ড. মো. শাহ কামাল খান

  ২৫ জানুয়ারি, ২০২২

শ্রদ্ধাঞ্জলি

কৃষিবিদ জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র বদিউজ্জামান বাদশা

বরেণ্য কৃষিবিদ, বর্ষীয়ান জননেতা বদিউজ্জামান বাদশা। নবীন-প্রবীণ সব কৃষিবিদের আপনজন, আত্মার আত্মীয়, সবার মনের মণিকোঠায় স্থান পাওয়া এক বিশেষ ব্যক্তিত্ব, কৃষিবিদ জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ১৯৫৮ সালের ৫ জানুয়ারি শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে তার জন্ম। মেধাবী ছাত্র বদিউজ্জামান বাদশা ১৯৭৪ সালে ৫টি লেটারসহ এসএসসি পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ জামালের সহপাঠী ছিলেন। কিন্তু শেখ জামালের সহপাঠী পরিচয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কখনো বিশেষ সুবিধা নেননি বা নেওয়ার চেষ্টাও করেননি বিশাল মনের অধিকারী এই ত্যাগী নেতা। তিনি এইচএসসি পাস করে সিলেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু মেডিকেল কলেজ ছেড়ে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েও তা প্রত্যাখ্যান করে দেশের কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নের ব্রত নিয়ে ভর্তি হন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বদিউজ্জামান বাদশা ৭৫-পরবর্তী কঠিন দিনগুলোতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুজিবীয় আদর্শের অগ্রসৈনিক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পাশাপাশি সামরিক শাসন এবং স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হিসেবে কাজ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। রাজনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র বদিউজ্জামান বাদশা তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, দক্ষ সাংগঠনিক ক্ষমতার বদৌলতে পরে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সহসভাপতি, কৃষক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি, নালিতাবাড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উপকমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। নালিতাবাড়ীতে তিনি হাজি নূরুল হক নন্নী-পোড়াগাঁও মৈত্রী কলেজ, নালিতাবাড়ী ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনে নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কৃষিবিদদের নেতৃত্ব দেন এবং ভালোবাসার ছায়াতলে আগলে রাখেন। কৃষিবিদদের বিভিন্ন ন্যায্য দাবি আদায়ে তিনি অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন। বিভিন্ন ফোরামে তার অকুতোভয় বক্তব্য ও ভাষা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। নবীন-প্রবীণ সব কৃষিবিদের সঙ্গে তার ছিল মধুর সম্পর্ক। তিনি সর্বদা কৃষিবিদদের কাছে ডাকতেন, পাশে থাকতেন, খোঁজখবর নিতেন, সমস্যা সমাধানে তৎপর থাকতেন।

২২ নভেম্বর, ২০২১ শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বরেণ্য রাজনীতিবিদ ও সাবেক ছাত্রনেতা কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা ইন্তেকাল করেন। ঢাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট চত্বরে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় জানাজা হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ এবং নালিতাবাড়ী তারাগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে তৃতীয় জানাজা শেষে পৌর শহরের সিটপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়। নালিতাবাড়ীতে তার জানাজায় লোকে লোকারণ্য ছিল উপজেলা সদর এলাকা। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে দলে দলে জানাজায় যোগ দিয়েছিল আবালবৃদ্ধবনিতাসহ অসংস্য মানুষ। যাদের প্রত্যেকেই ছিল তার গুণগ্রাহী ও ভক্ত। স্থানীয় নেতারা, জনপ্রতিনিধিরা ও জনসাধারণ তার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। একজন মানুষের মৃত্যু হলে তার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশার মৃত্যুতে দেশের সব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কৃষিবিদদের গর্ব ও অহংকার কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা ভাই আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তার মৃত্যুতে কৃষিবিদ জগৎ হারালো এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। কারণ তিনি শুধু একজন ব্যক্তি নন, একটি রাজনৈতিক প্রতিভার নাম। দেশের কৃষিবিদের চোখের মণি। তথ্য-উপাত্তে সমৃদ্ধ অনর্গল বক্তৃতা দেওয়ায় ক্ষমতা ছিল তার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রাঞ্জল শব্দচয়নে বক্তৃতা দিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষণ করার মতো একজন জননেতা ছিলেন। জনবান্ধব, গণমুখী ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একনিষ্ঠ অনুসারী জনপ্রিয় নেতা কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা ছিলেন আজীবন সংগ্রামী এক জননেতা। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য এই নির্লোভ এবং ত্যাগী মানুষটি অনেকটা অবমূল্যায়িত হয়ে অস্ফুট গোলাপের মতো অকালে ঝরে গেলেন। প্রতি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি আসবে, কৃষিবিদ দিবস পালিত হবে, দেশব্যাপী কৃষিবিদদের বিভিন্ন মিলনমেলা হবে কিন্তু প্রিয় বাদশা ভাইকে দেখা যাবে না, তার তথ্যসমৃদ্ধ মনোমুগ্ধকর বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য আর আমাদের হবে না।

আজ ব্যক্তি বদিউজ্জামান বাদশা আমাদের মধ্যে নেই। এ কথা যেমন সত্য, তার চেয়েও বড় সত্য তার আদর্শ ও শিক্ষা, যা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তার সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হোক প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম, তার গুণাবলির চর্চা হোক দেশ থেকে দেশান্তরে। সৃষ্টি হোক অসংখ্য ত্যাগী নেতার যাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন আমাদের সবার প্রিয় বদিউজ্জামান বাদশা ভাই। পরিশেষে বলতে চাই, বাদশা ভাই আছেন, থাকবেন আমাদের সবার অস্তিত্বের মধ্যে। তিনি থাকবেন সংগ্রামে, চেতনায়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত অবিচলিত আমৃত্যু পথচলায়।

লেখক : প্রকল্প পরিচালক

কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close