রাকিব আল হাসান

  ২৮ জানুয়ারি, ২০২২

ফিরে দেখা

উম্মতে মুহম্মদের (সা.) বাতিঘর আবু হানিফা (রা.)

ইমামে আজম আবু হানিফা (র.) এর প্রকৃত নাম হচ্ছে নুমান বিন সাবিত। তার উপনাম আবু হানিফা। এই নামেই তিনি অধিক পরিচিতি লাভ করেছেন এবং তার উপাধি হচ্ছে ইমাম আজম। ইমামে আজম আবু হানিফা (র.) ৮০ হিজরিতে উমাইয়া খলিফা মালিক বিন মারওয়ানের শাসনামলে কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। এবং এখানেই তিনি লালিত পালিত হন। তার বংশ দ্বারা নিম্নরূপ- নুমান বিন সাবিত বিন জুতি কাবুল বিন মারজুবান। নির্ভরযোগ্য মতানুযায়ী তিনি কাবুলের পারসিক বংশোদ্ভূত ছিলেন।

যুগ শ্রেষ্ঠ এই মহান মনীষী ছোট বয়সেই কোরআনুল কারিমের হিফজ সমাপ্ত করে ছিলেন। অতঃপর পিতার ইন্তেকালের পর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ব্যবসার কাজকেই নিজের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে স্থির করেন। এমনকি ব্যবসার কাজে তার সততা ও নিষ্ঠার কারণে দিগি¦দিক তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন তার দোকানে এসে ভিড় জমাত। সর্বপ্রথম ইমাম শাবি (র.) তাকে ইলম চর্চা ও জ্ঞান আহরণের প্রতি উৎসাহিত করেন। ঘটনাক্রমে প্রথম সাক্ষাতেই ইমাম শাবি (র.) তার মাঝে সুপ্ত প্রতিভার স্ফুরণ দেখতে পেয়েছিলেন। অতঃপর তিনি তাকে জ্ঞানার্জনের প্রতি আগ্রহী করে তোলেন। পরবর্তী সময়ে আবু হানিফা (র.) নিজেই বলেছিলেন, ‘তার উপদেশ বাণীই আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। এবং তারপর থেকেই আমি ব্যবসার পাশাপাশি ইলমের চর্চা শুরু করি।’

ইলম চর্চার ক্ষেত্রে তিনি প্রথমে কুফা শহরেই ইলমে আদব ও ইলমে কালাম তথা আরবি সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করেন। অতি অল্প সময়েই এ শাস্ত্রে তিনি অত্যন্ত যোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হন। বিভিন্ন জায়গায় বিতর্কের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের ভ্রান্ত আক্বিদা খণ্ডন করে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন। খোদ বসরা শহরেই তিনি বাহাসের জন্য সাতাশ বারের অধিক গমন করেছেন। এমনকি কুফার একটি মসজিদে দর্শনের শিক্ষার্থীরা এই শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জনের জন্য তার কাছে জড়ো হতো- যখন তার বয়স মাত্র বিশে গিয়ে ঠেকেছে।

ইমামে আজম আবু হানিফা (র.) যখন ইলমুল কালাম ও ইলমুল আদবে পা-িত্য ও পূর্ণাঙ্গতা অর্জন করেন, তখন তিনি ইলমুল ফিকাহ তথা ইসলামিক আইন-অনুষদের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ বিষয়ে জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে তিনি প্রখ্যাত তাবেয়ি হাম্মাদ বিন আবু সুলায়মান আল কুফির সাহচর্যে চলে আসেন। তিনি হাদিসের একজন নির্রভরযোগ্য রাবিও ছিলেন। আবু হানিফা (র.) দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার সোহবতে থেকে জ্ঞান লাভ করতে থাকেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি পনেরো বছর পর্যন্ত তার কাছে আসা-যাওয়া করেছি।’ প্রিয় শায়েখের সোহবতে এতটাই নৈকট্য অর্জন করে ছিলেন যে, শায়েখ হাম্মাদ (র.) বলেছিলেন- ‘মজলিসের সামনের দিকে আমার জুতার কাছে আবু হানিফা ব্যতীত কেউ বসবে না।’ ইমামে আজম (র.) তার থেকে এক হাজার বিধানবিষয়ক হাদিসও বর্ণনা করেছেন। এভাবে ১১০ হিজরি পর্যন্ত শায়েখ হাম্মাদ বিন আবু সুলায়মানের (র.) ইন্তেকালের আগ অবধি তার সোহবতেই থাকেন।

ইমাম আবু হানিফা (র.) প্রথমে মক্কায় প্রখ্যাত তাবেয়ি আতা ইবনে আবি রাবাহর থেকে হাদিস শিক্ষা করেন। স্বীয় শায়েখের গুণমুগ্ধ এই মহান শিষ্য আপন ওস্তাদের গুণের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘আমি ইমাম আ’তা (র.) এর চেয়ে উত্তম কাউকে দেখিনি।’ এবং আরো অনেক শায়েখ থেকে তিনি হাদিসের জ্ঞান লাভ করেন। ইতিহাসবিদরা বলেন, তার ওস্তাদদের সংখ্যা চার হাজার পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। যার মধ্যে আল্লাহর রাসুলের (সা.) সোহবতধন্য সাতজন সাহাবায়ে কেরাম (রা.) রয়েছেন। ৯৩ জন তাবেয়ি রয়েছেন (র.)।

আবু হানিফা (র.) শুধু একজন ফকিহই ছিলেন না বরং একজন অন্যতম তাবেয়ি ছিলেন। (তাবেয়ি বলা হয়, যারা ঈমানদার অবস্থায় সাহাবায়ে কেরামের সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়েছেন।) তিনি তার জীবদ্দশায় সাতজন সাহাবির সাক্ষাৎ লাভ করে ধন্য হয়েছিলেন। আর তারা হলেন- ১. আনাস ইবনে মালিক (রা.), ২. আবদুল্লাহ ইবনে আবি আওফা (রা.), ৩. সহল ইবনে সা’আদ (রা.), ৪. আবু তোফায়েল (রা.), ৫. আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়দি (রা.), ৬. জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.), ৭. ওয়াসেলা ইবনুল আসকা (রা.)।

স্বীয় ওস্তাদ হাম্মাদ বিন আবু সুলায়মানের ইন্তেকালের পর আপন ওস্তাদের মসনদে বসেই শিক্ষা দানের দায়িত্ব হাতে নিতে হয়। অতঃপর সুদীর্ঘ সময় শিক্ষাদানের এ ময়দানে নিয়োজিত থেকে হাতে গড়া অত্যন্ত বিচক্ষণ ও ধীশক্তিসম্পন্ন গভীর ইলমের অধিকারী নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের চল্লিশ জনের দ্বারা একটি ‘সম্পাদনা পরিষদ’ গঠন করেন। এবং তাদের মধ্যে বিশিষ্ট দশজনের মাধ্যমে ‘পর্যালোচনা পরিষদ’ গঠন করেন। এবং যুগ শ্রেষ্ঠ এই আইনজ্ঞ কোরআন ও হাদিসের আলোকে ফিকাহ সংকলনের একটি বিধিবদ্ধ ধারার সূচনা করেন। অতঃপর তার নিবিড় তত্ত্বাবধান, প্রত্যক্ষ মতামত দান ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিরলস শ্রম দানের মাধ্যমে দীর্ঘ বাইশ বছরে প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ সংকলন সমাপ্ত হয়। প্রাথমিকভাবে এতে ৮৩ হাজার মাসয়ালা স্থান পায় ও শেষ পর্যন্ত তাতে ৫ লাখ মাসয়ালা সংকলিত হয়। আর তার ইন্তেকালের পর রেখে যাওয়া হাতে গড়া বিশিষ্ট ছাত্রদের হাত ধরে যুগে যুগে তা সমৃদ্ধ হতে থাকে। এ অবধি পৃথিবীর বহুদেশে হানাফি মজহাব গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। অধুনিক সময়কালে হানাফি মতবাদের অনুসারী রয়েছে এমন দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সুদান, মিসর, জর্দান, সিরিয়া, ইরাক, তুরস্ক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, উজবেকিস্তান , আলবেনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান।

একসময় আব্বাসীয় খলিফা আবু মানসুর তাকে প্রধান বিচারকের দায়িত্ব গ্রহণের আবেদন জানান। কিন্তু তিনি সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করে বলেন, আমি এ পদের উপযুক্ত নই। ‘বস্তুত তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এর মধ্যে খলিফার অসৎ উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে।’ তার এই উত্তর শুনে খলিফা তাকে মিথ্যাবাদী আখ্যা দেন। তখন তিনি এর ব্যাখ্যায় বলেন, যদি আমি মিথ্যাবাদী হয়ে থাকি তাহলে এক্ষেত্রে আমার মতামত সঠিক। কেননা আপনি কিভাবে একজন মিথ্যুককে প্রধান বিচারকের দায়িত্বে নিযুক্ত করবেন? অতঃপর খলিফা এতে ক্রুদ্ধ হয়ে একান্তই জেদের বশে নির্দোষ, অসহায় এই মহান ইমামকে কারাগারে বন্দি করেন। তিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে জালিমের হাতে নির্যাতন সহ্য করতে থাকেন। অতঃপর সর্বশেষ খাবারের সঙ্গে বিষ প্রয়োগ করে ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ জুন ১৫০ হিজরিতে তাকে কারাগারেই হত্যা করা হয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close