নিগার নিশাত
পর্যবেক্ষণ
রাজধানীতে ভাড়াটিয়ার সুখ-দুঃখ
ঢাকা শহরের অন্ধকারে ঢাকা পড়ে আছে শতকোটি মানুষের দীর্ঘশ্বাস। মানুষের নানান প্রয়োজনে রাজধানীর জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। ঢাকা যেন ভাগ্য বদলানোর তীর্থস্থান! তাই ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি হলো উচ্চভাড়া। আর এই উচ্চ ভাড়ায় পিষ্ট ঢাকাবাসী। তার পরও প্রতিটি নতুন বছরের শুরুতে ভাড়া বাড়ানোর আতঙ্ক মানুষকে অর্থনৈতিক নির্যাতনের মুখে ফেলেছে। ঢাকায় এখন এমন অনেক বাড়িওয়ালা আছেন যারা কর্মজীবনে অন্যকিছু করেন না। শুধু ফ্ল্যাটের ভাড়া তুলে সংসার চালান। ফলে ফি বছর ভাড়া বাড়ানোর চেষ্টা চালান। তাদের এ চেষ্টা বহু মানুষের কষ্টের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময় নিত্যপণ্যের যে দাম বেড়েছে, সেই তুলনায় বাড়িভাড়া বাড়ার হার প্রায় দ্বিগুণ। অন্য এক পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন বাড়িভাড়া পরিশোধে। পরিসংখ্যানে বলছে, রাজধানী ঢাকায় বর্তমানে আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ বসবাস করেন। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা অবস্থান ১১তম। কিন্তু আয়তন ও জনসংখ্যার হিসেবে ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ। প্রতি বছর রাজধানীতে ৬ লাখ ১২ হাজার নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছে। এক দিনের হিসাবে এক হাজার ৭০০ জন। ১৪৬৩.৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট এ শহরে ঘুমাতে হয় প্রায় ২ কোটি মানুষকে। গত বছর জাতিসংঘ এক প্রতিবেদনে জানায়, বিশে^র সবচেয়ে জনবহুল শহরের তালিকায় সপ্তম স্থানটি দখল করেছে আমাদের ঢাকা। আর ২০১৭ সালে জাতিসংঘের বসতি-সংক্রান্ত উপাত্তের বিচারে বিশে^র সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর এটি। সমীক্ষা বলছে, ঢাকা শহরের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকেন। ফলে ঢাকা যেন এখন আধুনিক যাযাবরের শহরে পরিণত হয়েছে।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, অনেক ক্ষেত্রে সঠিক নিয়মের অভাবে বাড়িওয়ালা কর্তৃক ভাড়াটিয়া নিগৃহীত হয়। আবার কোনো ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়ার দ্বারা বাড়িওয়ালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু নিজের স্বার্থই সামনে রাখে, অন্যের ক্ষতি হলো কি না বা তার প্রতি জোর-জবরদস্তি হলো কি না তা ভেবেও দেখে না। ১৯৯১-এর বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন বলছে- ‘নিয়ন্ত্রক বাড়িভাড়া আইন কার্যকর করবেন’ তাই দেশের লাখ লাখ ভাড়াটের বিপদের বন্ধু হলো নিয়ন্ত্রক। এই নিয়ন্ত্রক হলেন সহকারী জজ। ভাড়াবাড়ি শাসন ঠিক বিচারবিভাগীয় কার্যক্রমের অংশ নয়। এ ধরনের অনিয়ম ও হয়রানি প্রতিরোধে বাংলাদেশে প্রচলিত রয়েছে ১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন। ভাড়াটে হিসেবে আপনার অধিকার এই আইনে লেখা আছে। এই অধিকার কোনো বাড়িওয়ালা লঙ্ঘন করলে তাকে পেতে হবে শাস্তি। আইন অনুযায়ী বাড়িভাড়া-সংক্রান্ত সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য ভাড়ানিয়ন্ত্রক রয়েছেন। সাধারণত জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ আদালতগুলো এ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এ আইনের কিছুটা হলেও যদি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো তাহলে ভাড়াটিয়াদের জিম্মি অবস্থা অনেকটা লাঘব হতো।
আইনে বাড়ির ভাড়া মানসম্মতভাবে নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। মানসম্মত ভাড়া সম্পর্কে এই আইনের ১৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, ভাড়ার বার্ষিক পরিমাণ সংশ্লিষ্ট বাড়ির বাজার মূল্যের শতকরা ১৫ ভাগের বেশি হবে না। বাড়ির বাজার মূল্য নির্ধারণ করার পদ্ধতিও বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ১৯৬৪-তে স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে। এ ভাড়া বাড়ির মালিক ও ভাড়াটের মধ্যে আপসে নির্ধারিত হতে পারে। আবার ভাড়ানিয়ন্ত্রকও নির্ধারণ করতে পারেন। এটাকে সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য করতে ঢাকা সিটি করপোরেশন ঢাকা মহানগরীকে দশটি রাজস্ব অঞ্চলে ভাগ করে ক্যাটাগরিভিত্তিক সম্ভাব্য বাড়িভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে। দুই বছরের আগে বাড়ির ভাড়া বাড়ানো যাবে না। কোনো বিরোধ দেখা দিলে বাড়ির মালিক বা ভাড়াটের দরখাস্তের ভিত্তিতে দুই বছর পরপর নিয়ন্ত্রক মানসম্মত ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করতে পারবেন। বাড়িওয়ালা যদি মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া ভাড়াটের কাছ থেকে আদায় করেন, তাহলে প্রথমবার অপরাধের জন্য মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং পরবর্তী প্রতিবার অপরাধের জন্য ওই অতিরিক্ত টাকার তিন গুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই আইনের ১৮ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন বা ১৮৭২ সালের চুক্তি আইনের বিধানে যাই থাকুক না কেন, ভাড়াটিয়া যদি নিয়মিতভাবে ভাড়া পরিশোধ করতে থাকেন এবং বাড়িভাড়ার শর্তসমূহ মেনে চলেন তাহলে যত দিন ভাড়াটিয়া এভাবে করতে থাকবেন তত দিন পর্যন্ত ওই ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না। এমনকি ১৮(২) ধারা মতে, বাড়ির মালিক পরিবর্তিত হলেও ভাড়াটিয়া যদি আইনসম্মত ভাড়া প্রদানে রাজি থাকেন, তবে তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না।
১৯৯১-এর ১০ ও ২৩ ধারা মোতাবেক বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকের লিখিত আদেশ ছাড়া অন্য কোনোভাবেই বাড়ির মালিক তার ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে অগ্রিম বাবদ এক মাসের বাড়িভাড়ার অধিক কোনো ধরনের ভাড়া, জামানত, প্রিমিয়াম বা সেলামি গ্রহণ করতে পারবেন না। তাহলে দণ্ডবিধি ২৩ ধারা মোতাবেক তিনি দণ্ডিত হবেন। এই আইনে বাড়ির মালিককে ভাড়ার রসিদ প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এ রসিদ সম্পন্ন করার দায়দায়িত্ব বাড়িওয়ালার। রসিদ প্রদানে ব্যর্থ হলে ভাড়াটের অভিযোগের ভিত্তিতে বাড়িওয়ালা আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। বাড়িভাড়ার চুক্তি ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে করা যেতে পারে এবং প্রয়োজনে নিবন্ধন করে নেওয়া যেতে পারে। এর ফলে অনাকাক্সিক্ষত ঝামেলা এড়ানো সম্ভব।
বাড়িভাড়া আইন অনুযায়ী বাড়ির মালিক তার বাড়িটি বসবাসের উপযোগী করে রাখতে আইনত বাধ্য। বাড়ির মালিক ইচ্ছা করলেই ভাড়াটিয়াকে বসবাসের অনুপযোগী বা অযোগ্য অবস্থায় রাখতে পারেন না। আইন থাকলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন অভাবেই বাড়ছে বাড়িভাড়ার বাড়াবাড়ি। পরিশেষে এটাই প্রত্যাশা বাড়িওয়ালা, ভাড়াটিয়া সম্পর্ক অটুট থাকুক। পরিমিত মাত্রায় নিয়ম মেনে নির্ধারিত হোক বাড়িভাড়া।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
"