এ কে এম এ হামিদ

  ২৬ জানুয়ারি, ২০২২

পর্যালোচনা

বঙ্গবন্ধুর দর্শনচর্চা ও আজকের বাস্তবতা

ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ বেনিয়া শাসন অপরিহার্য করার লক্ষ্যে ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতি গ্রহণ করেছিল। এ নীতিতে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে সাম্প্রদায়িক বিবাদ উসকে দেয়। কর্মক্ষেত্রেও একই নীতি অনুসরণ করে শোষণ-বঞ্চনাকেও উসকে দিয়েছিল। জাতিগত বিবাদ ও শোষণ প্রক্রিয়াকে উসকে দিয়ে শাসনকার্য দীর্ঘায়িত করাই ছিল তাদের এ অপকৌশলের উদ্দেশ্য।

পরে রাষ্ট্র পরিচালনায় পাকিস্তান ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠী একই নীতি গ্রহণ করে। ফলে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পৃথক দুটি অঞ্চলে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়, সেখানেও একই ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষের আধিক্য থাকা সত্ত্বেও অপশাসন, শোষণ ও বঞ্চনা অব্যাহত থাকে। এ ক্ষেত্রে পাকশাসক গোষ্ঠীও ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতি গ্রহণ করে। এ নীতিতে ধর্মীয় অপব্যবহারের পাশাপাশি অঞ্চলভেদে শোষণ ও বঞ্চনার ব্যাপকতা লক্ষ করা গেছে।

একই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অধীনে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর মধ্যে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে প্রকট বৈষম্য লক্ষ করা যায়। সম্পদ বণ্টন ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের জনগণ অধিক সুবিধা পায়। বঞ্চিত হয় পূর্বাঞ্চলের জনগণ। সর্বক্ষেত্রে দাবিয়ে রাখার এ কৌশল এ অঞ্চলের জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। বিষয়টি গভীরভাবে পীড়া দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

ধাপে ধাপে মানুষকে সংগঠিত করে তিনি মুক্তির অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামে উপনীত হন এবং ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটান। এ সংগ্রামের অঙ্গীকার ছিল শ্রমিক, কৃষকসহ মেহনতি মানুষের শোষণ মুক্তির মাধ্যমে একটি মর্যাদাসম্পন্ন ও সামাজিক ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু স্পষ্টভাবে জানান দিয়েছেন, ‘এই স্বাধীনতা তখনি আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলার কৃষক, মজুর ও দুঃখী মানুষের সব দুঃখের অবসান হবে।’

স্বাধীনতার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকারের বিষয়টি বঙ্গবন্ধু সুদৃঢ় করেন। সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তির লক্ষ্যে বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষকে কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা’। ১৫(খ) অনুচ্ছেদে কর্ম ও মজুরির অধিকার নিশ্চিতকল্পে বলা হয়েছে- ‘কর্মের অধিকার অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসংগত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার; যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার।’

৩৪ অনুচ্ছেদে জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ করে বলা হয়েছে- ‘সকল প্রকার জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ; এবং এই বিধান কোনোভাবে লংঘিত হইলে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে।’ সংবিধানের ৪০ অনুচ্ছেদে পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা নিশ্চিত করে বলা হয়েছে- ‘আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে কোনো পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের কিংবা কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার জন্য আইনের দ্বারা কোনো যোগ্যতা নির্ধারিত হইয়া থাকিলে অনুরূপ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের যে কোনো আইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের এবং যে কোনো আইনসঙ্গত কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার অধিকার থাকিবে।’

অনুরূপভাবে বৈষম্য ও শোষণ প্রক্রিয়াকে তিনি জাতির প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যা স্পষ্টতই ফুটে উঠেছে ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদযানে স্বাধীনতা দিবসের বঙ্গবন্ধুর ভাষণে। তিনি চাকরিজীবীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আপনি চাকরি করেন আপনার মায়না দেয় ওই গরিব কৃষক, আপনার মায়না দেয় ওই গরিব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়, আমি গাড়ি চলি ওই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলুন, ওরাই মালিক।’

বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ ৫৪ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তিনি বৈষম্যমুক্ত সমাজ নির্মাণে লড়াই করে গেছেন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার জাতীয় বেতন স্কেলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য ১০টি গ্রেডের একটি সুষম বেতন কাঠামো উপহার দেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সামাজিকভাবে অবস্থান মানুষ ভেদে যা থাকুক না কেন, মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে কোনো ব্যবধান থাকতে পারে না। সবাইকে জীবনধারণের জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হয়।

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংসদে সংবিধান বিলের বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘কেউ কেউ বলছেন সরকারি কর্মচারীদের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। তাদের উচিত অন্যান্য দেশের সংবিধান পড়া। সরকারি কর্মকর্তারা ভিন্ন শ্রেণির নন। তারা আমাদের ভাই, তারা আমাদের বাপ। তারা আলাদা শ্রেণির নয়।’ বঙ্গবন্ধু আরো বলেছিলেন, ‘ব্রিটিশ শাসনামলে আইসিএস এবং আইপিএস কর্মকর্তারা সুরক্ষা সুবিধা পেয়েছিলেন, তারা পাকিস্তান শাসনামলেও একই সুরক্ষা পেয়েছেন। আমি কেবল সেই সুরক্ষা ইস্যুতে আঘাত করেছি।’

শেখ মুজিব ইন বাংলাদেশ অ্যাসেম্বলি (১৯৭২-৭৫) গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘কোনো শ্রেণিই অধিক প্রভাবশালী হবে না, কারণ শ্রেণিহীন সমাজ গঠনই আমাদের লক্ষ্য। আমরা একটি শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যেখানে সবাই সমান।’ সরকারি কর্মচারীদের মানসিকতা পরিবর্তনের জোর দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘কিছু লোক আমার কাছে এসে সুরক্ষা চেয়েছিল। আমি তাদের বলেছিলাম, আপনাদের কাছ থেকেই জনগণের সুরক্ষা দরকার।’ তিনি স্পষ্টতই বলেছিলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা ও অন্য সবার সমান অধিকার। তাদের বেতন কৃষক এবং শ্রমিকদের দেওয়া কর থেকে এসেছে, তাই তাদের সবার সমান অধিকার থাকা উচিত।’

বৈষম্য হ্রাসে বঙ্গবন্ধু আমলাদের জন্য অসংখ্য গ্রেড কমিয়ে মাত্র ১০টি গ্রেডে নিয়ে এসেছিলেন। জাতির দুর্ভাগ্য ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণের পর ১৯৭৭ সালের বেতন স্কেল ১০টি গ্রেডের পরিবর্তে ২২টি গ্রেড প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্যের সূত্রপাত করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালে সচিবালয়ের সঙ্গে সচিবালয়ের বাইরের কর্মচারীদের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করে এ বৈষম্যকে আরেক দফা বৃদ্ধি করা হয়। এরপর থেকেই শোষণ আর বৈষম্য ঘিরে কর্মচারীদের ন্যায্য আন্দোলন-সংগ্রাম চলতে থাকলেও তার অবসান না হয়ে বরং বৈষম্য আরো বৃদ্ধি করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় চাকরি ও বেতন কমিশন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বৈষম্য হ্রাসে পর্যায়ক্রমে ২০টি গ্রেডের পরিবর্তে ১৬টি গ্রেড নির্ধারণের প্রস্তাব করেছিল বলে জানা যায়। কিন্তু কতিপয় উচ্চ বর্ণবাদ ও সুবিধাবাদী গোষ্ঠী বৈষম্যের মধ্যে নিজেদের আভিজাত্য টিকিয়ে রাখার স্বার্থে প্রস্তাবের চরম বিরোধিতা করে এবং চূড়ান্তভাবে ২০টি গ্রেড বহাল রাখে। শতাংশ বিবেচনায় বেতন বৃদ্ধির চমকপ্রদ ঘোষণা থাকলে ১০ম থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের টাকার অঙ্কে বেতন দেখানো হলেও সুযোগণ্ডসুবিধার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পায়নি।

জীবনের অপরিহার্য চাহিদা সবার জন্য সমান হলেও বেতন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ১ থেকে নবম গ্রেডের কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগণ্ডসুবিধা বহুলাংশে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর ওপর গাড়ি, সহায়ক কর্মচারীর সুযোগণ্ডসুবিধাও অব্যাহত রয়েছে তাদের জন্য। কিন্তু যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেই উদ্দেশ্য কতটা আজ অর্জিত হয়েছে- সেটি বিবেচনার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। উচ্চধাপে বেতন ও সুযোগণ্ডসুবিধা বহু গুণ বৃদ্ধি করা হলেও উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতি তেমন একটা হ্রাস পায়নি। বরং বেড়েছে বহু গুণ। অফিসের কর্তাব্যক্তি সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলে নিচের দিকে তেমন দুর্নীতি বা অনিয়মের সুযোগ থাকে না। এ ধরনের সংস্কৃতি চালু করা সম্ভব হলেই রাষ্ট্রীয় অবিচার, অনাচার, বৈষম্য, বিশৃঙ্খলা ক্রমেই কমে আসতে বাধ্য।

লক্ষ্য করা যাচ্ছে- দেশে উন্নয়ন উৎপাদন ও সেবা কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত কিছু কোম্পানি/প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এসব কোম্পানি/সংস্থা সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য রয়েছে পরিচালনা পরিষদ। এ সুযোগে সেসব সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা এসব কোম্পানি/প্রতিষ্ঠানে সরকারি বিধিবিধান, বেতন কাঠামো উপেক্ষা করে স্ব-স্ব আঙ্গিকে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান ঔপনিবেশিক আমলের ন্যায় বৈষম্যমূলক বেতন কাঠামো ও শ্রেণিপ্রথা প্রবর্তন করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছে। যদিও সরকার শ্রেণি প্রথার বিলোপ ঘটিয়ে সবাইকে বিভিন্ন গ্রেডভুক্ত কর্মচারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে- বঙ্গবন্ধুর বহু কাক্সিক্ষত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমগ্র জাতিকে আবার ঐক্যবদ্ধ করার উদয়াস্ত নিরলস কাজ করছেন। সেখানে সরকারি কর্মচারীদের পুনরায় পাকিস্তানি স্টাইলে উচ্চশ্রেণি, নিম্ন শ্রেণি, অভিজাত, অনভিজাত ইত্যাদি নামে বিভক্ত করা হচ্ছে কেন? তাহলে কি জাতির পিতার শ্রেণিবৈষম্যহীন সামাজিক রাষ্ট্রীয় দর্শন শেখ হাসিনার আমলেও উপেক্ষিত হবে? জনগণ বিভ্রান্ত হওয়ার আগে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সরকার নির্ধারিত গ্রেডের পরিবর্তে বৈষম্যমূলক বেতন ও সাংগঠনিক কাঠামো প্রণয়নের উদ্যোগ বন্ধ করা উচিত।

লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও সভাপতি

ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close