আবির হাসান
মুক্তমত
গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ
কৃষি ও নারী ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য আলোকিত গল্প। পৃথিবীতে শস্য উৎপাদনের জন্য নারীর হাত দিয়েই রোপিত হয়েছিল প্রথম বীজ। আর নারীকে বলা হয় গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণ। গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
বহুযুগ আগে থেকেই এ দেশের সংস্কৃতিতে গ্রামীণ নারীরা উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে জড়িত। নারীরা কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ২১টি ধাপের মধ্যে ১৭টি ধাপেই কাজ করে থাকেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদন মতে, ফসলের প্রাক-বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিপণনের সঙ্গে ৬৮ শতাংশ নারী কাজ করেন। কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারী কৃষিকাজে নিয়োজিত রয়েছেন। ঘরোয়া ও গ্রামীণ পরিবেশের হওয়ায় তারা সহজেই এ পেশার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারেন। তা ছাড়া বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের পুরুষরা অধিক উপার্জনের আশায় শহরকেন্দ্রিক বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হওয়ার কারণে তাদের পারিবারিক কার্যাবল নির্বাহ করার পাশাপাশি খাদ্য ও সামগ্রিক চাহিদা পূরণের জন্য নারীদের বিভিন্ন ধরনের কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত হতে হয়। পশুপালন, মাছ চাষ, খামার প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কাজে নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রেখে চলছে।
গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের সিংহভাগই নারীকেন্দ্রিক। এ দেশে হস্তশিল্পের প্রসারে গ্রামীণ নারীরাই প্রথমত এগিয়ে এসেছেন। অঞ্চলে মসলিন শিল্পের বয়ন থেকে শুরু করে তাঁতবস্ত্র তৈরির মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পের সূচনালগ্নে নারীরাই ভূমিকা রেখেছেন। গ্রামীণ নারীরা বহু আগে থেকেই শুচিশিল্প ও কারুশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কাঁথা সেলাইয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা পরিবারে বাড়তি অর্থের জোগান দিতেন। গবাদি পশু পালনের মাধ্যমে দুধ ও মাংসের জোগানদাতাও নারী। হাঁস-মুরগি পালনের মাধ্যমে নিজের হাত খরচের টাকা এবং অভাবের দিনে পুঁজি দিয়ে সাহায্য করা গ্রামের নারীদের জন্য সাধারণ বিষয়। গ্রামে অনেক নারী এখন ডালের বড়ি, আমসত্ব, তিলের নাড়–, মোয়া ইত্যাদি বানিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করে আয় করছেন। চাহিদা থাকায় মেয়েরা নিয়মিত কাজের সঙ্গে এসব খাবার তৈরিও বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। গ্রামীণ নারীরা পরিবারে সচ্ছলতা আনতে ঘরের পাশে পতিত জমিতে নানা রকম সবজি উৎপাদন করেও গ্রামীণ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে।
গ্রামীণ নারীরা শুধু খাদ্য ও কৃষিতেই নয়, বাংলাদেশের মতো উন্নয়ন্নশীল দেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করাসহ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও তাদের ভূমিকা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তর করেছে আমাদের গ্রামের নারীরা। পোশাকশিল্প বর্তমানে যে পর্যায়ে এসেছে, তার পেছনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে গ্রামের প্রান্তিক নারীরা। বর্তমানে তারাই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি। পোশাকশিল্পকে কেন্দ্র করে ব্যাংক, বিমা, বন্দর, পরিবহন, পর্যটন, হোটেল- সব শিল্পই বিকাশ লাভ করেছে।
কৃষিতে সিংহভাগ অবদান রাখা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যগত সমস্যায় মানসম্পন্ন সেবা, যথাযথ চিকিৎসা ও নির্দেশনা, প্রয়োজনীয় ওষুধ সঠিকভাবে পাচ্ছে না নারীরা। স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত এসব সেবা গ্রহণের জন্য তাদের পুরুষের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাদের অনুমতি বা সম্মতি না পেলে সে আশা-দুরাশায় পরিণত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীন ও প্রান্তিক নারী কৃষিশ্রমিকরা পর্যাপ্ত সুযোগণ্ডসুবিধা পাচ্ছেন না। তাদের ঋণের জন্য মহাজনদের কাছে ধরনা দিতে হয়।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে মনে রাখা জরুরি যে শুধু শ্রমবাজার ও কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণই নয়, প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর মাধ্যমে নারীর শ্রমশক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার বড় ধরনের সুযোগ রয়েছে এবং এর মাধ্যমে অর্থনীতিতে নারীর অবদানকে আরো বাড়ানো সম্ভব। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো ও মূলধারার শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের পথে বাধাগুলো দূর করার চেষ্টা করা জরুরি। অর্থনীতিতে নারীর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করে দেশের উন্নয়নে নারীর অবদান বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীবান্ধব নীতিনির্ধারণ ও প্রয়োগ এবং পাশাপাশি দরকার পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন করা।
একটি দেশকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছাতে হলে তার শিকড় আগে শক্ত করতে হবে। আর আমাদের শিকড় হলো গ্রামবাংলা। তাই পুরুষদের কাজের পাশাপাশি নারীদের কর্মকেও মূল্য দিতে হবে। তবেই আমরা দৃশ্যমান উন্নয়নের পাশাপাশি একটি সমৃদ্ধিশালী-আদর্শ রাষ্ট্রের রোল মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ এবং বিশ্বের দরবারে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারব। আমাদের মনে রাখতে হবে, গ্রামীণ অর্থনীতি হলো দেশের অর্থনীতির প্রাণ। আর সেই প্রাণকে সজীব ও সতেজ রাখে গ্রামীণ নারীরা। তাই গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ জরুরি। তা না হলে দেশের অর্থনীতি অনেকটা পিছিয়ে পড়বে। এতে দেশ অর্থনৈনিক মন্দার সম্মুখীন হবে।
লেখক : ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
"