অলোক আচার্য

  ২৭ জানুয়ারি, ২০২২

বিশ্লেষণ

প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য এবং...

দীর্ঘদিন পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের চাওয়া পূরণ হয়েছে। প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার পদমর্যাদা দিয়ে হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট। এর আগে ২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল দশম গ্রেড করাসহ গেজেটেড পদমর্যাদা দেওয়ার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণবিহীন উভয় ক্ষেত্রেই প্রবেশ পদে বেতন স্কেল দশম গ্রেড করাসহ গেজেটেড পদমর্যাদা ২০১৪ সালের ৯ মার্চ থেকে কার্যকর করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নিঃসন্দেহে এ এক সুসংবাদ। শিক্ষা খাতে বেতন কাঠামোতে সবচেয়ে পিছিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার। যদিও শিক্ষাগত যোগ্যতায়, দক্ষতায় এবং অভিজ্ঞতায় তারা পেছনে নেই।

শিশুদের নিয়ে কাজ করা এই মানুষগুলো চূড়ান্ত দক্ষ এবং সবচেয়ে আন্তরিক। আন্তরিকতা ছাড়া প্রাথমিকে কাজ করা সম্ভব নয়। এত দিন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে প্রধান শিক্ষকদের উত্তরণ ঘটলেও সেই কর্মচারী থেকে গেল সহকারী শিক্ষকরা। তারা এখন ১৩তম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন। এর আগে যখন সহকারী শিক্ষকরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণবিহীন হিসেবে ১৪ ও ১৫তম গ্রেডে বেতন পেতেন তখন প্রধান শিক্ষকরা ১১তম গ্রেডে ছিলেন। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদটি প্রধান শিক্ষকের একধাপ নিচের হলেও বেতন গ্রেডে পার্থক্য ছিল তিন ধাপ। এরপর যখন সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১৩তম করা হয়, তখন পার্থক্য কমে আসে। কিন্তু মাঝে ১২তম গ্রেড থাকে। শোনা গিয়েছিল এখানে সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। এখন দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা ও দশম গ্রেড পাওয়ায় সহকারী শিক্ষকদের সঙ্গে আবার গ্রেড পার্থক্য বেড়ে গেল। তা ছাড়া বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকদের পাঠদান ছাড়াও বহু দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে সঙ্গে সহকারী শিক্ষকরা বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। অথচ তারা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীই রয়ে গেলেন। দেশে তিন লাখেরও বেশি সহকারী শিক্ষক প্রাথমিক শিক্ষায় সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এসব শিক্ষকের বেশির ভাগই অনার্স, মাস্টার্স যোগ্যতাসম্পন্ন। এখন এই উচ্চশিক্ষা নিয়ে ১৩তম গ্রেডে বেতন পাওয়াটা শিক্ষকদের জন্য বৈষম্যের সমান।

প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শিক্ষকদের জীবন। এই মানুষগুলোর হাতেই শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন নির্ভর করে। আর এই কাজটা করেন প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকরা মিলিতভাবে। শিক্ষা উপকরণ, উপাদান বা পদ্ধতি সবকিছুর সফলতা নির্ভর করে শিক্ষকদের ওপর। ফলে তাদের জীবনযাত্রার দিকে লক্ষ রাখা আবশ্যক। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই আসে তাদের প্রাপ্ত গ্রেডের প্রসঙ্গ। এ কথা ঠিক যে তারা যখন শিক্ষকতা পেশায় আসছেন তখন তা দেখে, বুঝে তারপরই আসছেন। কিন্তু দেখতে হবে এখানে প্রাথমিক শিক্ষকদের যোগ্যতার পুরোপুরি মূল্যায়ন হয় কি না। যদি না হয় তাহলে তাদের যোগ্যতার মূল্যায়ন করা একান্ত প্রয়োজন। না হলে আমরা যে চাই দেশের মেধাবী সন্তানরা শিক্ষকতায় বিশেষ করে শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর প্রাথমিকে আসুক তারা কেন অন্য চাকরি ছেড়ে এখানে নিজের মেধা ও শ্রম দেবে?

প্রশ্নটি যৌক্তিকও বটে। যেখানে সুযোগ বেশি তারাও সেখানেই যেতে চাইবে। আর যদি অন্যান্য চাকরির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড দেওয়া হয়, তখন তুলনামূলক বিবেচনায় মেধাবীরা ঠিকই প্রাথমিক শিক্ষায় যোগদান করবে। শিক্ষাকে উন্নত করতে হলে প্রাথমিক শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কারণ এই শিক্ষা হলো ভিত্তি। একটি বহুতল ভবন যেমন সুগঠিত ভিত্তি ছাড়া তৈরি করলে তা ভেঙে পড়ে, তেমনি প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি সুগঠিত না হলে সে উচ্চশিক্ষা অর্জন করবে কীভাবে? সেই গুরুত্বপূর্ণ স্তরেই মনোযোগ দেওয়া জরুরি। শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষার্থীর সুযোগণ্ডসুবিধা এবং ডিজিটালাইজেশন যাই করা হোক এসবের সঙ্গে প্রয়োজন শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়ন। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং জীবনব্যবস্থায় শিক্ষকদের এই আয় সামান্যই। তা ছাড়া প্রশ্নটা সম্মানেরও। এক ধরনের মনঃকষ্ট শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে। প্রত্যেকেই নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন আশা করে। শিক্ষকদের কর্মচারী রেখে দেশ কীভাবে এগিয়ে যাবে?

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের ভিআইপি মর্যাদা দেওয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষকদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে এ দেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষায় বহু সুযোগণ্ডসুবিধা দেওয়া হচ্ছে। নতুন বই, মিড ডে মিল, উপবৃত্তি, শিক্ষাসামগ্রী, শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ নানান কার্যক্রম চলছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে। গ্রেড বৈষম্য দূর করে সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড প্রদান করার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। একমাত্র প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরাই গ্রেডের দিকে এত পেছনে রয়েছে।

কেন শিক্ষকরা সর্বোচ্চ যোগ্যতাধারী হয়েও দশম গ্রেডে কেন বেতন পাবে না? তাদের দুর্বলতা কোথায়। প্রশ্ন হলো যোগ্যতা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়নের। বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের সময় এই ভিন্নতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এমনকি মাধ্যমিকে একজন সিনিয়র শিক্ষক এবং প্রাথমিকের একজন সিনিয়র শিক্ষকের ভেতর এবং একই যোগ্যতায় অন্য কোনো যোগ্যতার মধ্যে এই পার্থক্য বেশ চোখে লাগে। কোনো নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করা একজন মেধাবী ছাত্রছাত্রী কেন স্বেচ্ছায় প্রাথমিকে চাকরি করবে যদি তাকে সেখানে যোগ্য সম্মান দেওয়া না হয়। তাকে কেন তৃতীয় শ্রেণির চাকরিতে যোগ দিতে হবে? মুখে যতই বলি প্রাথমিকেই মেধাবীদের আনতে হবে। কিন্তু তারা কেন আসবে? তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী- এই দুর্দশা থেকে তাদের মুক্তি দেওয়ার সময় এসেছে। সবকিছুর সঙ্গে যদি আধুনিকায়ন করতেই হয়, তবে এখানেও পরিবর্তন করতে হবে। এই ক্ষেত্রে যারা সর্বোচ্চ যোগ্যতাধারী তাদের সঠিক মূল্যায়ন করা জরুরি।

এখন প্রাথমিকে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই ডিগ্রি পাস করা হয়েছে। এরা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং মেধাবী। একসময় প্রাথমিকে এসএসসি এবং যোগ্যতার মূল্যায়ন প্রতিটি চাকরিজীবীই আশা করে। সে ক্ষেত্রে একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় যদি অন্য চাকরিতে দশম গ্রেড পেলে প্রাথমিক শিক্ষকদেরও তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। মানসম্মত শিক্ষাই আমাদের লক্ষ্য। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে যোগ্যতার মাপকাঠি সব ক্ষেত্রে এক করতে হবে। একজন সহকারী শিক্ষক হিসেবে যখন কোনো যোগদান করেন তখন তাদের ভেতর পদোন্নতি পেয়ে প্রধান শিক্ষক বা সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে বা তার থেকেও বড় পদে চাকরির আশা করতে পারে। কারণ অন্য সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির সুযোগ যতটা রয়েছে এখানে ততটা নেই।

সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকে উন্নীত হলেও সেই প্রক্রিয়াও খুব দীর্ঘ। একজন শিক্ষক সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর যেন নির্দিষ্ট সময় পর প্রধান শিক্ষক এবং কমপক্ষে সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পর্যন্ত যেতে পারে সেপথ সুগম করতে হবে। এতে যা হবে তা হলো চাকরির প্রতি দায়িত্ব বৃদ্ধি পাবে এবং একটি লক্ষ্যে অগ্রসর হবে। প্রাথমিক শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর এ কথা সবাই স্বীকার করেন। সে ক্ষেত্রে এই ক্ষেত্রে যে অসংগতিগুলো রয়েছে তা দূর করতে হবে। শিক্ষকদের চাকরির সন্তুষ্টি অর্জন ও তাদের কষ্টের জায়গাগুলোতে পর্যায়ক্রমে পূর্ণ করতে হবে। মেধাবী শিক্ষক টানতে শিক্ষকদের গ্রেড অন্য চাকরির সঙ্গে সামঞ্জস্য করা, পদোন্নতি প্রদান ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। এটা এখন সময়ের দাবি। একজন সহকারী শিক্ষক যেন তার জীবনের একটি পর্যায়ে তার মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক বা সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং সেখান থেকে আরো উঁচুপদে যেতে পারে সে পথ সুগম করতে হবে। তবে সবার আগে বেতন বৈষম্য দূর করাটাই হবে সময়ের নান্দনিক সিদ্ধান্ত।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close