন্তব্য করেছে। একই সঙ্গে জিডিপির প্রবৃদ্ধি আশাতীত বলেছে। সদ্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৬ দশমিক ৯ শতাংশ হারে বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের ‘সঠিক পথেই’ আছে। এটি নিঃসন্দেহে সরকারের জন্য, নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার জন্য আশার খবর। তবে এ প্রতিবেদনকে আমলে নিয়ে সরকারকে সন্তুষ্টি বা আত্মতৃপ্তিতে থাকলে চলবে না আরো সূক্ষ্মভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজিয়ে চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সঠিক এবং যথাসময়ে বাস্তবায়নে মনোযোগী হওয়া দরকার। পাশাপাশি দেশের তৃণমূলের মানুষের চলমান সমস্যা সমাধান, নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ, করোনায় কর্মহীন মানুষের কাজের ব্যবস্থা করাও জরুরি- এমনটাই মত সংশ্লিষ্ট মহলের। পাশাপাাশি রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কাও করছেন তারা। এ অবস্থা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এই দুই দেশ থেকে আমদাানি করা পণ্যের জন্য বিকল্প বাজার খোঁজা এবং সম্ভব হলে ওই সব পণ্যের ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার বিষয় ভাবনায় আনতে বলছেন ।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সরকার ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে। সেই হিসেবে এডিবির প্রাক্কলন কিছুটা কম। অবশ্য বিশ্বব্যাংকের হিসেবে, এবার বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। আর আইএমএফ ৫ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে। বৈশি^ক করোনা মহামারি শুরুর প্রাক্কালে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নেমে গিয়েছিল ৩ দশমিক ৫১ শতাংশে, যা তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হওয়ার হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো।

সদ্য প্রকাশিত এডিবির প্রতিবেদন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুকে বলা হয়, বৈদেশিক বাণিজ্যের পাশাপাশি দেশের ভেতরের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতি সঞ্চার হয়েছে। তারই প্রতিফলন ঘটেছে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির এই পূর্বাভাসে। করোনা মহামারির অভিঘাত সামাল দিতে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়ন এবং রেমিট্যান্স প্রবাহও বৃদ্ধির পদক্ষেপ এক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্সকে উৎসাহিত করতে নতুন বছরের শুরুতেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ করেছে সরকার। মূলত, জনমানুষের সার্বিক জীবনমান উন্নয়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের গুরুত্ব বিবেচনায় প্রণোদনা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। বিশেষ করে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমজীবী মানুষের কষ্টার্জিত বৈদেশিক আয় বৈধ উপায়ে দেশে প্রেরণকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে রেমিট্যান্স পাঠানোর বিপরীতে সরকার ২ শতাংশ নগদ সহায়তা প্রদানের বিদ্যমান হার বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশে নির্ধারণ করেছে। বর্ধিত এ হার চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে। প্রণোদনার এই ধারা চললে ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি পৌঁছাতে পারে ৭ দশমিক ১ শতাংশে।

অবশ্য প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতি বাড়ার পূর্বাভাসও দেওয়া হয়েছে এডিবির প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে মূল্যস্ফীতি ২০২২ সালে পৌঁছতে পারে ৬ শতাংশে। তাছাড়া আমদানি বৃদ্ধি ও রেমিট্যান্স প্রবাহে টান পড়ায় চলতি হিসেবের ঘাটতিও বাড়বে বলে মনে করছে এডিবি। ২০২১ সালে সকারের চলতি হিসেবের ঘাটতি ছিল জিডিপির শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০২২ সালে বেড়ে জিডিপির ২ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার বাড়ার ক্ষেত্রে তেল ও আমদানি খাতে মূল্য বৃদ্ধি এবং রপ্তানি আয় কমাকে মূল ঝুঁকি হিসেবে দেখানো হয়েছে এডিবির প্রতিবেদনে। ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে।

প্রতিবেদন প্রকাশকালে এডিবির আবাসিক প্রতিনিধি এডিমন গিনটিং বলেন, “অভ্যন্তরীণ সম্পদের গতিশীলতা, পণ্য ও সেবা প্রস্তুতে বেসরকারি খাতে প্রণোদনা, পরিবেশবান্ধব আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন উৎসাহিত করা এবং শিক্ষা ও উদ্ভাবন জোরদার করার মাধ্যমে চলমান আর্থ-সামাজিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা দরকার।” তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষম অবকাঠামো ও সেবা খাত গড়ে তোলা, জীবাশ্ম জ্বালানিতে কার্বন ট্যাক্স আরোপ ও পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগকে উৎসাহ দেওয়া হলে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যবস্থাপনার সমন্বিত ও টেকসই পরিবেশবান্ধব প্রবৃদ্ধি বর্তমান নীতি উদ্যোগকে আরো এগিয়ে নেবে।

এডিবির ২০২২ সালের আউটলুকে বলা হয়, যেহেতু বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ এবং শিল্প খাতের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি বেড়েছে, সেহেতু এ বছর বেসরকারি বিনিয়োগ আরো শক্তিশালী হবে। পাশাপাশি বড়ো আকারের তহবিল পাইপলাইনে থাকায় অগ্রাধিকারভিত্তিক বড়ো অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে পড়ায় ব্যক্তি পর্যায়ের ব্যয় কমতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এডিবি বলছে, দেশের বাজারে জ্বালানির দাম বাড়ানো, বিশ্বজুড়ে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং প্রণোদনামূলক ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়ন করায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে, তাতে চলতি অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৬ শতাংশ হতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমন্বিত ও পরিবেশবান্ধব টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়নের অংশ হিসেবে, প্রতিটি খাত ও উন্নয়ন ইউনিটের জন্য একটি জলবায়ুজনিত ঝুঁকি-জ্ঞানসম্পন্ন মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা উচিত। মহামারির আর্থসামাজিক প্রভাব ব্যবস্থাপনায় এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে এডিবি এরই মধ্যে বাংলাদেশকে ঋণ আকারে ২২০ কোটি ডলার এবং সহায়তা হিসেবে ৭২৩ কোটি ডলার দিয়েছে। এছাড়া ২০২২-২৪ মেয়াদে বাংলাদেশের জন্য ৮০০ কোটি ডলারের তহবিল জোগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এডিবি, যা প্রয়োজনে ৫৪০ কোটি ডলার বাড়ানো হতে পারে। বর্তমানে দেশের ৪৬টি প্রকল্পে এডিবির এক হাজার ৫০ কোটি ডলারের তহবিল রয়েছে। প্রত্যাশা থাকবে জনপ্রত্যাশা পূরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণ, অর্থনীতি ও জীবনের চাকাকে সমান্তরালভাবে সচল ও গতিশীল রাখতে যেভাবে কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে সফলতা অর্জন করেছে ঠিক সেভাবে করোনা পরবর্তী দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জীবনমানের উন্নয়নে কাজ করা প্রয়োজন। আশা করা যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ ও প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে এই যাত্রাও বাংলাদেশ সফল হবে। পিআইডি ফিচার।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close