মো. মারুফ মজুমদার

  ০৯ মে, ২০২২

দৃষ্টিপাত

ভোজ্য তেলের লঙ্কাকাণ্ড : প্রসঙ্গ বাংলাদেশ

অতিসম্প্রতি হঠাৎ টেলিভিশনের পর্দায় কয়েকটি নিউজ দেখে ভেবাচেকা খাওয়ার মতো অবস্থা! প্রথমটি হলো, অতিপ্রয়োজনীয় ভোজ্য তেল তথা সয়াবিন তেলজাত বোতলগুলোর সঙ্গে সরিষা তেল বা ঈদসামগ্রী দিচ্ছে। প্রথমে দেখে বিমোহিত হওয়ার দশা! কিন্তু না, মূল কারণ হলো সয়াবিন তেল কোম্পানিগুলো পর্যাপ্ত তেল সরবরাহ না করায় ব্যবসায়ীদের এক প্রকার বাধ্য করে সয়াবিন তেলের সঙ্গে সরিষা তেল দিচ্ছে ফ্রি। দ্বিতীয়টি হলো, বর্তমানে তেলের নতুন দর অনুযায়ী, খোলা সয়াবিন তেল ১৮০ টাকা প্রতি লিটার, যা আগে ১৪০ টাকা ছিল। এ ছাড়া বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬০ থেকে বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা করা হয়েছে। এখন, ৫ লিটারের বোতলের দাম হবে ৯৮৫ টাকা।

এতে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় মুদিসদাই ক্রয় করতে আসা জনগণ সৃষ্ট তেল সংকটের করাল পিষ্টে পড়েছে। কথা হচ্ছে, পর্যাপ্ত তেল মজুদ থাকা সত্ত্বেও বাজারে সরবরাহ কেন করা হচ্ছে না? এটা কি মানবসৃষ্ট তেল সংকটের আগাম বার্তা দিচ্ছে- যেখানে দামের ঊর্ধ্বগতির প্রভাবের বেগে জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে? এই তেল নিয়ে তেলেসমাতি কাণ্ড বন্ধ হবে কবে? সঠিক সুরাহার না হওয়ার মারপ্যাঁচে জনজীবন তথা সমগ্র দেশে নতুন এক সংকট সৃষ্টি কাম্য কতটুকু?

কোভিডের ভয়াবহ ধাক্কার রেশ গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক বাজার ব্যবস্থাকে নতুন এক সমীকরণে দাঁড় করিয়েছে। যার প্রভাব বাংলাদেশে কোনো অংশে কম নয়। সবিশেষ কোভিড সংক্রমিত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কোভিড পরবর্তীকালীন বেকারত্ব, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য যে লাগামহীম বৃদ্ধি পেয়েছে তা বলা বাহুল্য। এহেন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির আগুনে ঘি ঢালার মতো অবস্থা তৈরি করল ইউক্রেন-রাশিয়ার সংকটময় পরিস্থিতি, যা কি না জ্বালানি বাণিজ্যে ঘোরতর প্রভাব ফেলে।

বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারের সবচেয়ে আলোচিত পণ্যের অন্যতম হলো ভোজ্য তেল। বৈশ্বিক বিভিন্ন সমস্যার মেরূকরণে সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে যাওয়া নামক অজুহাতে বাংলাদেশেও এর সমতুল্য হারে দাম বেড়ে যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বৈশ্বিক সংকটকালীন ভোজ্য তেলের দাম বাড়লেও, সংকট স্থিতিশীল অবস্থায় দাম অনুকূলে চলে আসে। কিন্তু বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম। যেই দাম বেড়েছে সংকট স্থিতিশীল হোক বা অস্থিতিশীল হোক দাম কমানোর জো নেই। বোঝা মুশকিল- ব্যবসায়ী মহলের মূল উদ্দেশ্য কী? ধরা যাক ধানের উৎপাদন ভালো হয়েছে, মজুদও যথেষ্ট। ফলে ঘাটতি থাকার কথা নয়। তাহলে সাধারণ মানুষ চাল কিনতে হিমশিম খাচ্ছে কেন? প্রতি-উত্তরে বলা যাবে, হয় উৎপাদন ও মজুদ নিয়ে সঠিক তথ্যের অভাব, না হয় বাজার সিন্ডিকেটের মারপ্যাঁচ! তথাপি, সৃষ্ট সমস্যার আশু সমাধানের ভ্রƒক্ষেপ করা কতটুকু যৌক্তিক?

বর্তমান বাজারে প্রয়োজনীয় ভোজ্য তেল তথা সয়াবিন তেলের দাম ২০০+ টাকা লিটার প্রতি। কথা হচ্ছে, মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশের ধর্মীয় উৎসবগুলো যাতে সবাই পালন করতে পারে সে ক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য জনগণের অনুকূলে না রেখে বরং একেক সময় একেক পণ্যের আকাশ সমান দাম বাড়িয়ে ব্যবসায়ী কর্তৃক জনগণের রক্ত চোষার পাঁয়তারায় লিপ্ত হয়েছে। বাজারে জনগণের চাহিদামাফিক তেল নেই বললেই চলে।

সরকারি তরফ থেকে বাজারে তেলের মজুদ বন্ধে খোলা তেল বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এর পরও প্রয়োজনীয় ভোজ্য তেল তথা সয়াবিন তেলের দাম কিছুতেই কমছে না। এদিকে ৬০ শতাংশ সয়াবিন তেল খোলা অবস্থায় বিক্রি হয়, যার ক্ষতিকর প্রভাবের ভুক্তভোগী নিম্ন, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষজন। বাড়তি দামের দরুন বোতলজাত ভোজ্য তেল কিনতে অপারগ। যার দায় নির্দিষ্টভাবে তেল কোম্পানিগুলোকে দিলে ভুল হবে না, কেননা তাদের পর্যাপ্ত সরবরাহ না দেওয়ার কারণে বিক্রেতার বিক্রিতে সংকট তৈরি হয়েছে, ফলে তারা চড়া দামে বিক্রি করতে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছে না। এ ব্যাপারে সরকারের উচিত যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া। নয়তো টিসিবির পেছনে মানুষের লাইন ক্রমেই দীর্ঘতর হতে বেশিদিন লাগবে না।

দীর্ঘদিন থেকে ভোজ্য তেল নিয়ে তেলেসমাতি কারবার চলছে। সব খেলার শেষ থাকে কিন্তু তেল নিয়ে ছিনিমিনি খেলা যেন এপিসোডভিত্তিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় তৎপর। এমনিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তার ওপর ভোজ্য তেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সাধারণ জনগণের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরা’র মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে তীব্র ভোগান্তি, দুর্বিষহ যাপিত জীবন পার করতে হচ্ছে নিত্যনৈমিত্তিক।

এই তেলেসমাতি লঙ্কাকাণ্ডের পেছনের দৃশ্যগুলো খুবই ভয়াবহ। যেমন- অধিকসংখ্যক অবৈধ মজুদদার বৃদ্ধি। এ ক্ষেত্রে সরকারের ওপরমহল থেকে মনিটরিং বাড়ানো এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রয়োজন হলে গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বলবৎ রাখা যেতে পারে। পাশাপাশি, তেলের লাগামহীন দাম বৃদ্ধির পেছনে সূক্ষ্মতম কারণ চিহ্নিত করে এর আশু সমাধানে সরকারকে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। এরপর, বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কীভাবে হ্রাস করা যায়, তা নিয়ে ভাবা। মনে রাখতে হবে, সৃষ্ট সংকটের উত্তরণকল্পে জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি। কারণ বাজারের কোথায় অনিয়ম, দুর্নীতি চলছে তার শতভাগ ভুক্তভোগী বা ওয়াকিবহাল বলা চলে জনগণকে। যদি না সরকারকে অবহিত করা হয়, তথাপি সরকারের একার পক্ষে সমাধান করা কখনোই সম্ভব নয়।

বলাই যায়, বর্তমান সয়াবিন তেলের বাজারের আধিপত্য হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানির হাতে। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে কঠিনতর না। এর পরও সরকার ব্যর্থ কেন? ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বছরে ভোজ্য তেলের চাহিদা ২০ লাখ টন। এতে, এক মাসে চাহিদা ১ লাখ ৫০ হাজার টনের মতো। মিল মালিকরা বলছেন, তারা চাহিদানুযায়ী সরবরাহ করছেন। পক্ষান্তরে, পাইকারি ব্যবসায়ী ও ডিলারের ভাষ্য বলছে ভিন্ন কথা। তাহলে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে বা কারা? তা ক্ষতিয়ে দেখার দরকার। সর্বোপরি, তেল নিয়ে তেলেসমাতি কাণ্ড বন্ধ হোক। হুটহাট কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজারকে অস্থিতিশীল করার পেছনে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচন করা এখন সময়ের দাবি। নাটের গুরুরা বরাবরের মতো যাতে পর্দার আড়ালে থেকে না যায় সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। তা না হলে, শ্রীলঙ্কা, গ্রিসের মতো অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হতে আর বেশিদিন লাগবে না।

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close