মো. জিল্লুর রহমান

  ২৩ জানুয়ারি, ২০২২

দৃষ্টিপাত

অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও টেকসই বসতি

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে নগরায়ণ প্রক্রিয়া খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। শুধু ঢাকাণ্ডচট্টগ্রামের মতো বড় শহরেই নয়, নগর, বন্দর, মফস্বল এলাকা ও এর আশপাশেও অপরিকল্পিত নগরায়ণ গড়ে উঠছে। তবে এই বৃদ্ধির ধারা সব জায়গায় সমান নয়। সাধারণত বড় শহরে শিল্প-কারখানা, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, শিক্ষা-চিকিৎসার সুবিধা, সরকারি প্রশাসন ও বিনোদন ব্যবস্থার জন্য সেসব স্থানের নগরায়ণ প্রক্রিয়া অধিক গতিশীল। অপরিকল্পিত নগরায়িত এলাকা বলতে মূলত ভবিষ্যৎ ঝুঁকির কথা চিন্তা না করে অসমন্বিত, অপরিকল্পিত, অসম ও ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ধীরে ধীরে একটি নগরের সম্প্রসারণকে বোঝায়, যা সাধারণত টেকসই হয় না।

অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঢাকা শহরে তিল পরিমাণ স্থান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এখানে পাহাড়সম সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। বাসস্থানের অভাবের ফলে গড়ে উঠছে ভাসমান মানুষের বস্তি। যার ফলশ্রুতিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি। এ শহরে ময়লা-আবর্জনা-দুর্গন্ধ ইত্যাদি নিত্যদিনের সঙ্গী। শহরের বিপুল জনসংখ্যার বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে গিয়ে অবৈধ দখলদারিত্ব বেড়ে চলেছে আশঙ্কাজনক হারে। লেক ও নদীর পাড়গুলো দখল করে নিচ্ছে কিছু অসাধু লোক। যার ফলে নদী হারাচ্ছে নাব্যতা, লেক হচ্ছে দূষিত। যার ফলশ্রুতিতে ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতার মতো সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। খুব সহজ সমীকরণে বলা যায় জনসংখ্যা যত বেশি হবে তাদের দ্বারা সৃষ্ট ময়লা আবর্জনা তত বেশি হবে এবং এই ময়লা-আবর্জনা যত্রতত্র নিক্ষেপের ফলে সৃষ্টি হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। পাশাপাশি পরিবেশদূষণও মারাত্মক আকার ধারণ করে। লেক ও নদীতে ময়লা-আবর্জনা ছুড়ে ফেলার ফলে পানি হচ্ছে দূষিত এবং এ থেকে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। শহরের বস্তি এলাকাগুলোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিভিন্ন জীবাণু থাকে, যা আশপাশের পরিবেশকে দূষিত করে এবং এর ফলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে।

ঢাকাসহ সারা দেশে ক্রমবর্ধমান নগরমুখিতা এবং দ্রুত নগরায়ণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠছে না। ফলে নাগরিক সুবিধার অসম বণ্টন এবং চরম বৈষম্যমূলক নীতি প্রণয়নসহ অবকাঠামোকেন্দ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জীবনযাত্রা এবং পরিবেশ মারাত্মকভাবে উপেক্ষিত থাকছে। সব শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে, মানুষের জন্য বাসযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব নগরই ঢাকার অন্যতম প্রধান সমস্যা। একইভাবে গ্রামাঞ্চলেও যে যেখানে পারছে, আবাদি জমি ভরাট করে বসতি গড়ে তুলছে। শহরের মতো গ্রামাঞ্চলেও অপরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গড়ে উঠছে যেখানে নাগরিক সুবিধার ছিটেফোঁটা সুযোগও নেই।

অন্যদিকে ঢাকা শহরের একটি বড় সমস্যা হলো যানজট। এটি অপরিকল্পিত নগরায়ণের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। পরিকল্পনার অভাব ও দুর্নীতির ফলে শহরের রাস্তাঘাটে হরহামেশাই যানজট লক্ষ্য করা যায়। আরো আছে কয়েক দিন পর পর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। এর ফলে রাস্তার প্রত্যাশিত আয়ু অনেক কমে যায়। পাশাপাশি রাস্তায় চলাচলকারী যানবাহন ও জনগণের অনেক অসুবিধা হয়। বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, বর্ষাকালে রাস্তা খননের অনুমতি দেওয়া হয়। ফলে পথচারী ও যানবাহনগুলোর অসুবিধা অনেক বেশি হয়। এখানেও পরিকল্পনার অভাব বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। রাস্তার নিচে আন্ডারগ্রাউন্ড সিস্টেম না থাকায় বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করতে হয়।

অধিক জনসংখ্যা ও পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে ঢাকায় বিনোদনের পর্যাপ্ত সুযোগণ্ডসুবিধা নেই। কয়েকটি নির্দিষ্ট পার্ক ও বিনোদনকেন্দ্র ছাড়া তেমন বিশুদ্ধ নির্মল পরিবেশের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। শিশুদের বিকাশে যে পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা থাকা উচিত তার ছিটেফোঁটাও নেই। নেই কোনো খেলার মাঠ ও কোনো নির্মল পরিবেশ। গাছপালার অভাবও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। আজকাল আবার বিভিন্ন মাঠ দখল করে সুপার মার্কেট, অ্যাপার্টমেন্ট ইত্যাদি গড়ে তোলার হিড়িক পড়েছে। ফলে শিশুরা খেলার মাঠ থেকে বঞ্চিত। ঘরের কোনায় থাকতে থাকতে তাদের পর্যাপ্ত মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় দেখা গেছে, নগরীতে বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে ওঠা অবকাঠামোর ৭৩ শতাংশই পুরোপুরি অপরিকল্পিত। অপরিকল্পিত অবকাঠামোর কারণে যানজট আর জলাবদ্ধতার শহরে পরিণত হয়েছে রাজধানী ঢাকা। সে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পানিতে দুর্গন্ধ, রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, মশা-মাছির যন্ত্রণাসহ আবাসন সংকট। ভূমি ব্যবহারের যথাযথ নীতিমালা না মেনে গড়ে উঠেছে বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন।

জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল ভরাট করে গড়ে ওঠা অপরিণামদর্শী উন্নয়নের ফলে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে রাজধানীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। অপ্রতুল সড়কব্যবস্থার কারণে বিপর্যস্ত হয়েছে পরিবহন খাত। শহরের বাসিন্দাদের নির্বিঘেœ যাতায়াতের জন্য মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়কের প্রয়োজন হলেও রাজধানীতে রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ। এখানে মোট সড়কের আয়তন ১ হাজার ২৮৬ কিলোমিটার। তার ৫২ শতাংশই আবার মোটরযান চলাচলের অনুপযোগী। এ কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে যানজট।

বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ নগরে বসবাস করলেও বাংলাদেশে শহরবাসীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। তবে দিন দিন এই শহরে আগমনকারী জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিক জনসংখ্যা শহরের ধারণক্ষমতা বা সেবাপ্রদান করার ক্ষমতার তুলনায় বেশি হওয়ায় এই নতুনদের কারণে নগরবাসীর জীবন হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ পদ্ধতির জন্য পুরো নগর জীবনে নেমে আসছে নানা ধরনের নেতিবাচক প্রভাব। বর্তমানে অপরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য পরিবেশ ও অবকাঠামোগত নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

যেমন- পরিবেশ দূষণ, বাসস্থান ও খাদ্যের অভাব, পরিবহন সংকট, যানবাহন সংকট ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র অভাব দেখা দেয়। এছাড়াও যানজট সমস্যা, অব্যবহারযোগ্য যানবাহনের আধিক্য ইত্যাদিও নগর জীবনে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি করছে। ঢাকা শহরের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও সন্তোষজনক নয় এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঠিক নিয়মণ্ডকানুন মেনে না চলার জন্য পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। বর্জ্যরে তীব্র দুর্গন্ধ ও বিষাক্ত ধোঁয়া পরিবেশদূষণের অন্যতম কারণ। ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠের পানিকে দূষিত করছে। আবার কল-কারখানার কালো ধোঁয়া, চামড়া শিল্পের বর্জ্য, যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। ফলে হাঁপানি, সর্দি, ক্যান্সার, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে।

ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ১২ মিলিয়নেরও বেশি। এই বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য, বাসস্থানসহ আরো অন্য সুযোগণ্ডসুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। ঢাকা শহরের উন্নয়নের জন্য একমাত্র কর্তৃপক্ষ হলো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। বর্তমানে পরিকল্পনা ও উন্নয়নের জন্য যে সব আইন বলবৎ আছে তা উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিদ্যমান আইনগুলোর সঠিক ব্যবহার করা হয় না। উঁচু অ্যাপার্টমেন্টগুলো স্থাপন করা হয় বাসস্থান সমস্যা দূর করার জন্য। কিন্তু বস্তুত দেখা যাচ্ছে, এই স্থাপনাগুলোর কারণেই ঘনবসতির মতো খারাপ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বর্তমানে ঢাকায় খালি জায়গা একেবারেই দুষ্প্রাপ্য। সব জায়গাতেই উঁচু স্থাপনার ফলে জনবসতি এখানে অনেক বেশি ঘন। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে পানি, বিদ্যুৎ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মতো জটিল সমস্যা। যেহেতু পরিকল্পনার অভাবে যত্রতত্র বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, অফিস-আদালত ইত্যাদি গড়ে তোলা হচ্ছে ফলে সৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশদূষণ থেকে শুরু করে নানা সমস্যা।

অপরিকল্পিত নগরায়ণ যেমন নগরবাসীর জন্য নিরাপদ বাসস্থানের সংকট তৈরি করছে, তেমনভাবে সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ক্ষতিসাধন করে স্বাভাবিক জীবনযাপনকে হুমকির সম্মুখীন করছে। তাই নগরবাসীর জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগণ্ডসুবিধা বৃদ্ধি করাসহ সব ধরনের নগর সুবিধার উপযুক্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। বাংলাদেশে জনপ্রতি কৃষি জমির পরিমাণ প্রায় ০.০৫ হেক্টর এবং শহরগুলো প্রায়ই কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে গড়ে ওঠে।

বর্তমানে ঢাকা শহরের ৬২ শতাংশ ভূমিতে গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ ভূমিতে পরিকল্পনা অনুযায়ী এবং বাকি ৩৭ শতাংশে অপরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া ৮ শতাংশ ভূমিতে বাণিজ্যিক ও ৯ শতাংশে প্রশাসনিক অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। ৪ শতাংশ জায়গায় উন্মুক্ত জলাশয়সহ ১০ শতাংশ ভূমিতে গড়ে উঠেছে সেনানিবাস এবং ২ শতাংশে বিমানবন্দর। পরিকল্পিত কোনো মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় শহরের প্রাণকেন্দ্রে গড়ে উঠেছে বড় বড় প্রশাসনিক ভবন, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিমানবন্দর। শহরের ১২ শতাংশ জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা এসব স্থাপনা প্রভাব ফেলছে সামগ্রিক উন্নয়নে।

এক গবেষণায় বলা হয়, ৩৪ শতাংশ মানুষ নগরে বসবাস করে। অথচ গত ২০ থেকে ২৫ বছরে নগরায়ণ পরিকল্পিতভাবে হয়নি। যেখানে সেখানে ঘরবাড়ি উঠে যাচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণের থাবা পড়েছে ফসলি জমির ওপর। কমে যাচ্ছে আবাদি বা ফসলি জমি। অনেক শহরে এ অবস্থা আশঙ্কাজনক। দেখা যাচ্ছে, জমি কমে যাওয়ায় একদিকে উৎপাদন কমছে, অন্যদিকে আগামীর বসতির জন্য চরম হুমকি ও চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, যা আমাদের দেশের জন্য মোটেও কোনো সুখকর খবর নয়।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close