মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

  ২৫ জানুয়ারি, ২০২২

দৃষ্টিপাত

নাসিক নির্বাচনের বহুমাত্রিক মূল্যায়ন ও করণীয়

অবশেষে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচন অভূতপূর্ব অনুভূতি জাগিয়ে শেষ হয়েছে। সব গণমাধ্যম একবাক্যে নির্বাচনটিকে মডেল নির্বাচন হিসেবে উপস্থাপন করেছে। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার এটিকে তার দেখা সর্বোত্তম নির্বাচন বলে দাবি করেছেন। তবে এই নির্বাচনে মেয়র পদে পরাজিত স্বতন্ত্র হাতি মার্কার প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার দাবি করেছেন, ‘আমি আগেই বলেছি প্রশাসন, পুলিশ ও নির্বাচন কমিশন আমার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। আমি ইভিএমের ইন্টারনাল মেকানিজমে হেরেছি।’ নারায়ণগঞ্জে ইভিএমে ভোটদানে ভোটারদের কিছু যান্ত্রিক বিড়ম্বনা ছাড়া তেমন কোনো উদ্দেশ্যজনিত ত্রুটির কথা গণমাধ্যম বা পর্যবেক্ষকদের কেউ দেখেননি বা উল্লেখও করেননি। ভোটদানে বিড়ম্বনা এবং কেউ কেউ ফিরে গেলেও সেই সংখ্যাটি খুবই অনুল্লেখযোগ্য বলেই গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে। যারা ভোট দিতে পারেননি, তারা কোন প্রার্থীকে ভোট দিতেন সেটিও কিন্তু কেউ নির্দিষ্ট করতে পারেননি। ফলে তৈমূর আলমের দাবিটি পরাজিত কোনো প্রার্থীর আবেগ ও হতাশাজনিত প্রতিক্রিয়ার বেশি তেমন কোনো জনসমর্থন বা মিডিয়া সমর্থন পাওয়ার মতো নয়। তা ছাড়া তিনি যত ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন তত ভোটার ইভিএম ত্রুটির কারণে ভোট দিতে পারেননি, এমনটি কেউ মনে করেন না। ফলে তৈমূর আলমের অভিযোগটি তার সমর্থকদের সমর্থন আদায় করতে পেরেছে কি না বলা কঠিন। নাসিক নির্বাচনে ৭ প্রার্থী মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তাদের মধ্যে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী আওয়ামী লীগ মনোনীত। অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার বিএনপি নেতা হওয়া সত্ত্বেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে তাকে নির্বাচন করতে হয়েছে। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের মাসুম বিল্লাহ, বাংলাদেশ খেলাফতে মজলিসের এ বি এম সিরাজুল মামুন, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির রাশেদ ফেরদৌস এবং বাংলাদেশ খেলাফতে আন্দোলন মো. জসিম উদ্দিনকে স্ব-স্ব দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া ছিল। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন কামরুল ইসলাম। নির্বাচনের ফলাফলে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী পেয়েছেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৭, তৈমূর আলম খন্দকার ৯২ হাজার ৫৬২, মাসুম বিল্লাহ ২৩ হাজার ৯৮৭, এ বি এম সিরাজুল মামুন ১০ হাজার ৭২৪, রাশেদ ফেরদৌস ১ হাজার ৯২৭, মো. জসিম উদ্দিন ১ হাজার ৩০৯ এবং কামরুল ইসলাম ১ হাজার ৩০৫ ভোট পেয়েছেন। মেয়র পদে ডা. আইভী ৬৬ হাজার ৫৩৫ ভোটে তৈমূর আলমকে পরাজিত করেন। তিনটি ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠনের প্রার্থীরা পেয়েছেন ৩৬ হাজার ২০ ভোট। অন্য দুই প্রার্থীর ভোটের সংখ্যা যথাক্রমে ১ হাজার ৯২৭ এবং ১ হাজার ৩০৫। মোট ভোটার ছিলেন ৫ লাখ ১৭ হাজার ৩৬১ জন, ভোটদান করেছেন ২ লাখ ৯০ হাজার ৯১১ জন, শতকরা ৫৬ শতাংশ ভোট মেয়র পদে প্রদত্ত হয়েছে। ২৭টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ১৪ জন, বিএনপি সমর্থিত ৯, জাতীয় পার্টির ২, বাসদের ১ এবং স্বতন্ত্রের ১ জন কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। কাউন্সিলরদের মধ্যে অন্তত ১৩ জন হত্যা, মাদক, অস্ত্রসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের ৯ জনের মধ্যে ৮ জনই পুরোনো, ১ জন নতুন সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

নির্বাচনে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। প্রচার-প্রচারণার সময়ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও সংঘর্ষ ঘটেনি। মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান দুই প্রার্থীর মধ্যে সৌহার্দমূলক সম্পর্ক ও কথাবার্তা গণমাধ্যমে প্রচারিত হতে দেখা গেছে। প্রচার কিংবা নির্বাচনে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে এমন কোনো বাগ্যুদ্ধ হয়নি বললেই চলে। নির্বাচনের দিন কোনো ভোটকেন্দ্রেই পোলিং এজেন্ট নিয়ে কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি। সব দলের এজেন্টরা নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। কেন্দ্রের ভেতরে কোথাও কোনো প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ওঠেনি, ভোটারদের ভোট দানে বাধা দেওয়ার কথা শোনা যায়নি। সকাল থেকেই সুশৃঙ্খলভাবে ভোটাররা লাইনে দাঁড়িয়ে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোটদান করতে পেরেছেন বলে অনেকেই গণমাধ্যমের সম্মুখে উল্লেখ করেছেন। সব কেন্দ্রেই ছিল বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা, ছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত সংখ্যক সদস্য, রাস্তায় ছিল র‌্যাব-পুলিশের বিশেষ টহল। কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা কেউ করেনি। সামগ্রিক এই পরিবেশ এক কথায় অভূতপূর্ব। সে কারণে নির্বাচনটি শুরু থেকে শেষ অবধি শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য এবং উত্তম নির্বাচনের কৃতিত্ব লাভ করেছে। এমন নির্বাচনটির জন্য কৃতিত্ব সবাইকেই দিতে হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এবং দলগুলো আচরণবিধি ভঙ্গ করেনি, নির্বাচন কমিশন নিয়ম অনুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আইন ও বিধি অনুযায়ী কাজ করেছে, সরকারি দল কোনোভাবে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেনি। সরকার ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচনটি নিয়ে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হোক সেটি মনেপ্রাণে চায়নি- তেমনটি সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হয়ে বলা যায়। নাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নির্ভার থাকার মতো প্রার্থী মনোনয়ন দানে বেশ প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী দুবার পৌরসভার মেয়র এবং দুবার সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচিত ও পরীক্ষিত প্রার্থী ছিলেন। তিনি প্রতিবারই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেছেন। এমনকি ২০১১ সালের নাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমানকে ১ লাখ ১ হাজার ৩৪৩ ভোটে পরাজিত করেছেন। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৮ ভোট পেয়েছিলেন। এই নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার নির্বাচনের কয়েক ঘণ্টা আগে গভীর রাতে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ান। সেই নির্বাচনে তৈমূর আলম খন্দকারের মার্কায় ৭ হাজার ৬১৬ ভোট পড়েছিল। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় নাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকে মেয়র পদে প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী পেয়েছিলেন ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬১১ ভোট এবং বিএনপি মনোনীত ধানের শীষ প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান ৯৬ হাজার ৪৪ ভোট পেয়েছিলেন। আইভী সাখাওয়াতকে ৭৯ হাজার ৫৬৭ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছিলেন। টানা এই ২০ বছর ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী নির্বাচিত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ এবং সাবেক পৌর চেয়ারম্যান আলী আহাম্মদ চুনকার মেয়ে। সরকারি বৃত্তি নিয়ে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে লেখাপড়া করতে যান, সেখান থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে ডাক্তারি এবং রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। জনগণের কাছে বাবার পরিচয়েই শুধু নন, ব্যক্তিগত সহজ-সরল, সদালাপী এবং মানবকল্যাণ চিন্তার অধিকারী মানুষ হিসেবে নিজেকে সব কর্মস্থলে প্রমাণ করতে পেরেছেন। আইভী একদিকে যেমন যথেষ্ট রাজনীতিসচেতন মানুষ, অন্যদিকে সততা, কর্মনিষ্ঠা, মানবসেবা এবং ত্যাগের আদর্শে নিজেকে সব সময় উৎসর্গ করার মনোবৃত্তি অনুসরণ করে চলছেন। মেয়র পদে বিভিন্নজনের বিভিন্ন চাওয়া-পাওয়া, ইচ্ছা ও প্রবণতা থাকে। রাজনীতিসচেতন মানুষ হিসেবে তিনি সবকিছুকেই সামাল দেওয়ার প্রমাণ রেখে চলছেন। ফলে তিনি বড় ধরনের কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার মতো কাজ কিংবা জীবনাচরণের প্রমাণ মেয়র পদে বসে সৃষ্টি করার চেষ্টা করেননি। সে কারণেই নারায়ণগঞ্জের মেয়র পদে তিনি তার নিজের সুনাম যেমন ধরে রাখতে পেরেছেন, একই সঙ্গে জনগণের সমর্থন ও ভালোবাসা অক্ষুণœ রাখতে পেরেছেন। তাকে নিয়ে এমন কোনো বিতর্ক নারায়ণগঞ্জের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে তার প্রতিপক্ষ গোষ্ঠী প্রচারে আনতে পারেনি। যদিও তিনি দলের একটি অংশের বিরোধিতার মুখে আগাগোড়াই ছিলেন, এখনো আছেন। কিন্তু সেই বিরোধিতা ও বাধা তার প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থনকে অটুট রাখতেই সাহায্য করছে। সে কারণেই সেলিনা হায়াৎ আইভী দল-মত নির্বিশেষে অনেকের কাছেই নারায়ণগঞ্জে তার অপরিহার্যতা ধরে রাখতে পেরেছেন। অন্যদিকে যারা তার বিরোধিতা করছেন তারা রাজনৈতিক আদর্শের কথা যা-ই দাবি করেন না কেন, জনগণের কাছে তাদের ভাবমূর্তির সংকট কাটিয়ে ওঠার মতো কিছু করছেন না। বরং বাড়িয়েই তুলছেন। এই নির্বাচনে স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান এবং শামীম ওসমানের ভূমিকা নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে শামীম ওসমান একবার সংবাদ সম্মেলন করে যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন, আবার ভোটের দিন নানা ‘ওসিহত’ এবং বাকপটুতার যে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেটি রাজনীতির অঙ্গনে তাকে নিয়ে নানা প্রশ্নের আরো নতুন করে জন্ম দিয়েছে। আওয়ামী লীগকে ভাবতে হবে দলের জন্য কার ভূমিকা সহায়ক, কার ভূমিকা নেতিবাচক। তবে যেটি নির্দ্বিধায় বলা চলে- ডা. আইভীর মতো যত বেশি নেতাকর্মী দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে থাকবে, বিভিন্ন নির্বাচনে মনোনয়ন লাভ করবে, তত বেশি আওয়ামী লীগ জয়ের ব্যাপারে নির্ভার থাকতে পারবে, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদেরও নারায়ণগঞ্জ থেকে অনেক কিছু শেখার এবং করণীয় রয়েছে। দলকে বিজয়ী করার উত্তম পন্থা হচ্ছে জনগণের কাছে ব্যক্তি হিসেবে যেমন গ্রহণযোগ্য করে তোলা, দলের আদর্শকেও সেভাবে তুলে ধরা এবং প্রতিষ্ঠা করা। শুধু বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার নাম কথায় কথায় উচ্চারণই দলের মঙ্গল বয়ে আনবে না। কিংবা জনগণের কাছে দলের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করবে না। ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির সংকট জনগণের কাছে থাকলে নির্বাচনে নৌকা প্রতীক ডুবিয়ে দেওয়া ছাড়া জলে ভাসানোর উদাহরণ সৃষ্টি করা যায় না। ইউপি নির্বাচনে অসংখ্য প্রমাণ তেমন রয়েছে। সে কারণে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকেই দলের ভবিষ্যৎ রাজনীতির নেতাকর্মী বাছাই করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close